রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে অসন্তোষের মুখে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ জামিনুর রহমানের চুক্তি বাতিল করে সরকার। পতন আঁচ করতে পেরে চাকরির সময়ে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ, পদোন্নতি প্রদান এবং অনিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রবিধানমালা লঙ্ঘন করে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে গেছেন তিনি। চলতি দায়িত্বে নতুন এমডি নিয়োগ দেওয়া হলেও বিষয়গুলোর সমাধান মিলছে না। ফলে সমস্যার আবর্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক।
পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক খান ইকবাল হাসানকে ব্যাংকের এমডির অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক পূর্বতন ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প থেকে আইনের মাধ্যমে ব্যাংকে রুপান্তরিত হয়। ব্যাংকটির প্রবিধানমালা ২০২২ অনুযায়ী, কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্ত করার একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া ও নিয়ম রয়েছে। অথচ সদ্য চুক্তি বাতিল হওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মো. জামিনুর রহমান কোনো ধরনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বরখাস্ত করেছেন। সাময়িক বরখাস্ত করতে গেলে যে সরকারি নীতিমালা রয়েছে, তার কোনো কিছুই মানা হয়নি। মাত্র একদিনের মধ্যে পূর্বের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ দেন। যা নিয়মের পুরোপুরি লঙ্ঘন।
পড়ুন: ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে অস্থিরতা
ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, নিয়ম লঙ্ঘন করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তা নির্বাহী সিদ্ধান্তের মতো একক ক্ষমতাবলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক সমাধান করে ফেলতে পারেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক খান ইকবাল হাসান এখন একক সিদ্ধান্তে এই বরখাস্তের আদেশ তুলে নিচ্ছেন না। তিনি বোর্ডের দোহাই দিচ্ছেন। বোর্ড থেকে পাশ করার কথা বলেছন।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, প্রশ্ন হচ্ছে, যখন বরখাস্তের আদেশ দেওয়া হয়েছে, তখন তো কোনো বোর্ড থেকে পাস করা হয় নাই। তাহলে এখন কেন বরখাস্ত উঠাতে গেলে বোর্ড পাশ করতে হবে? এসবের মাধ্যমে তাহলে কি বোঝা যাচ্ছে যে, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক খান ইকবাল হাসান যিনি দায়িত্ব পেয়েছেন, তিনিও আগের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মো. জামিনুর রহমানকে অনুসরণ করছেন।
ব্যাংকের অন্য একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে রাইজিংবিডিকে বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের সময় দলীয় বিবেচনায় যারা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে উচ্চপদস্থদের পদত্যাগের দাবিতে সব শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী সোচ্চার ভূমিকা পালন করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ভিসির পদত্যাগের জন্য আল্টিমেটাম দিচ্ছেন। কিন্তু কোথাও কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী-শিক্ষক বরখাস্ত হয়নি। তাহলে কেন পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের এই মেধাবী কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করা হলো? একই সাথে কেন বোর্ডের দোহাই দিয়ে তাদের বরখাস্ত তোলা হচ্ছে না।
তিনি বলেন, দ্রুত তাদের বরখাস্তের আদেশ তুলে নিয়ে কর্মক্ষেত্রে যোগদানের সুযোগ দেওয়া অতীব প্রয়োজন। মেধাবীদের কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে এবং দেশেরও ক্ষতি হচ্ছে।
সদ্য চুক্তি বাতিল হওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মো. জামিনুর রহমান নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ১৫ আগস্ট ৩৭ জন সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার, প্রিন্সিপাল অফিসার এবং সিনিয়র অফিসারকে সাময়িক বরখাস্ত করে বিভিন্ন জেলা শহরে সংযুক্ত করেন। আদেশে বলা হয়, ‘সংযুক্ত জেলায় ১৮ আগস্ট যোগদান না করলে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। বিষয়টি একটি নজিরবিহীন ঘটনা।’
জানা গেছে, সাময়িক বরখাস্ত করতে গেলে যে সরকারি নীতিমালা রয়েছে, তার কোনো কিছুই এখানে মানা হয়নি। মাত্র একদিনের মধ্যে পূর্বের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ দেন।
ব্যাংকের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, শেখ হাসিনার উৎখাতের পর দেশের সাধারণ জনতা এখন জেগে উঠেছে। পূর্বের সরকারের সময় দলীয় বিবেচনায় যারা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে পদত্যাগের দাবিতে সব শ্রেণির কর্মকর্তা কর্মচারী সোচ্চার ভূমিকা পালন করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ভিসির পদত্যাগের জন্য আল্টিমেটাম দিচ্ছেন। কিন্তু কোথাও কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী-শিক্ষক বরখাস্ত হয়নি। তাহলে কেন পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের এই মেধাবী কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করা হলো? একই সাথে কেন বোর্ডের দোহাই দিয়ে তাদের বরখাস্ত তোলা হচ্ছে না। দ্রুত তাদের বরখাস্তের আদেশ তুলে নিয়ে কর্মক্ষেত্রে যোগদানের সুযোগ দেওয়া অতীব প্রয়োজন। মেধাবীদের কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে এবং দেশেরও ক্ষতি হচ্ছে।
এখনো রয়ে গেছেন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা: স্বেচ্ছাচারিতা, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্বৃত্তায়ন, অর্থের বিনিময়ে বদলি-পদোন্নতি-নিয়োগ, মামলা বাণিজ্য, অর্থের বিনিময়ে শাস্তি মওকুফসহ পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সব খাতে ব্যাপক দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রকাশ্যে এসব অভিযোগ তুলেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ মো. জামিনুর রহমানের বিরুদ্ধে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান আকরাম-আল-হোসেন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ জামিনুর রহমানের চুক্তি বাতিল করা হয়। কিন্তু এমডি শেখ জামিনুর রহমানের এসব অপকর্মের সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত সিস্টেম এনালিস্ট আল্লামা মোহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া তানহার এবং সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট শাহেদ আলমগীর চাকরিতে বহাল রয়েছেন। ফলে চেয়ারম্যান এবং এমডির বিদায়ের পরেও ব্যাংকটিতে অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ না হওয়ার আশঙ্কা করছেন সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এই দুজনের দুর্নীতি এই ব্যাংকে অনেকটা ওপেন সিক্রেট। গত ৭ আগস্ট ব্যাংকের অন্যান্য সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসাররা ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মহাব্যবস্থাপকের কাছে আইসিটি বিভাগের সিস্টেম এনালিস্ট আল্লামা ইয়াহিয়া তানহার বিরুদ্ধে অনিয়মের বিষয়ে বিস্তারিত জানান। অভিযোগগুলোর ভেতর ছিলো—‘আইসিটি বিভাগের দায়িত্বে থাকলেও ব্যাংকের প্রতিটা বিভাগে তার হুকুম ছাড়া বা সুপারিশ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানকের সাথে বিশেষ সম্পর্ককে পুঁজি করে ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছিলেন তিনি। অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে এমডি উক্ত আল্লামা ইয়াহিয়া তানহাকে সাধারণ সেবা ও কল্যাণ বিভাগের (ব্যাংকের বিভিন্ন ক্রয়ের সাথে জড়িত বিভাগ) দায়িত্ব দেন। শুধু সাধারণ সেবা ও কল্যাণ বিভাগ নয়, অঘোষিতভাবে কর্মী ব্যবস্থাপনা বিভাগ, কমপ্লায়েন্স বিভাগ, শৃঙ্খলা ও আপিল বিভাগসহ সব বিভাগেই তার হুমুকের বাইরে কিছু করার সুযোগ ছিল না। তিনি প্রতিটা বিভাগে সবার ওপর নজরদারির জন্য সিসিটিভি মনিটরিং ব্যবস্থা তার নিজস্ব সুসজ্জিত চেম্বারে রেখেছিলেন। বলা যেতে পারে তিনি এমডির ডান হাত হিসেবে সব অবৈধ কাজের সহযোগী।’
এছাড়া বিভিন্ন কেনাকাটায় অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের অনেক অভিযোগ রয়েছে ইয়াহিয়া তানহা ও শাহেদ আলমগীরের বিরুদ্ধে। কিন্তু তারা এখনো বহাল তবিয়তে থাকায় ব্যাংকের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এক ধরনের অজানা আশঙ্কায় রয়েছেন। তারা বলছেন, দেশের স্বার্থে-ব্যাংকের স্বার্থে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া প্রয়োজন।
সামগ্রিক বিষয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক খান ইকবাল হাসান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।