নিখোঁজের তিন দিন পর ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র ফারদিন নূর পরশের লাশ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। ৯ নভেম্বর রাতে তার বাবা নূর উদ্দিন রানা বাদী হয়ে রাজধানীর রামপুরা থানায় মামলা করেন। মামলায় নিহতের বান্ধবী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আমাতুল্লাহ বুশরাসহ অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করা হয়।
এর এক মাস পাঁচ দিন পর ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও র্যাব জানায়, ফারদিন আত্মহত্যা করেছেন। এর সঙ্গে বুশরার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
তখন থেকেই ছেলে হত্যার বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা করছিলেন নূর উদ্দিন রানা। তবু, হাল ছাড়েননি তিনি। গত বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি বুশরার অব্যাহতি চেয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে মামলার তদন্ত সংস্থা ডিবি। ডিবির দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে গত ১৬ এপ্রিল মামলার বাদী নূর উদ্দিন রানার নারাজির আবেদন মঞ্জুর করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। সর্বশেষ, গত ৯ অক্টোবর এ মামলায় অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ ধার্য ছিল। কিন্তু, ওই দিন মামলার তদন্ত সংস্থা সিআইডি প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। এজন্য আদালত আগামী ১২ নভেম্বর প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন।
এদিকে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ফারদিন নূর পরশ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য তুলে ধরেছেন নিহতের বাবা নূর উদ্দিন রানা। তার অভিযোগ, সম্প্রতি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ পরিকল্পিতভাবে ফারদিন নূর পরশকে হত্যা করেছে। এ কাজে বুশরাকে ব্যবহার করা হয়েছে।
ফারদিন নূর পরশ হত্যা মামলা সম্পর্কে বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত সুপার মো. শারাফাত উল্লাহ বলেছেন, ‘মামলার তদন্ত চলছে। আমি তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার আগে পুলিশ, ডিবি ও সিআইডির কর্মকর্তারা এ মামলা তদন্ত করেছেন। তিন মাস আগে আমাকে তদন্তভার দেওয়া হয়েছে। আগামী ১২ নভেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ নির্ধারিত আছে। তদন্তে অনেক কিছু উঠে এসেছে। সে বিষয়গুলো এখন বলা যাচ্ছে না। পরবর্তী নির্ধারিত তারিখে আদালতে এই মামলার তদন্তের বিষয়ে আলোচনা করা হবে।’
যে কারণে ফারদিনকে খুনের অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ফারদিনের বাবার দাবি, বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার অবস্থানের কারণেই ফারদিনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তরা। হত্যার মাস্টারমাইন্ড বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা।
নূর উদ্দিন রানা বলেন, ক্যাম্পাসে লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে মরিয়া বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক সিনিয়র নেতা এবং ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশের (আইইবি) সভাপতি প্রকৌশলী এম এ সবুর এবং প্রকৌশলী মনজুরুল হক মঞ্জুর নেতৃত্বে ফারদিনকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। আবরার ফাহাদ ও ফারদিন নূর পরশ উভয়েই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল। ভারতবিরোধিতার কারণে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড (সিসিটিভি ফুটেজ শিক্ষার্থীদের হাতে চলে আসায়) প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু ফারদিনের বেলায় তা ঘটেনি।
নূর উদ্দিন রানা জানান, হত্যাকাণ্ড সংঘটনের দুই মাসের মধ্যে মূল তদন্ত সংস্থা ডিবি ‘ফারদিন আত্মহত্যা করেছে’ মর্মে প্রতিবেদন দাখিল করলেও দেড় বছরের মধ্যেও অধিকতর তদন্তের দায়িত্বে থাকা সিআইডি প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি আদালতে।
ফারদিন নূর পরশের পরিবারের অভিযোগ, ছাত্রলীগ ফারদিনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। তৎকালীন পুলিশ তদন্ত প্রহসনের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দিয়েছে। এটি সত্যি বিস্ময়কর ও হতাশাজনক।
ফারদিন নূর পরশ টার্গেট হওয়ার মূল কারণ হলো, ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট ঘিরে বুয়েট ক্যাম্পাসে ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বুয়েটের সাবেক নেতৃবৃন্দ’ ব্যানারে জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচি পণ্ড হয়ে যায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ‘লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার’ ক্যাম্পেইনের কারণে। এ ক্যাম্পেইনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ ছিল ফারদিন নূর পরশ।
এ অভিযোগের পক্ষে যুক্তি কী, জানতে চাইলে নূর উদ্দিন রানা বলেন, ‘ফারদিন হত্যার মোটিভ ও রহস্যময়তা বুঝতে উপলব্ধি করতে হবে আবরার হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েট ছাত্রলীগের দুর্দশাগ্রস্ত বাস্তবতাকে।’
কোন বাস্তবতার কথা বলছেন? এর উত্তরে নূর উদ্দিন রানা বলেন, মনে করুন, ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বরে বুয়েট ক্যাম্পাসে সংঘটিত নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডে আবরার ফাহাদের পরিবার হারিয়েছে একটি সন্তান। অন্যদিকে, এই হত্যাকাণ্ডে খুনি প্রমাণিত (সিসিটিভি ফুটেজে) হওয়ায় বুয়েট ছাত্রলীগ পরিবার হারিয়েছে তাদের ২৫ সদস্যকে (২০ জনের ফাঁসি ও ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড)। সেই সাথে হারিয়েছে লেজুড়বৃত্তির সাম্রাজ্য। পতিত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সন্ত্রাসী বাহিনীর জন্য এই বিশাল ক্ষতি মেনে নেওয়ার মতো ছিল না। বিশেষ করে, লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি সুবিধাভোগী সিনিয়র নেতাদের জন্য তো নয়ই। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই বুয়েটসহ দেশের সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্ররাজনীতি চালু করার মাধ্যমে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে আনার চাপ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের সিনিয়র ও সাবেক নেতাদের ওপর।
নূর উদ্দিন রানা বলেন, ‘কোনো চাঞ্চল্যকর ঘটনার রহস্য উদঘাটনে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ, উক্ত স্থান, পারস্পরিক সম্পর্ক এবং পূর্ববর্তী ঘটনাক্রম বিবেচনায় নিতে হবে। আমার সন্তানের অকস্মাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এবং কয়েকদিন পর তার মরদেহপ্রাপ্তির সাথে বুয়েটের লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি, শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের দ্বন্দ্ব, উভয় দিকের নেপথ্যের শক্তিগুলো চিহ্নিত করা এবং এদের কার্যক্রম পর্যালোচনা করাটা আবশ্যিক ছিল। কেন এগুলো বিবেচনায় নিলো না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও তদন্ত কর্তৃপক্ষ? এটি আমাকে বিস্মিত করেছে এবং ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির বিষয়ে সন্দিহান করেছে।
পরশের বাবা বলেন, পরিকল্পিত হত্যাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার কৌশল হিসেবে মূল ঘটনা সংঘটনের দূরবর্তী সময়ে ক্যাম্পাসের বাইরে হত্যার পরিকল্পনা করে (৪ নভেম্বরে, লম্বা ছুটির পূর্বদিন নির্ধারণ)। বিভ্রান্তি সৃষ্টির কৌশল হিসেবে ফারদিনের মেয়ে বন্ধুকে ব্যবহার করে। ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে অপহরণের সুযোগ নিতে বান্ধবী বুশরার সম্পৃক্ততায় ফারদিনকে ক্যাম্পাসের বাইরে রেখে সময়ক্ষেপণের ফাঁদে ফেলে। রাত ১০টায় রামপুরা থেকে অপহরণ, আঘাতহীন হত্যার পরিকল্পনায় অপহরণ করে বাবুবাজার ব্রিজ, কেরানীগঞ্জ ব্রিজ, শামসুল ব্রিজ বা যে কোনো ব্রিজ থেকে জখমহীন প্রচণ্ড আঘাতের পর সাঁতার না জানা ছেলেটিকে ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে।
তিনি জানান, তদন্তের নাটকীয়তায় প্রকৃত ঘটনা আড়াল করতে শহরের সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব ও মিডিয়া ট্রায়েলে ডিবি হারুন গংয়ের পুলিশ লীগকে যুক্ত করে নিয়েছে দোসর হিসেবে।
বিস্মিত কণ্ঠে নূর উদ্দিন বলেন, চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডকে রহস্যময়তায় মুড়ে দেওয়ার সময়ক্ষেপণ প্রক্রিয়ায় তদন্ত সংস্থা পুলিশ লীগের ভূমিকায় নামে।
ফারদিন হত্যার পরিকল্পনায় সবুর ও মঞ্জুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগ করেন এই শোকাহত পিতা।
বুয়েটে লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব দেওয়ার কারণেই ফারদিনকে জীবন দিতে হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
এদিকে, তদন্ত সংস্থা থেকে তেমন আশা পাচ্ছেন না নূর উদ্দিন রানা। তিনি পুনরায় মামলা করার কথাও ভাবছেন।