আমনের ভরা মৌসুম চলছে। চালের বাজারে প্রচুর মজুতও রয়েছে। অথচ, বাজারে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। কমেনি শেরপুর বাজারে চালের দাম। বরং চালের এই ভরা মৌসুমে দাম বেড়েছে। এতে অসুবিধায় পড়েছেন সাধারণ ক্রেতারা।
শেরপুরের সবচেয়ে বেশি চিকন ও সুগন্ধি চাল উৎপাদন হয়। গত এক দশকে জেলার হাসকি মিলের এক সিদ্ধ চাল উৎপাদন কমে যাওয়ায় শেরপুরের মানুষ আর শেরপুরের চাল খাচ্ছে না। এমনটাই অভিমত স্থানীয়দের।
শহরের খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে ধানের দাম বেশি থাকায় মিলাররা চালের দাম বাড়িয়ে দেন। ফলে তারা ‘বেশি দামে’ কিনে ‘সামান্য লাভে’ বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে তাদের তেমন কিছু করার নেই। তাদের মতে, অন্যান্য স্থানের তুলনায় শেরপুরের চালের দাম কমই রয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, শেরপুরের চালের বাজার দর দফায় দফায় বৃদ্ধি পেলেও তেমন একটা বাজার মনিটরিং হয়নি। অপরদিকে কৃষকদের ন্যায্য মূল্যে ধান বিক্রির অযুহাতে চালের দাম বাড়িয়েছে স্থানীয় মিলাররা।
শেরপুরে প্রতিবছরই ধান চাষে উদ্বৃত্ত থাকে। বছরে শেরপুরে সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিকটন চাল উৎপাদন হয়। শেরপুরের জন্য বছরে চালের চাহিদা মাত্র ২ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিকটন। ৪ লাখ ২০ হাজার মেট্রিকটন চাল জেলার চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত থাকে, যা দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি করা হয়।
শেরপুরে অটোমেটিক রাইস মিল চালু হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায় হাসকি চাতাল মিল। এই মিলে উৎপাদিত চালের ক্রেতারাই হলেন সাধারণ মানুষ।
অটোমেটিক রাইস মিলে বেশির ভাগ সুগন্ধি চাল তৈরি হয়। প্রস্তুত হওয়ার পর এগুলোর বেশিরভাগই জেলার বাইরে চলে যায়। এসব চালের বাজার শেরপুরে নাই। যে কারণে স্থানীয় বাজারে যে এক সিদ্ধ চাল জেলার বাইরে থেকে আসে। মূলত নওগাঁ, বগুড়া, কুষ্টিয়া, রংপুরসহ উত্তরবঙ্গের চাল দিয়ে শেরপুরের লোকাল মার্কেট দখল হয়ে আছে।
বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত শ্রেণি লোকজন ২৮ অথবা পাইজাম চালের ভাত খায়। সাধারণত মোটাচাল জেলার বাইরে থেকে আসার কারণে শেরপুরে চালের বাজারের নিয়ন্ত্রণ শেরপুরের বড় ব্যবসায়ীদের হাতে নেই বললেই চলে। বাইরে থেকে যারা চাল কিনে আনেন সেসব ব্যবসায়ীদের হাতেই মূলত খুরচা চালের বাজারের নিয়ন্ত্রণ। উত্তরবঙ্গসহ বিভিন্ন এলাকায় চালের বাজার দর বাড়লে, এখানেও তার প্রভাব পড়ে।
শিক্ষক মাছুদুর রহমান বলেন, “আমাদের আয় বাড়েনি। সেখানে যদি লাফিয়ে লাফিয়ে চালের দাম বাড়তে থাকে, আমরা সাধারণ মানুষ কীভাবে চলব? একটু ভালো চালের ভাত খাওয়া তো দূরে থাক, মোটা চালও অনেকের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে।”
ঝগড়ার চর এলাকার ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমনের ভরা মৌসুম চলছে। বাম্পার ফলনও হয়েছে। তারপরও চালের দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই, বরং বাড়ছে। সরকারের এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।”
শহরের চাউলের বড় আড়ৎ মনির এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী রাকিবুল হাসান সজিব বলেন, “আমরা চাল শেরপুরের বাইরে থেকে কিনে এনে বিক্রি করি। মিল মালিকের কাছে চাল কিনতে গেলে তারা বলেন, ধানের দাম বেশি। তাই আমরাও বেশি দামে কিনে আনি। আর এ কারণেই একটু বেশি দামে বেচতেও হয়। তবে শেরপুরের মানুষ যে ধরনের চাল খায়, সেই ধরনের চাল শেরপুরে বেশি বেশি উৎপাদন করা দরকার।”
নয়ানী বাজারের মেসার্স হুমায়রা ও সামিয়া এন্টার প্রাইজের সত্ত্বাধিকারী মো. শুক্কুর আলী বলেন, “প্রতিবছর এ সময় চালের দাম কমে। কিন্তু এবার চালের দাম না কমলেও স্থিতিশীল আছে। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে মুষ্টিমেয় কয়েকটি রাইস মিল মালিক ও মজুদদার দায়ী বলে মনে করছেন পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।”
চাল ব্যবসায়ী মো. শাহ্ আলম মিয়া বলেন, “চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে মজুতদাররাই দায়ী। ছোট ছোট হাসকি মিলগুলো এখন আর চলে না। তাই শেরপুরের চাল বিক্রি করতে না পেরে বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। বাইরের রাইস মিল মালিকরা কম দামে ধান কিনে মজুত করে নানা অজুহাতে চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমাদের বেশি দামে কিনে- আরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।”
শেরপুর জেলার চালের বড় ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম আলহাজ্ব জয়নাল আবেদীন বলেন, “নতুন ধানের আমদানি এখানো পুরোদমে শুরু হয়নি। এক সপ্তাহের মধ্যে বাজার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে আশাকরি। তবে খুচরা বাজার দাম নিয়ে যা তা করছে। খুরচার সাথে পাইকারী দামের কোনো মিল নাই। বর্তমানে চালের দাম আগের চেয়ে প্রায় ১০০ টাকা থেকে ২০০ টাকা বস্তায় কমেছে। তবে খুরচা বাজারে দাম কেন কমছে না এটা বলতে পারব না।”
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) শেরপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হাকিম বাবুল বলেন, “অস্বাভাবিক হারে চালের দাম বাড়ায় কষ্ট বেড়েছে স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষের। এখন ভরা মৌসুমে চালের দাম সবচেয়ে কম থাকার কথা। কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা চাল মজুত করে রাখছে। যে কারণে চালের দাম কমছে না। শেরপুরে সুগন্ধি চাউলের উৎপাদক বেশি হওয়ায় বেশি চাল উৎপাদন করার পরেও বাজারে তার প্রভাব পড়ছে না। বিশেষ করে নওগাঁ, বগুড়া, কুষ্টিয়া, রংপুরসহ যেসব জেলা থেকে যেসব ব্যবসায়ী চাল কিনে আনেন তাদের হাতেই মূল সিন্ডিকেট। এটা শুভঙ্করের একটা ফাঁকি।”
তিনি আরও বলেন, “শেরপুরে উৎপাদিত চালের মধ্যে মধ্যবিত্তরা ২৮, পাইজাম ও নাজির চাল ক্রয় করেন। সাধারণ মানুষ যে মোটা চাল খায়, সেই চালগুলো হাসকি মিলে উৎপাদন কমে যাওয়ায় চাল আমদানি করতে হচ্ছে। ধানের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে উত্তরবঙ্গের ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। হাসকি মিল চালু করতে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। আমরা নিজেরাও বাজার মনিটরিং করছি। ক্রয়মূল্য সংরক্ষণ, মূল্য তালিকা প্রদর্শন হচ্ছে কিনা দেখছি। কোথা থেকে কিনছে, কী দামে কিনছে এটা ফলোআপ করছি। তবে শেরপুরের চাল শেরপুরে উৎপাদন বৃদ্ধিতে একা পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব নয়, সম্মিলিতভাবে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।”
শেরপুর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আরিফুল ইসলাম বলেন, “খাদ্য অধিদপ্তর থেকে নতুন দাম নির্ধারণ করলে আমরা সেই দাম ধরে কাজ করতে পারব। তবে নতুন করে যেন দাম না বাড়ে সেটা নিয়ে বর্তমানে কাজছি।”
শেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক হুমায়ুন আহমেদ বলেন, “শেরপুর জেলা ধান চাষে উদ্বৃত্ত। বছরে শেরপুরে সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিকটন চাল উৎপাদন হয়। তবে শেরপুরে বছরে চাহিদা মাত্র ২ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিকটন চাল। ফলে ৪ লাখ ২০ হাজার মেট্রিকটন চাল জেলার চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত থাকে। এসব চাল দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি করা হয়।”