রাইজিংবিডি স্পেশাল

‘আবরার হয়তো মাকে ভুলে গেছে, আসে না ডাকেও না’

মা বসে থাকেন। ভাবেন আবরার ফিরে আসবে। মা বলে ডাকবে। কিন্তু না, আবরার আর আসে না। মায়ের অভিমানী মন তখন ভাবে, ‘আবরার হয়তো মাকে ভুলে গেছে। কাছে আসে না, মা বলে ডাকেও না। হয়তো মা বলে ডাকতেও চায় না।’ 

মা রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘কিন্তু আমি তো মা। আমি তো আর ভুলে থাকতে পারি না। সব সময় মনে পড়ে ছেলের কথা।’

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় চকবাজার থানায় হত্যা মামলা করেন আবরার ফাহাদের বাবা। ওই মামলার রায়ে ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর বুয়েটের ২০ শিক্ষার্থীকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। মামলাটি এখন উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। আসামিদের ডেথ রেফারেন্স শুনানির অপেক্ষায় আছে।

আবরারের বাবা বরকতুল্লাহ জানান, আবরারের কথা চিন্তা করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছে ওর মা। ছেলের কথা মনে করে প্রায় সে কান্না করে। সব সময় আবরারের কথা মনে করে।

তিনি বলেন, পাঁচ বছর হয়ে গেছে। ছেলেটাকে কি নির্মমভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলে। এ কথা মনে পড়লে আর ভালো লাগে না। দুঃখ কষ্টের মধ্য দিয়ে সময় যাচ্ছে। মামলাটা উচ্চ আদালতে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স শুনানির অপেক্ষায় আছে। আশা করছি, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। নিম্ন আদালতের রায় উচ্চ আদালতে বহাল থাকবে।

বুয়েটের একটা হলের নাম আবরারের নামে করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বরকতুল্লাহ বলেন, ছাত্ররা এ দাবি আগে থেকে করে আসছে। কিন্তু ওরা (বুয়েট কর্তৃপক্ষ) কিছু করছে না।

আবরারের মা রোকেয়া খাতুন বলেন, পাঁচ বছর চলে গেছে। মনে বড় কষ্ট। আবরারের সমবয়সীরা কেউ চাকরি করছে। কেউ বিয়ে করেছে। গতকালও (শুক্রবার) একজনের বিয়ের দাওয়াত থেকে আসলাম। কারো আবার সন্তানও আছে। আমার ছেলেটা থাকলেও হয়তো চাকরি করতো, বিয়ে করতো। বিভিন্ন কারণে কষ্ট পাচ্ছি। বুকটা হাহাকার করে।

তিনি বলেন, সরকার পরিবর্তন হয়েছে। আগের সরকার যদি দেশকে ঠিকমত শাসন করতো, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতো তাহলে হাজার হাজার মায়ের বুক খালি হতো না। ওবায়দুল কাদের যদি তখন ছাত্রলীগকে লেলিয়ে না দিতেন তাহলে এতো প্রাণহানি ঘটতো না। তাদের কারণে হাজার হাজার মা আমার মতো কষ্ট পাচ্ছে। সবার হত্যারই বিচার হওয়া দরকার। ছাত্র রাজনীতির কারণে এতো বড় ক্ষতি হয়ে গেলো। হাজার হাজার মা সন্তান হারা হলো। আমি যেমন কষ্ট পাচ্ছি, তারাও পাচ্ছে। আর একটা মা বোঝে সন্তান হারানোর কষ্ট।

এক প্রশ্নের জবাবে রোকেয়া খাতুন বলেন, এখন আর আবরারকে স্বপ্নে দেখি না। ও হয়তো মাকে ভুলে গেছে। মা তো আর ভুলতে পারে না। আবরার এখন আর মায়ের কাছে আসে না। মাকে ডাকে না। হয়তো ডাকতেও চাই না। পাঁচটা বছর হয়ে গেলো। বাড়ি আসার আগে আমাকে ফোন দিতো। বলতো মা আমি আসবো, কোথাও যাবে না। বাড়িতে থাকবে। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ছোট সন্তান আবরার ফাইয়াজকে নিয়েও টেনশনে থাকেন এই মা।

কোটা আন্দোলনের বিষয় তুলে ধরে মেধাবী এই দুই সন্তানের মা বলেন, পরিবারের ছোটটা ভুল করতে পারে। অভিভাবক হিসেবে সেটা একজন সমাধান করেন। কোটা আন্দোলনের সময়ও পারতো। তাদের ডেকে নিয়ে বিষয়টা সমাধান করতে। তাহলে হয়তো হাজার হাজার মাকে সন্তান হারাতে হতো না।কিন্তু সমাধান না করে সেটাকে রাজনৈতিক পর্যায়ে নিয়ে গেলো।সরকারি ব্যর্থতার কারণে হাজার হাজার মানুষ মারা গেলো। এদের হত্যাকাণ্ডেরও বিচার চায়। কারণ যাদের সন্তান হারিয়েছে তারা কেউ আমার বোন, কেউ বা মা। আবরারের বিচার হবে। ওদেরও বিচার হতে হবে।

রায়টা দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়ে বর্তমান অন্তর্বতী সরকারের কাছে রোকেয়া খাতুনের দাবি, তখন ৩ জনকে সরকার গ্রেপ্তার করেনি। পলাতক তিন জনকে ধরে এসে বিচার কার্যকর করা হোক। 

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে পরের দিন ৭ অক্টোবর চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন আবরার ফাহাদের বাবা বরকতুল্লাহ। ওই বছরের ১৩ নভেম্বর ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) পরিদর্শক ওয়াহেদুজ্জামান।

২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ২৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু করেন। ২০২১ সালের বছর ৮ ডিসেম্বর আবরার হত্যা মামলায় ২০ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং পাঁচ আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন ঢাকার তৎকালীন এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন-অনিক সরকার, ইফতি মোশাররফ সকাল, মো. মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মেহেদী হাসান রবিন, মো. মনিরুজ্জামান মনির, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর, শিক্ষার্থী মো. মুজাহিদুর রহমান ও এএসএম নাজমুস সাদাত, মেহেদী হাসান রাসেল, মুনতাসির আল জেমি, আবরারের রুমমেট মিজানুর রহমান, শাসছুল আরেফিন রাফাত, মো. মাজেদুর রহমান মাজেদ, শামীম বিল্লাহ, হোসেন মোহাম্মাদ তোহা, মোর্শেদ অমত্য ইসলাম ও এস এম মাহমুদ সেতু, মোর্শেদ-উজ-জামান মন্ডল ওরফে জিসান, এহতেশামুল রাব্বি ওরফে তানিম ও মুজতবা রাফিদ।

যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্তরা হলেন-অমিত সাহা, মুহতামিম ফুয়াদ, ইশতিয়াক আহম্মেদ মুন্না, আকাশ হোসেন ও মুয়াজ ওরফে আবু হুরায়রা।