সীমান্ত হত্যা বন্ধে ভারত বারবার আশ্বাস দিলেও সেটার বাস্তবায়ন শূন্যের কোঠায়। যার সবশেষ প্রমাণ, ২৪ অক্টোবর নেত্রকোণা সীমান্তে যুবকের মরদেহ উদ্ধার।
চলতি বছরের ১০ মাসেই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলি এবং সীমান্তে কাঠামোবদ্ধ আতঙ্কের পরিবেশের শিকার হয়ে প্রাণ গেছে অন্তত ১৭ বাংলাদেশির; আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ৩১।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণারয় এবং ভূরাজনৈতিক ও বৈদেশিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা সীমান্ত হত্যা বন্ধে নানা উদ্যোগ ও পরামর্শ বাস্তবায়নের তাগিদ দিলেও কার্যত তার কোনো প্রতিফলন নেই।
তারা বলছেন, সীমান্ত হত্যা বন্ধে ভারতের সঙ্গে বিজিবি ও সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে আলোচনা করা হলেও প্রতিবেশী দেশটির কাছ থেকে ঘুরেফিরে আসছে ‘আশ্বাস’ এর বার্তা।
সবশেষ গত ২৬ অক্টোবর বাংলাদেশি নাগরিক রিজাউল করিমের মরদেহ হস্তান্তর করে বিএসএফ। ভারতীয় এই বাহিনীটির দাবি, গত ২৪ অক্টোবর তাড়া খেয়ে পালানোর সময় ভারতের অভ্যন্তরে পানিতে ডুবে মারা যায় রিজাউল।
২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সীমান্তে বিএসএফ এর হাতে প্রাণ গেছে ৫৯৪ জনের।
রাইজিংবিডিসহ দেশের অন্যান্য গণমাধ্যমে আসা খবর অনুযায়ী, শুধু ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ১৭ বাংলাদেশি। এর মধ্যে লালমনিরহাট সীমান্ত এলাকায় সবচেয়ে বেশি তিন জন প্রাণ হারিয়েছেন।
অবশ্য সার্বিক হিসাব পেতে গবেষণার দাবি রাখে। তবে যেসব ঘটনার তথ্য হাতে রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল মৌলভীবাজারে কিশোরী স্বর্ণা দাস ও ঠাকুরগাঁওয়ে জয়ন্ত কুমার হত্যা।
বাদ যায়নি বিজিবি সদস্যরাও। বছরের শুরুতে যশোর সীমান্তে বিএসএফে গুলিতে মোহাম্মদ রইশুদ্দীন নামে এক বিজিবি সদস্য মারা যান।
দেশের ঠাকুরগাঁও সীমান্তে চলতি বছরের এখন পর্যন্ত দুজন নিহতের খবর মিলেছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর জেলার সীমান্তে জয়ন্ত কুমার সিংহ ওরফে জাম্বু (১৫) বিএসএফ’র গুলিতে নিহত হয়। এর আগে গত ৫ জুলাই বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার নগরভিটা সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে মো. রাজু (১৯) নিহত হন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তেও চলতি বছরের এখন পর্যন্ত দুজন নিহতের খবর মিলেছে। গত ১২ আগস্ট জেলার ওয়াহেদপুর সীমান্তে গুলিতে নিহত হন আব্দুল্লাহ নামে এক যুবক। এই জেলায় এর আগে ৪ এপ্রিল সাইফুল ইসলাম নামে একজনকে হত্যা করে দুদিন পর লাশ ফেরত দেয় বিএসএফ।
গত ৯ জুন কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলায় সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে মো. আনোয়ার হোসেন (৫০) নামে এক ব্যক্তি নিহত হন।
৮ মে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে দুই বাংলাদেশি নিহত হন। ঘটনার পর বিএসএফ সদস্যরা তাদের মরদেহ নিয়ে যায়। দুই দিন পর তাদের লাশ ফেরত দেওয়া হয়।
চলতি বছরের ২২ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে মো. হাসান (২৫) নামের এক বাংলাদেশি যুবক নিহত হন। কসবা থানা সূত্রে সেসময় জানা যায়, হাসান নামের ওই যুবককে ধাওয়া দিয়ে গুলি করে বিএসএফ।
গত ২৭ মার্চ লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার দূর্গাপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে আহত লিটন মিয়া (২০) ভারতের কোচবিহার জেলার এমজেএন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
পরদিন (২৮ মার্চ) দূর্গাপুর সীমান্তে বিএসএফ মরদেহ হস্তান্তর করে। পরের মাসে (২৬ এপ্রিল) জেলার পাটগ্রাম সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে আবুল কালাম ডাকু (২০) নামে এক যুবক নিহত হন। আর ২৫ জুন রাতে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার গোড়ল ইউনিয়নের মালগারা সীমান্তে নুরুল ইসলাম (৬০) নামে একজন গুলিতে মারা যান।
এর আগে ১৮ মার্চ কুলাউড়া সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত বাংলাদেশি নাগরিক পারভেজ আলী ওরফে সাদ্দামের (১৫) মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে গুলিতে ১ সেপ্টেম্বর নিহত হন স্বর্ণা দাস নামে ১৬ বছর বয়সি এক কিশোরী। হত্যাকাণ্ডের প্রায় ৪৫ ঘণ্টা পর ৩ সেপ্টেম্বর চাতলাপুর চেকপোস্ট দিয়ে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।
গত ২৬ মার্চ নওগাঁর পোরশা সীমান্তের ওপারে বিএসএফের গুলিতে আল আমিন (৪০) নামে এক বাংলাদেশি যুবক নিহত হন।
চলতি বছরের শুরুতে (২২ জানুয়ারি) যশোরের ধান্যখোলা বিওপির জেলেপাড়া পোস্ট এলাকায় বিএসএফের গুলিতে নিহত হন বিজিবির সদস্য মোহাম্মদ রইশুদ্দীন। দুদিন পর ২৪ জানুয়ারি তার লাশ বাংলাদেশে হস্তান্তর করা হয়।
বিজিবি সদস্য নিহত হওয়ার পর একে ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা বলে বর্ণনা করেছিলেন তৎকালীন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তবে দুই দেশের বাহিনীর মধ্যে এ ধরনের সংঘাতের ঘটনা খুব একটা ঘটে না।
এর আগে ২০১৯ সালের অক্টোবরে রাজশাহী সীমান্তে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে গোলাগুলি হয়েছিল। সেসময় বিজিবির গুলিতে একজন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছিল। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এই ঘটনাকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত এক দুর্ঘটনা’ বলে বর্ণনা করেছিলেন।
২৯ জানুয়ারি লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার তিন বিঘা করিডোর দিয়ে রবিউল ইসলাম টুকলুর (৩৩) মরদেহ হস্তান্তর করে বিএসএফ। এর আগে ২৮ জানুয়ারি ভোরে পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম-আঙ্গোরপোতা সীমান্তের ১ নম্বর মেইন পিলারের কাছে বিএসএফের গুলিতে টুকলু নিহত হন।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেয় নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।
১৩ আগস্ট তৎকালীন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছিলেন, ‘বিজিবির মতো একটা ফোর্সকে (বাহিনী) পিঠ দেখাতে বলেছে সীমান্তে। সীমান্তে আমাদের লোক মরে, বিজিবি পতাকা বৈঠক করতে বাধ্য হয়। আমি বলেছি যে, পিঠ দেখাবেন না। এনাফ ইজ এনাফ (যথেষ্ট হয়েছে)।’
আইন ও সালিশ কেন্দ্র-আসক এর তথ্য মতে, ২০২৩ সালে বিএসএফ সীমান্তে গুলি করে ৩১ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। এর আগে ২০২১ সালে ১৮ এবং ২০২২ সালে ২৩ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। ২০০৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বিএসএফের হাতে অন্তত ৫২২ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক মনে করেন, ‘এই হত্যাকাণ্ড বন্ধে দুই দেশের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তৎপর হতে হবে। সীমান্তে হত্যা বন্ধে সংশ্লিষ্ট এই দপ্তরগুলোতে তৎপরতায় ঘাটতি রয়েছে।’
‘দুই দেশেই আইন আছে, তবুও সীমান্তে আইন লঙ্ঘন করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে; যা মানবাধিকার লঙ্ঘন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আমেনা মহসীন বলেন, ‘ভারত বারবারই আমাদের আশ্বাস দেয়, সীমান্তে কোনো নির্যাতন বা হত্যার ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু কোনো সমাধান আসছে না।
‘দেশটির সাথে দ্বিপক্ষীয় যে কোনো আলোচনায় সীমান্তে হত্যা জিরোপয়েন্টে আনতে আমাদের জোর দিয়ে বিষয়টি তুলতে হবে। এর সাথে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক যেমন জড়িত, উভয় দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জোরালো পদক্ষেপও প্রয়োজন।’
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রায় ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের আন্তর্জাতিক স্থল সীমান্ত রয়েছে; যা বিশ্বে পঞ্চম বৃহত্তম। সীমান্ত হত্যাকাণ্ড শূন্যে নামাতে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যৌথ বিবৃতি দিয়েছিলেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১৪ সালে ভারত থেকে গরু রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এরপরও চোরাইপথে গরু আসছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন মূলত রাখাল শ্রেণির চোরাকারবারিরা। ২০১১ সালে সীমান্তে ফেলানি হত্যার নির্মম ঘটনা বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলে। এর বছর ছয়েক পরে ২০১৮ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সীমান্ত সম্মেলনে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার প্রতিশ্রুতি দেয় ভারত। ওই প্রতিশ্রুতি তারা রাখেনি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশ বরাবরই ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে বাংলাদেশি নিহতের ঘটনায় কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে।
‘এ ধরনের ‘‘জঘন্য’’ কর্মকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি বন্ধ ও এসব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করে দায়ীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে ভারত সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ ৯ অক্টোবর মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভারতের হাইকমিশনে পাঠানো চিঠিতে প্রতিবাদ করা হয়েছে।’
গণমাধ্যমে কথা বলার ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত না হওয়ায় ওই কর্মকর্তা তার পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সীমান্ত হত্যাকাণ্ডকে ‘শূন্য পর্যায়ে’ নামিয়ে আনার জন্য ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বারবার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বিএসএফের এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। এতে বাংলাদেশ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
তারা আরও বলেছে, সীমান্তে এ ধরনের ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অযাচিত। এ ধরনের কর্মকাণ্ড দুই দেশের সীমান্ত কর্তৃপক্ষের জন্য ১৯৭৫ সালের যৌথ নির্দেশিকার বিধান লঙ্ঘন করে।
বিজিবি মুখপাত্র কর্নেল মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘সীমান্তে আমরা আগের তুলনায় অনেক বেশি নিরাপত্তা জোরদার করেছি এবং কড়াকড়ি আরোপ করেছি, যাতে কেউ সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা না করে।
‘আর ভারতের পক্ষ থেকে বরাবরই বিষয়টি শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার বিষয়ে আশ্বাস দিচ্ছে, কিন্তু আমরা এর প্রতিফলন দেখছি না।’
বিএসএফের সঙ্গে বিজিবি মহাপরিচালকের আসন্ন বৈঠকেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করার প্রস্তুতি রয়েছে বলে রাইজিংবিডিকে বলেছেন তিনি।
বিজিবি ও বিএসএফের মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠক স্থগিত করা হয়েছে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রধানদের মধ্যে বৈঠকটি আগামী মাসে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে হওয়ার কথা ছিল। সেটি স্থগিত হওয়া এখন তা ডিসেম্বরে হতে পারে বলে সম্ভাবনার কথা বলছেন কর্নেল শরীফুল ইসলাম।