দুই বছর আগে এই দিনে পুরান ঢাকায় চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মূল ফটক থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনতাই করা হয়। কয়েকজন দুর্বৃত্ত পুলিশ সদস্যদের চোখে কিছু স্প্রে করে আবু সিদ্দিক সোহেল ও মইনুল হাসান শামীমকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তারা প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। আদালতপাড়া থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় সারা দেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। দেশজুড়ে বাড়ানো হয় নিরাপত্তা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ওই জঙ্গিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালায়।
জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ওই রাতেই ২০ জঙ্গিকে আসামি করে মামলা করেন আদালতের প্রসিকিউশন বিভাগের পুলিশ পরিদর্শক জুলহাস উদ্দিন আকন্দ। মামলাটি তদন্ত করছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। তবে, দুই বছরেও তদন্ত শেষ হয়নি। কবে নাগাদ মামলার তদন্ত শেষ হবে, তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। দ্রুত তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
এদিকে, এখনও অধরা রয়ে গেছে ছিনিয়ে নেওয়া সেই দুই জঙ্গি। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছে তদন্ত সংস্থা।
জঙ্গি ছিনতাইয়ের মামলায় প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ২১ দফা সময় নিয়েছে তদন্ত সংস্থা। সর্বশেষ গত ২২ অক্টোবর এ মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ ধার্য ছিল। তবে, ওই দিন মামলার তদন্ত সংস্থা কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। এজন্য ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আরফাতুল রাকিব ২০ নভেম্বর প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন।
মামলার তদারককারী কর্মকর্তা কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের এডিসি ইমরান হোসেন বলেছেন, ‘‘মামলাটির তদন্ত চলছে। ২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পলাতক দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তারে ৮-১০ বার সম্ভাব্য জায়গায় অভিযান চালানো হয়েছে। আমাদের লাক ফেভার করেনি। তার আগেই তারা সেখান থেকে সরে পড়ে। বিষয়টি নিয়ে আমাদের চেষ্টার কমতি নেই। সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে।’’
এক প্রশ্নের জবাবে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘‘তারা দেশের ভেতরে আছে। সেভাবে তাদের খুঁজছি। তাদের বিরুদ্ধে রেড এলার্ট জারি আছে। ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কারের ঘোষণাও আছে। সিটিটিসির পাশাপাশি অন্যান্য সংস্থাও তাদের গ্রেপ্তারে তৎপর আছে।’’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিটিটিসির ইন্সপেক্টর রমজান আলী বলেছেন, ‘‘আমি এ মামলায় নিউ কামার। ৭-৮ দিন হলো মামলার তদন্তভার পেয়েছি। ভালোভাবে স্টাডি করা হয়নি। তবে, মামলার তদন্ত চলছে। পলাতক দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে। সঠিকভাবে দ্রুত তদন্ত শেষ করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।’’
সবচেয়ে বেশি সময় ধরে এ মামলা তদন্তের দায়িত্বে থাকা সিটিটিসির পুলিশ পরিদর্শক আজিজ আহমেদ বলেছেন, ‘‘মামলায় ২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে এজাহারভুক্ত ১২ জন। বাকি ৯ জন সন্দিগ্ধ আসামি। ছিনিয়ে নেওয়া সেই দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।’’
তিনি বলেন, ‘‘আমি তদন্তের দায়িত্বে থাকাকালে গাজীপুর, নরসিংদী, পাবনাসহ কয়েক জায়গায় অভিযান চালানো হয়। তারা গাজীপুরে এক মাস ছিল। আমরা অভিযান চালানোর আগে তারা সরে যায়। অল্পের জন্য তাদের গ্রেপ্তার করা যায়নি।’’
ওই জঙ্গিরা দেশের ভেতরেই আছেন বলে মনে করেন সাবেক এ তদন্ত কর্মকর্তা। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘‘তারা ফাঁসির আসামি। পাসপোর্ট পাবে না। বর্ডারে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। সারাদেশে রেড এলার্ট জারি আছে। যে কোনোভাবে তারা দেশের ভিতর থাকছে। তারা জানে, ধরা পড়লে ফাঁসি নিশ্চিত।’’
এ মামলায় এখন পর্যন্ত ২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সর্বশেষ জুন মাসে হামিম হোসেন ফাহিম নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার অপর ২০ আসামি হলেন— শাহিন আলম ওরফে কামাল, শাহ আলম ওরফে সালাউদ্দিন, বি এম মজিবুর রহমান, সুমন হোসেন পাটোয়ারী, খাইরুল ইসলাম ওরফে জামিল, মোজাম্মেল হোসেন সাইমন, আরাফাত রহমান, শেখ আব্দুল্লাহ, আব্দুস সবুর ওরফে রাজু, রশিদুন্নবী ভূঁইয়া, মেহেদী হাসান অমি, ফাতিমা তাসনিম শিখা, বখতিয়ার রহমান নাজমুল, হামিম হোসেন ফাহিম, ইদি আমিন, হুসনা আক্তার হাসনা, খোদেজা আক্তার লিপি, তানভীর হোসেন, তানজিনা আফরোজ জাহান, নাসির মিয়া ও ওমর ফারুক তালুকদার।
তাদের মধ্যে প্রথম ১৪ জন কারাগরে। অপর সাত আসামি উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন।
২০২২ সালের ২০ নভেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলায় ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন বিচারক মজিবুর রহমানের আদালতে চার্জ শুনানির তারিখ ধার্য ছিল। মামলায় আসামির সংখ্যা ২০ জন। তাদের মধ্যে দুই আসামি জামিনে ছিলেন। তারা আদালতে হাজির হন। ৬ আসামি শুরু থেকে পলাতক। অপর ১২ আসামিকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। ওই দিন ২০ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। এরপর দুপুর সোয়া ১২টার দিকে আসামিদের আদালত থেকে ঢাকার সিএমএম আদালতের হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মূল ফটকে এলে হঠাৎ করে কয়েকজন দুর্বৃত্ত পুলিশের চোখে কিছু স্প্রে করে আবু সিদ্দিক সোহেল ও মইনুল হাসান শামীমকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।