নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ডাইং ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন মাসুম হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, রুমার সঙ্গে পরকিয়ার সম্পর্ক থাকা অবস্থায় অন্য তরুণীতে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন জসিম। এ ক্ষোভ থেকে তাকে হত্যা করেন রুমা আক্তার। ওই মরদেহ দুই দিন ফ্ল্যাটেই রেখে দিয়ে নিরুদ্বেগ ছিলেন তিনি। পরে খণ্ডিত মরদেহ দুটি স্থানে ফেলে দেওয়া হয়।
শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) বিকেলে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) লিয়াকত আলী জানিয়েছেন, জসিম হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার তরুণী রুমা আক্তার হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে পুলিশের কাছে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। নিহতের বান্ধবী রোকসানা খাতুনকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আটক দুই তরুণীর বয়স ২৮ বছর। পুলিশ তাদের দেওয়া তথ্য যাচাই করেছে। দুজনের বক্তব্যে মিল পাওয়া গেছে।
গ্রেপ্তারকৃতদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, একাধিক নারীর প্রতি আসক্তি ছিল জসিমের। এক মেয়েকে এক সপ্তাহের বেশি ভালো লাগত না তার। পরকিয়া প্রেমিকা রুমার প্রতি জসিমের আকর্ষণ কমে যায়। জসিম অন্য মেয়েদের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন রুমা। দুধের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে জসিমকে অচেতন করে হত্যা করেন তিনি। বাথরুমে নিয়ে মরদেহ সাত টুকরা করা হয়। পরে বান্ধবী রোকসানার সহায়তায় দুটি ব্যাগে ভরে লাশের টুকরোগুলো রূপগঞ্জে ফেলে দিয়ে আসেন রুমা।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের সেরা করদাতা হিসেবে ‘করবাহাদুর’ পুরস্কারপ্রাপ্ত চাঁদ ডাইংয়ের কর্ণধার বিশিষ্ট শিল্পপতি জসিম উদ্দিন মাসুম (৬৫) গত রোববার নিখোঁজ হন। তার পরিবারের পক্ষ থেকে গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। গত বুধবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে পলিথিনে মোড়ানো লাশের সাত টুকরো উদ্ধারের পর পরিচয় মিলে জসিমের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রযুক্তির সহায়তায় তার মোবাইলের তথ্য বিশ্লেষণ করে রাজধানীর কাফরুলে রুমার ফ্ল্যাটের সন্ধান পায়। কাফরুল থেকে রুমা ও তার বান্ধবী রোকসানাকে আটক করে পুলিশ।
গুলশান থানায় করা জিডির সূত্র ধরে পুলিশ কাফরুল এলাকায় রুমার সেই ফ্ল্যাট চিহ্নিত করলেও পরে রূপগঞ্জ থানায় করা হত্যা মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওই ফ্ল্যাট থেকে আরো দুজনকে আটকের পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
জসিম উদ্দিন মাসুম পরিবার নিয়ে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় থাকতেন। তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে আছে।
পুলিশের অনুসন্ধানে জানা গেছে, হত্যার পর কাফরুলের সেই ফ্ল্যাটে দুই দিন লাশ রেখে দিয়েও নিরুদ্বেগ ছিলেন রুমা। সেখানে একটা হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তা কাউকে বুঝতে দেননি তিনি। এমনকি একই ফ্ল্যাটের অন্য বাসিন্দারাও তা জানতে পারেননি।
বুধবার রাতে পুলিশ যখন ওই বাসায় যায়, তখন রুমা ঘুমাচ্ছিলেন। ঘুম থেকে তুলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রথমে এলোমেলো তথ্য দিলেও জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কৌশলের একপর্যায়ে সবকিছু স্বীকার করেন রুমা।
রোববার বিকেলে জসিম তার বাসা থেকে বের হয়ে গুলশানে যান। এর পর ব্যক্তিগত গাড়ির চালককে বাসায় ফিরে যাওয়ার কথা বলেন। মালেক নামে আরেক গাড়িরচালককে ডেকে নিয়ে নারায়ণঞ্জে যাওয়ার কথা ছিল তার। রোববার রাত ১১টা পর্যন্ত জসিমের মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ ছিল। কোনো খোঁজ না পেয়ে সোমবার গুলশান থানায় একটি জিডি করেন তার বড় ছেলে ওবায়দুল ইসলাম শিবু।
জিডির পর তদন্তে নামে পুলিশের একাধিক সংস্থা। বুধবার সকালে রূপগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চন-কুড়িল বিশ্বরোড সড়কের উত্তর পাশে ৫ নম্বর সেক্টরের ব্রাহ্মণখালী এলাকায় লেকের পাড় থেকে পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তির লাশের সাত টুকরো উদ্ধার করে পুলিশ। তিনটি কালো পলিথিনের ব্যাগে থাকা অজ্ঞাত ব্যক্তির মাথা, দুই হাত, শরীরের পেছনের অংশ, নাড়িভুঁড়ি, বাম পা ও বাম ঊরুর কাটা অংশ উদ্ধার করা হয়। পরে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ওই লাশের টুকরা জসিমের।
নিহতের পারিবারিক সূত্র জানায়, ‘নদীর জলে শাপলা ভাসে’সহ দুটি সিনেমার প্রযোজক জসিম। চলচ্চিত্র প্রযোজনার সূত্র ধরে সংশ্লিষ্ট অনেকের পাশাপাশি রুমার সঙ্গে পরিচয় হয়। রুমার বাসা কাফরুলে।
রুমা একটি বিজ্ঞাপনি সংস্থায় ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। পরিচয়ের পর রুমাকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলেন জসিম। রুমা চাকরি ছেড়ে দিয়ে জসিমের ‘রক্ষিতা’ হিসেবে কাফরুলের একটি ফ্ল্যাটে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু, আস্তে আস্তে রুমার প্রতি আকর্ষণ কমে যায় জসিমের। প্রায়ই রুমার ফ্ল্যাটে অন্য মেয়েকে নিয়ে যেতেন জসিম। রুমা অর্থের লোভে কিছুদিন এ বিষয়টি সহ্য করলেও পরে জসিমের প্রতি তার ক্ষোভ জন্মায়। এক পর্যায়ে জসিমকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। রোববার রাতে পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়।
নিহতের ছেলে ওবায়দুল ইসলাম শিবু বলেছেন, আমার বাবাকে হত্যার পর যেভাবে টুকরো করে ফেলা হয়েছে, তা কোনোভাবে মেনে নিতে পারছি না। জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
রুমার কাফরুলের ফ্ল্যাটের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তদন্ত কর্মকর্তারা বলেছেন, রোববার বিকেলে জসিম একটি ব্যাগ নিয়ে একাকি ঢুকেছেন রুমার ফ্ল্যাটে। এর পর তাকে আর বের হতে দেখা যায়নি। তবে, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রুমা ও আরেক তরুণী দুটি ভারী ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যান।
কাফরুলের তিন কক্ষের ওই ফ্ল্যাটে রুমার ছোট বোন, বান্ধবী, ভাবি ও তার বাচ্চা থাকে।
দুধের সঙ্গে চেতনানাশক মিশিয়ে অজ্ঞান করে হত্যা করা হয় জসিমকে। দুই দিন পর মঙ্গলবার একটি কক্ষের বাথরুমে লাশ সাত টুকরো করা হয়। এর পর এক বন্ধুকে দুটি ব্যাগ নিয়ে আসতে বলেন রুমা। সেসব ব্যাগে ভরে সাত টুকরো লাশ রূপগঞ্জের একটি লেকের পাড়ে এবং অন্য চারটি অংশ ৩০০ ফিট এলাকায় একটি কাশবনে ফেলে আসেন। বৃহস্পতিবার রুমার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কাশবন থেকে লাশের চারটি টুকরা উদ্ধার করে পুলিশ। সেখানে হাত, পা ও কোমর থেকে বুকের খণ্ডিত অংশ ছিল।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের শুরুতে হত্যার কারণের বিষয়ে সঠিক তথ্য দিচ্ছিলেন না রুমা। একেক সময় একেক কথা বলছিলেন। পরে রুমা জানান, ক্ষিপ্ত হয়েই জসিমকে হত্যা করেছেন তিনি।
ঘটনার দিন জসিম অপর এক তরুণীকে নিয়ে কাফরুলের বাসায় গিয়েছিলেন বলে দাবি করেন রুমা। তবে, সিসি ক্যামেরার ফুটেজে জসিমকে অন্য কোনো তরুণীকে নিয়ে রুমার বাসায় ঢুকতে দেখা যায়নি।
জসিমের স্বজনদের প্রশ্ন, ফ্ল্যাটে অন্য বাসিন্দা থাকলেও রুমা কীভাবে একাই জসিমকে হত্যার পর লাশ সাত টুকরো করলো?
রুমার দাবি, ফ্ল্যাটের অন্যরা খুনের বিষয়টি জানতেন না। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত চাপাতি, হেকসো ব্লেড বনানীর ২০ নম্বর সড়কের একটি বাসায় রেখে আসেন রুমা। ওই বাসায় অভিযান চালিয়ে চাপাতি, ব্লেড ও মাসুমের কিছু কাপড় জব্দ করা হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, তদন্তে মঙ্গলবার রাতে রূপগঞ্জে রুমার উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। হত্যার পাশাপাশি লাশ গুমে সরাসরি জড়িত তিনি।
রুমা আক্তার ময়মনসিংহ গৌরিপুর থানার তারকান্দা এলাকার নজর আলীর মেয়ে।