রিশিত খান : চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী শেফালী ঘোষের মৃত্যুর আট বছর পূর্ণ হবে এ বছর ডিসেম্বরে। লাখো ভক্ত-অনুরক্তকে চোখের জলে ভাসিয়ে এই মহান শিল্পী চিরবিদায় নিয়েছেন ২০০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর।
শেফালী ঘোষকে এক নামে, এক ডাকে সবাই চেনেন। শুধু বাংলাদেশের মধ্যেই তার পরিচয় সীমাবদ্ধ ছিল না। বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বেও পরিচিত ছিলেন আঞ্চলিক গানের রানি হিসেবে। হৃদয়কাড়া সুরে দেশ-বিদেশে চট্টগ্রামকে তুলে ধরেছেন তার নিজস্ব গায়কিতে।
এতে শুধু প্রেম-ভালোবাসা নয়, চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক শোভা, মানুষের স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষাও প্রকাশ পেয়েছে। মানুষের মনের কথা সুরের আঙ্গিকে মায়ের ভাষাতে তুলে ধরে তিনি শুধু খ্যাতিই অর্জন করেননি, সংগীতভুবনে নিজের ঐশ্বর্যকেও তুলে ধরেছেন আপন মহিমায়। সুরে সুরে চট্টগ্রামকে তুলে ধরেছেন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বহির্বিশ্ব পর্যন্ত। শেফালী ঘোষ মানেই যেকোনো লোকসংগীতের অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ। শেফালী ঘোষ মানেই মঞ্চ কাঁপানো অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক শিল্পী। সংগীতপিপাসুদের করতালিতে মুখরিত আসর মাত করে দেওয়া অনন্য এক শিল্পীর নাম।
বিশেষ করে, যারা চট্টগ্রামের মানুষ তারা কোনো দিনই শেফালী ঘোষকে ছাড়া কোনো সফল অনুষ্ঠানের কথা কল্পনাও করতে পারেননি। শেফালী ঘোষ এভাবে স্বদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বের সংগীতাঙ্গনে নিজের অবস্থান মজবুত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। লন্ডনের শ্রোতাদের কাছে, ইউরোপ-আমেরিকার নানা শহরে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার স্থানটি দখল করে ছিলেন তিনি। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের ২০টিরও বেশি দেশে সংগীত পরিবেশন করেছেন।
তার গাওয়া একটি বিখ্যাত গান- ‘যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম/ যদি নতুন একখান মুখ পাইতাম/ মহেশখাইল্যা পানের খিলি তারে বানাই খাওয়াইতাম।’ এটি তার একটি অসাধারণ জনপ্রিয় গান। গানটির রচয়িতা ও সুরকার এম এন আকতার। মোহনলাল দাশের লেখা ও সুরে ‘ও রে সাম্পানওয়ালা/ তুই আমারে করলি দিওয়ানা’ আরেকটি অসাধারণ জনপ্রিয় গান। কর্ণফুলী সম্পর্কে লেখা ‘ছোট ছোট ঢেউ তুলি পানিত/ লুসাই পাহাড়ত্তুন লামি যারগই কর্ণফুলী’ শেফালী ঘোষের আরো একটি অসম্ভব জনপ্রিয় গান। কর্ণফুলী বা কাঁইচা নিয়ে চট্টগ্রামবাসীর আগ্রহ ও আবেগের মতো নিজের অসাধারণ সারল্য দিয়ে গানটি গেয়েছেন। এই গানটির ভিডিও রেকর্ড করার পর তা টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছে। এজন্য শিল্পী শেফালী ঘোষের কাছে চট্টগ্রামবাসী ঋণী। তার আরেকটি বড় পরিচয় হচ্ছে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন শিল্পী হিসেবে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাসংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন।
সংস্কৃতির বিকাশে সংগীত অত্যন্ত জোরালো ভূমিকা পালন করে থাকে। এ কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। চট্টগ্রাম অঞ্চলের সংস্কৃতির বিকাশে কিংবা চট্টগ্রামের সংস্কৃতি দেশবাসীর কাছে তুলে ধরার ক্ষেত্রে একজন শিল্পী হিসেবে শেফালী ঘোষ যে অবদান রেখেছেন, তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
শেফালী ঘোষ আমাদের গর্ব-অহংকার। আঞ্চলিক গানের এই শিল্পীকে নিয়ে আমাদের অহংকারের শেষ নেই। অসংখ্য জনপ্রিয় গানের রানি তিনি। প্রায় পাঁচ দশকের সংগীত জীবনে তিনি সহস্রাধিক গান গেয়েছেন। তার অনেক গানই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এনে দেয় ঈর্ষণীয় খ্যাতি। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত বসুন্ধরা সিনেমায় তার গাওয়া একটি গানের শুরুটা ছিল ‘কি ছবি বানাইবা তুই আই ন বুঝি।’
কৈশোরে বাবা কৃষ্ণগোপাল ঘোষ ও মা আশালতা ঘোষের অনুপ্রেরণায় তিনি পরিণত শিল্পী হয়ে ওঠেন। তার গানের প্রথম ওস্তাদ ছিলেন তেজেন সেন। এ ছাড়া অধ্যক্ষ ওস্তাদ শিবশঙ্কর মিত্র, ওস্তাদ জগদানন্দ বড়ুয়া, নীরদ বড়ুয়া, মিহির নদী, গোপালকৃষ্ণ চৌধুরীসহ আরো বেশ কয়েকজন সংগীতজ্ঞের কাছে তিনি তালিম নেন। প্রথমে রবীন্দ্র, নজরুল এবং আধুনিক গান শিখতে শুরু করলেও এক পর্যায়ে তিনি ঝুঁকে পড়েন আঞ্চলিক গানের দিকে। এ ক্ষেত্রে তার অনুপ্রেরণা ছিল ওস্তাদ এম এন আকতার, এম এ কাশেম, আবদুল গফুর হালী, সৈয়দ মহিউদ্দিন প্রমুখ।ষাটের দশকের মাঝামাঝি তার সংগীতজীবনের বিকাশ হলেও স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে শেফালী ঘোষ আমাদের সংগীতজগতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। সংগীত পরিবেশনায় তার ছিল নিজস্ব একটা ভঙ্গি। শেফালী ঘোষের গানে ছিল বাংলার সোঁদা মাটির গন্ধ, ছিল শিকড়সংলগ্নতার বিভূতি।
প্রখ্যাত শিল্পী কলিম শরাফীর তত্ত্বাবধানে স্বাধীনতার আগেই তৎকালীন পাকিস্তানের বিখ্যাত ইএমআই গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে শেফালী ঘোষের গানের অ্যালবাম বের হয়। ১৯৭০ সালে শেফালী ঘোষ যুক্ত হন টেলিভিশনের সঙ্গে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে শেফালী ঘোষ শিল্পী হিসেবেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে গান গেয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সাহায্য সংগ্রহ করেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধিতে সহায়তা করেন।
তার গাওয়া গান নিয়ে ২০০-এরও বেশি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। তিনি মালকাবানু, মধুমিতা, বসুন্ধরা, মাটির মানুষ, স্বামী, মনের মানুষ, সাম্পানওয়ালা, বর্গী এলো দেশেসহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন। এ ছাড়া যাত্রা ও নাটকেও তার অংশগ্রহণ ছিল নিয়মিত।
শেফালী ঘোষ জীবদ্দশায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক পদক-১৯৯০, বাংলা একাডেমি আজীবন সম্মাননা পদক-২০০২ ও শিল্পকলা একাডেমী পদক-২০০৩ লাভ করেন। মৃত্যুর পর তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে একুশে পদক-২০০৬-এ ভূষিত করা হয়।
এক বিশাল জনপদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনাকে তিনি তার কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন। তার গানে প্রতিধ্বনিত হতো বাংলার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মানুষের জীবনাচরণ আর সংস্কৃতি। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যেন একটি যুগেরই অবসান হয়েছে।
আঞ্চলিক গানের এই মহান শিল্পী শেফালী ঘোষ অনেক দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেছেন। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বহুদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন ভারতের অ্যাপোলা হাসপাতালে।
শেফালী ঘোষ আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন বহুকাল। যত দিন এই বাংলা থাকবে, বাংলার মাটি থাকবে, তত দিন তার সুর মূর্ছনা বাঙালিকে অনুপ্রেরণা জোগাবে, আন্দোলিত করবে। শিল্পী শেফালী ঘোষের কীর্তি আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনেই সংরক্ষণ করতে হবে। লেখক: সিনিয়র সহসম্পাদক, রাইজিংবিডি ডটকম
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ জুলাই ২০১৪/সনি/কমল কর্মকার