রাইজিংবিডি স্পেশাল

‘ভারত থেকে আসছে গাড়ি গাড়ি চাল, তবু দাম বেশি’

দিনাজপুরে আমন ধান কাটা-মাড়াই শুরু হয়েছে। ধান-চালের এই ভরা মৌসুমের মধ্যেই হিলি স্থলবন্দর দিয়ে আসছে ভারতীয় চাল। তারপরও খুচরা বাজারে কমেছে না দাম।

চলতি মৌসুমে ধানের দাম বেশি, যে কারণে কমছে না চালের দাম- এমনটাই বলছেন অটো রাইস মিল মালিক ও ধান ব্যবসায়ীরা।

আমদানিকারকদের দাবি, ভারতে চালের দাম বেশি, এ কারণে আমদানিকৃত চাল কম দামে বিক্রি করতে পারছেন না তারা। এদিকে, ভরা মৌসুমেও কম দামে চাল না কিনতে পেরে ক্ষুব্ধ সাধারণ ক্রেতারা।

ধানের জেলা খ্যাত দিনাজপুরে দেশের সিংহভাগ ধান উৎপাদন হয়ে থাকে। চলতি মৌসুমে জেলায় ২ লাখ ৬০ হাজার ৮২০ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়েছে। মাঠে মাঠে পাকা ধানের সমাহার। দেখে মনে হবে সোনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কৃষকেরা ব্যস্ত ধান কাটা-মাড়াইয়ে। জেলায় প্রায় ২০% ধান কাটা হয়েছে। তবে এসব অধিকাংশ কাটা ধান মাঠে রয়েছে। এবার ধানের বাজার চড়া, ১২৫০ থেকে ১৩০০ টাকা মণ দাম পাচ্ছেন কৃষক। সরকার ধান নেবে ১৩২০ টাকা মণ দরে।

জেলার বিভিন্ন অটো রইস মিল ঘুরে দেখা যায়, এখনও এ অঞ্চলের ধান কিনতে পারেননি মিল মালিকরা। কৃষকের ধান এখনো মাঠেই পড়ে আছে। তবে মিলমালিকরা অন্য জেলা থেকে বেশি দামে ৩২ থেকে ৩৪ টাকা কেজি দরে ধান কিনছেন। এসব ধান থেকে চাল প্রস্তুত করে দাম পড়ে প্রায় ৫০ টাকার উপরে। আবার চিকন জাতের চালের পরতা পড়ে ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা কেজিতে।

দেশের বাজারে চালের দাম স্বাভাবিক রাখতে বিনা শুল্কে ভারত থেকে চাল আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। গত ১১ নভেম্বর ভারত থেকে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে চাল আমদানি শুরু হয়। এক সপ্তাহে এই বন্দরে ১৩৩ গাড়িতে প্রায় ৫ হাজার মেট্রিকটন ভারতীয় চাল আমদানি হয়েছে। এসব চাল ৪১০ মার্কিন ডলারে আমদানি করছেন আমদানিকারকরা।

আমন ধানের কাটা-মাড়াই শুরু এবং পর্যাপ্ত ভারতীয় চাল আমদানি হলেও তার কোনো প্রভাব পড়েনি হিলির খুচরা বাজারে। ভারত থেকে আমদানিকৃত স্বর্ণা-৫ বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫৪ থেকে ৫৫ টাকা কেজি। আর দেশি মিনিকেট ও সম্পাকাটারি চাল ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছেন ৭০ টাকা কেজি দরে। ভরা মৌসুমে কম দামে চাল কিনতে না পেরে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সাধারণ ক্রেতারা।

হিলি বন্দর খুচরা বাজারে চাল কিনতে আসা এনামুল হক বলেন, “এখন ধানের মৌসুম, আবার ইন্ডিয়া থেকে গাড়ি গাড়ি চাল আমদানি হচ্ছে। তারপরও চালের দাম কম হচ্ছে না কেন? প্রতি বছর এ সময় নতুন ধান উঠলে বাজারে চালের দাম অনেক কমে যায়। কিন্তু এবার বাজারের চিত্র উল্টো।”

চাল ক্রেতা রেজাউল করিম বলেন, “দেশে পর্যাপ্ত ধানের আবাদ হয়েছে। তারপরও দাম কমছে না কেন? আমরা গরিব মানুষ, দাম না কমলে কীভাবে চলব? হয়তো সিন্ডিকেটের কারণে দাম কমছে না। তাই আমি মনে করি প্রশাসন বাজার মনিটরিং করলে দাম অনেকটা কমে যাবে।”

হিলি বাজারে চাল ব্যবসায়ী স্বপন শাহ বলেন, “বাজারে এখনও নতুন চাল আমদানি হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই নতুন চাল বাজারে আসবে। আমরা ভারত থেকে আমদানিকৃত স্বর্ণা-৫ চাল ৫৩ টাকা কেজি হিসেবে পাইকারি কিনছি। তা ৫৪ টাকা কেজি দরে খুচরা বিক্রি করছি। বাজারে দেশি মিনিকেট ও সম্পাকাটারি চাল ৭০ টাকা কেজি হিসেবে বিক্রি করছি। তবে বেচাবিক্রি অনেকটা কম, নতুন চাল উঠলে দামটাও কমে যাবে।’’

হিলি বন্দরে চাল আমদানিকারক ললিত বাবু বলেন, “কয়েকদিন থেকে আমাদের চাল তেমন কোনো বিক্রি নেই। তিন দিন আগে মোটা চাল ৫৩ টাকা বিক্রি করেছিলাম, বর্তমান ৫১ বা ৫২ টাকা কেজি হিসেবেও কেনার মতো ক্রেতা নেই। নতুন চাল বাজারে উঠে যাবে, যে কারণে কেউ ভয়ে চাল কিনছেন না। শিগগিরই হয়তো চালের দাম কমে যাবে। তবে যেহেতু আমদানিকৃত চালের বিক্রি নেই, তাই ভারতে চালের দামটাও কমতে পারে।”

হিলি সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এসএম রেজা আহমেদ বিপুল বলেন, “বাংলাদেশে চালের ঘাটতির কারণে সরকার ভারত থেকে চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। হিলি বন্দরসহ বিভিন্ন বন্দর দিয়ে পর্যাপ্ত চাল আমদানি হচ্ছে। তারপরও দাম কমছে না কেন? আমার মনে হয় দেশে বড় একটা সিন্ডিকেট কাজ করছে। যে কারণে বাজারে চালের দাম কমছে না। ভোক্তা অধিকার যদি ঠিকমতো বাজার মনিটরিং করে তাহলে দাম কমতে পারে।”

হিলি স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন শিল্পী বলেন, ‘‘গত ১১ নভেম্বর থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত এই বন্দরে ১৩৩ গাড়িতে ৫ হাজার মেট্রিকটন চাল আমদানি হয়েছে। চালগুলো ৫২ থেকে সাড়ে ৫২ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। ভারতে শুল্ক কমানোর জন্য চালের দাম বৃদ্ধি করে দিয়েছে ভারতের রপ্তানিকারকরা। এই বন্দরে আমদানিকারকদের অনেকেরই চালের এলসি করা আছে। এসব চাল আমদানি হলে দামও অনেকটা কমে যাবে বলে আশা করছি।”

হিলি কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তা শফিউল ইসলাম বলেন, “শুল্কমুক্তভাবে হিলি বন্দরে ৪১০ ডলারে চাল আমদানি হচ্ছে। গত ১১ নভেম্বর থেকে এক সপ্তাহে ৫ হাজার মেট্রিকটন চাল আমদানি হয়েছে এই বন্দরে। যেহেতু চাল একটি নিত্যপণ্য এবং দেশের বাজারে চাহিদা রয়েছে, সেহেতু আমরা কাস্টমসের সকল কার্যক্রম দ্রুত সম্পূর্ণ করে ছাড়করণ করা হচ্ছে।”

ফুলবাড়ীর অটো রাইস মিল (মির্জা গ্রুপের) মালিক নুর আলম মির্জা বলেন, “নতুন ধান উঠেছে, আবার আমদানিকারকরাও ভারত থেকে চাল আমদানি করছেন। কিন্তু চালের দাম কমছে না। ভারতীয় চাল ৫৩ টাকা কেজি পড়ে যাচ্ছে। আবার আমরা মিল মালিকরা নতুন দেশি গুটি স্বর্ণা জাতের ধান প্রায় ৩৪ টাকা কেজি প্রতি কিনছি। এসব ধান থেকে চাল প্রস্তুত করতে ৫১ টাকা কেজি পড়ে যায়। স্বর্ণা-৫ চাল ৫৪ টাকা পরতা পড়ছে। ধানের দাম যদি কম হতো তাহলে আমরা কম দামে বাজারে চাল বিক্রি করতে পারতাম।”

তিনি আরও বলেন, “এ ছাড়াও দেশে অনেক বড় বড় ব্যবসায়ীরা আছেন, যাদের টাকার অভাব নেই। তারা বেশি দামে ধান ক্রয় করে মজুত করে রাখেন। যে কারণে আমরা মিল মালিকরা হিমশিম খাচ্ছি। যদি সরকার এই বিষয়গুলো দেখে তাহলে খুব ভাল হয়।’’

চিরিরবন্দর উপজেলা কৃষি অফিসার মোছা. জোহরা সুলতানা বলেন, “চিরিরবন্দর উপজেলায় এবার ২৩ হাজার ৫৭৮ হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সুগন্ধি চালের ধান আবাদ হয়েছে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। শীতকালীন সবজি চাষের জন্য কৃষক আগাম জাতের ধান চাষ করেছে। কৃষকরা বর্তমানে বাজারে ধানের দাম পাচ্ছেন মণপ্রতি ১২৫০ থেকে ১৩০০ টাকায়। আশা করছি আমন চাষিরা লাভবান হবেন।”

দিনাজপুর কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নুরুজ্জামান বলেন, “চলতি মৌসুমে জেলায় ২ লাখ ৬০ হাজার ৮২০ জমিতে আমন ধান চাষ হয়েছে। ধানের ফলন ভাল হয়েছে। কাটা-মাড়াই শুরু হয়েছে। আশা করছি তাদের কাঙ্ক্ষিত ফসল ঘরে তুলতে পারবে।”