রাইজিংবিডি স্পেশাল

‘‘মামা গিয়ে দেখে ভাই আর নাই, তখনও তারা বলছে ‘বেঁচে আছে’’ 

রাজধানীর মাতুয়াইলে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিৎ হালদারের মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি। পরিবারের দাবি, চিকিৎসকের ভুলে অভিজিৎ মারা গেছেন। তবে ‘ভুল চিকিৎসা’ বা ‘চিকিৎসায় অবহেলা’র অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। 

মেধাবী এই শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এরই মাঝে ঘটে গেছে অনাকাঙ্খিত ঘটনা। তিন কলেজের শিক্ষার্থীরা জড়িয়েছেন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। এতে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রায় শত কোটি টাকা।

এ দিকে যার মৃত্যু ঘিরে এই তুলকালাম, এমন পরিস্থিতিতে অভিজিতের পরিবারের বক্তব্য জানতে চাইলে তারা শুরুতে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে মোবাইল ফোনে কথা হয় অভিজিতের বোন অপু রানী হালদারের সঙ্গে। অপু ইডেন কলেজের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষার্থী। 

অপু রানী হালদার অভিযোগ করে বলেন, ‘‘আমার একমাত্র ভাই, তাকে কি অত্যাচার করেই না মেরেছে! মুখ বুজে স্বাক্ষর করে ভাইয়ের লাশ নিয়ে চলে এসেছি। আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। বুয়েটে পড়ার স্বপ্ন ছিল অভিজেতের। সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে।’’ 

কল্যাণপুর থাকতেন অভিজিৎ। সেখান থেকে কেন তাকে সদরঘাটে নিয়ে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলো? জানতে চাইলে অপু বলেন, ‘‘আমার বাবা সদরঘাটে থাকেন। আমাদের বাড়ি শরীয়তপুর। সেখানে যাতায়াতে সুবিধা হবে ভেবে ভর্তি করা হয়। নার্সের তত্ত্বাবধানে থেকে ঠিকমত যেন চিকিৎসা হয় এ জন্য ওকে আমরা হাসপাতালে ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নেই।’’

‘‘ডেঙ্গু টেস্টে ওর (অভিজিৎ) প্লাটিলেট আসে এক লাখ ২০ হাজার। হাসপাতালে ভর্তির সময় ছিল এক লাখ ৫ হাজার। শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল, এ জন্য আইসিইউতে নিয়ে যাই। কে জানতো তারা এভাবে আমার ভাইয়ের জান নেবে? আমার ভাই কখনো নেশা করেনি। কিন্তু একজন ডাক্তার এসে বলল, এই রোগীকে কে নিয়ে আসছে? ওকে জুতা দিয়ে পেটাও! হাসপাতালের রেপুটেশন নষ্ট হয়ে যাবে এ কারণে ওরা আমার ভাইকে ছাড়েনি।’’

‘‘দুই দিন আমার ভাই আইসিইউতে ছিল। বাবা-মা, মামার সঙ্গে কথা বলেছে। ১৮ তারিখ থেকে ওর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার কথা বলে। আমার মামা সাইন করে দেয়। এরপর আমরা আর কোনো খবর পাই না। দারোয়ানের কাছ থেকে খবর নিলে বলে- ‘ভালো আছে।’ ডাক্তারের কাছে জানতে চাইলে বলে, ‘আমরা কি বলেছি ভালো আছে? ব্লাড রেডি রাখেন, লাগতে পারে।’ আমরা রেডি রাখি। সারাক্ষণ ইনজেকশন দিয়ে ওকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। সন্ধ্যার সময় ডাক্তার আমাদের ডাকে। মামা গিয়ে দেখে আমার ভাই আর নাই! ওর শরীর ঠান্ডা। তখনও তারা বলে- না বেঁচে আছে!’’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন অপু রানী। 

ফাইনাল এক্সাম থাকায় ভাইয়ের কাছে সবসময় থাকতে পারেননি অপু। অভিজিতের মৃত্যুর পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শুরুতে তার বাবার ওপর দায় চাপাতে চেয়েছিল অভিযোগ করে অপু বলেন, ‘‘তখন আমার বাবা সেখানে ছিলেনই না! অথচ তারা (ডাক্তার) বলে, রোগীর বাবাকে বলা হয়েছে লাঞ্চে পানি জমার কথা। তখন আমার মা বলেন, ‘সিসি ক্যামেরা দেখান। আমার ছেলের সঠিক চিকিৎসা হয়েছে বুঝতে পারলে আমরা নীরবে চলে যাবো।’ এরপর তারা আমাদের ১০ হাজার টাকা অফার করে। আমরা নেইনি।’’

‘‘আর কিছু বলার ভাষা নাই। লাস্ট পর্যায়ে আমার ভাইকে ছেড়ে দিলেও আমরা অন্য জায়গায় চিকিৎসা করাতাম। বাবা অ্যাম্বুলেন্সও নিয়ে এসেছিল। কিন্তু হাসপাতালের রেপুটেশনের কারণে তারা ছাড়েনি।’’ বলেন অপু রানী হালদার। 

অভিজিতের মৃত্যুর পর শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে অপু বলেন, ‘‘অভিজিতের বন্ধুরা যে আন্দোলনে নেমেছে আমরা জানতাম না। পরে জেনেছি। ও ওর বন্ধুদের ভালোবাসা দিয়ে গেছে। ওর বন্ধুরাও ওকে ভালোবাসা দিয়েছে। ভালোবাসার জায়গা থেকেই তারা আন্দোলনে নেমেছে। হামলা-ভাঙচুর কাম্য নয়। এতে সবারই ক্ষতি হচ্ছে। যাকে হারিয়েছি তাকে তো কোনোভাবেই পাবো না। আর এখন যেসব ঘটনা ঘটছে কোনোভাবেই আমরা সেটা সমর্থন করি না।’’

আইনি পদক্ষেপ নেবেন কিনা জানতে চাইলে অপু বলেন, ‘‘মামলা করলে আমার ভাইয়ের পোস্টমর্টেম করতে হবে। তাকে যে অত্যাচার করেছে। আমরা আর তার দেহ কাটাছেঁড়া করতে চাই না। অভিজিৎকে নিয়ে আমাদের পরিবারের যে প্রত্যাশা ছিল তা তো আর পূরণ হবে না।’’

অভিজিৎ হালদারের বন্ধু জয় বলেন, ‘‘অভিজিৎসহ আমরা পাঁচজন কল্যাণপুরে একসঙ্গে থাকতাম। ইবনে সিনা থেকে অভিজিতের ডেঙ্গু টেস্ট করা হয়। পজিটিভ আসে। চিকিৎসক জানায়, হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন নেই। কিন্তু অভিজিতের বাবার পরামর্শেই ওকে হাসপাতোলে ভর্তি করানো হয়। ওরা আগে থেকেই ন্যাশনাল মেডিক্যালে চিকিৎসা নিতো। ১৬ নভেম্বর সকাল ৯টায় ওকে জেনারেল বেডে ভর্তি করানো হয়। একটার দিকে অভিজিতের মা ফোন করে জানান, ওর অবস্থা খারাপ! আইসিইউতে নিয়ে গেছে।’’

‘‘যেদিন ও মারা গেল সেদিন সকাল ৮টার দিকে ওর বাবা ওকে দেখতে যায়। অভিজিৎ তখন বাবার কাছে পানি খেতে চেয়েছিল। কিন্তু ডাক্তার খেতে দেয়নি। বলেছে, তারা পরে খাওয়াবে। সকাল ১১টার দিকে জানায়, অভিজিতকে লাইফ সাপোর্টে নিতে হবে। তখন সেই ব্যবস্থাও করা হয়। সন্ধ্যা ৭টার দিকে ডাক্তার এসে বলে, রোগীর গার্ডিয়ান কে? তখন ওর মামা গিয়ে দেখে শরীর ঠান্ডা। মামা বলে, আমার ভাগ্নে তো নাই! চিকিৎসকরা তখনো বলে, না আছে। পরে আবার বলে, এই মাত্র মারা গেলো! এরপর আমাদের সেখান থেকে তারা বের করে দেয়।’’

‘‘এরপর ২ থেকে ৩ ঘণ্টা ডাক্তারদের আর হদিস পাইনি। হঠাৎ দেখি তিনজন পুলিশ এসেছে সূত্রাপুর থানা থেকে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের নিজেদের রুমে নিয়ে যায়। আমরাও তখন যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু যেতে দেয়নি। একটু পর তারা চলে যায়। তখন আমাদের বলে, লাঞ্চে পানি জমছে, স্ট্রোক করছে, ব্ল্যাডসেল ছিঁড়ে গেছে। অথচ একদিন আগেও কিন্তু সব ঠিক ছিল। একদিনেই কি লাঞ্চে পানি জমলো, স্ট্রোক করলো, ব্ল্যাডসেল ছিঁড়ে গেল?’’ প্রশ্ন জয়ের। 

জয় বলেন, ‘‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অভিজিতের মৃত্যু ধামাচাপা দিতে চাচ্ছে, এটা বুঝতে পেরেই কিন্তু শিক্ষার্থীরা এ ঘটনার তদন্তসহ সুষ্ঠু বিচারের প্রত্যাশায় আন্দোলনে যায়। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কি করল? তারা সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজ থেকে গুন্ডা ভাড়া করে আমাদের ওপর হামলা চালালো। আমরা এ ঘটনার তদন্তসাপেক্ষে সুষ্ঠু বিচার চাই।’’ 

এ দিকে অভিজিতের মৃত্যু নিয়ে সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে বিভ্রান্তিকর ও উস্কানিমূলক তথ্য ছড়ানো হয়েছে বলে দাবি করেছে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল ইন্সটিটিউট হাসপাতাল ও কলেজ কর্তৃপক্ষ।

মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) দুপুরে কলেজের কনফারেন্স রুমে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তেব্যে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. ইফফাত আরা এ দাবি করে বলেন, “এ মৃত্যুর ঘটনায় গত ২০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় মোল্লা কলেজের শিক্ষক এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের উপস্থিতিতে ছাত্ররা নয়টি বিষয় উত্থাপন করেন। ন্যাশনাল মেডিকেল কর্তৃপক্ষ বিশদ আলোচনা ও ব্যাখ্যা প্রদান করলে তারা সন্তুষ্ট হয়ে সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। কিন্তু এ আলোচনার সঠিক তথ্য সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে উপস্থাপন না করে বিভ্রান্তিকর ও উস্কানিমূলক তথ্য ছড়ানো হয়েছে।’’

অভিজিতের মৃত্যুর পর ১০ হাজার টাকা দিয়ে ঘটনা ধামাচাপার বিষয়টিও অস্বীকার করেছে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল ইন্সটিটিউট হাসপাতাল ও কলেজ কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবি, এ টাকা গ্রামের বাড়িতে লাশ পাঠানোর জন্য দিতে চাওয়া হয়েছিল। 

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে হাসপাতালটির উপ-পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মোহাম্মদ রেজাউল হক বলেন, “ অভিজিতের মৃত্যুর সময় আইসিইউ বিল এসেছিল প্রায় ৩৬ হাজার টাকা। তারা বাবা এটা মওকুফের জন্য অনুরোধ করেন। হাসপাতালের বিল সমাজসেবা কার্যালয়ের মাধ্যমে পরবর্তীতে পরিশোধ করা হবে- জানার পর রোগীর সম্পূর্ণ বিল স্থগিত করা হয়। সেদিন রাত ২-৩টা বেজে গিয়েছিল। অভিজিতের লাশ তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর পাঠানোর জন্য অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার জন্য ১০ হাজার টাকার প্রয়োজন ছিল। সেদিন অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার জন্য ওই টাকা দিতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু অভিজিতের বাবা আঞ্জুমান মফিদুলের সঙ্গে যোগাযোগ করে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে। যে কারণে ওই টাকাটা আর লাগেনি।’’

উল্লেখ্য, ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ১৬ নভেম্বর সকালে সদরঘাটের ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি হন ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের (ডিএমআরসি) শিক্ষার্থী অভিজিৎ হালদার। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে প্রথমে আইসিইউতে এবং পরে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ মার্চ সন্ধ্যায় মারা যান অভিজিৎ। 

ভুল চিকিৎসায় অভিজিতের মৃত্যুর তথ্য ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে ডিএমআরসি’র শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা ২১ নভেম্বর ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চেয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ডিএমআরসি’র শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এ সময় সরকারি  শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের ওপর হামলা চালায়। এর প্রতিবাদে ডিএমআরসি’র শিক্ষার্থীরা ‘সুপারসানডে’ নাম দিয়ে ঘেরাও কর্মসূচির ডাক দেয়। ২৪ নভেম্বর দুপুরে তারা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে হামলা চালায়। পরে তারা সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করে। 

২৫ নভেম্বর ভাঙচুরের প্রতিবাদে ‘মেগামানডে’ কর্মসূচি ঘোষণা করে সোহরাওয়ার্দী ও কবি নজরুলের শিক্ষার্থীরা। এ দিন তারা ডিএমআরসি’তে পাল্টা হামলা করে। এ সময় ডিএমআরসি’র শিক্ষার্থীরা প্রতিরোধ গড়ে তুললে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় পুরো এলাকা। বিকাল পর্যন্ত চলে ধাওয়া, পাল্টা-ধাওয়া। পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার ছালেহউদ্দিন গণমাধ্যমে বলেন, ‘‘অন্তত ২৫ হাজার শিক্ষার্থী যাত্রাবাড়ী মোড়ে জড়ো হয় মোল্লা কলেজে হামলার জন্য। আমরা তাদের বারণ করার চেষ্টা করলেও তারা শোনেনি। এরপর তারা ব্যাপক ভাঙচুর করে। এর সঙ্গে এলাকার লোকজনও যোগ দেয়।’’

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সন্ধ্যার আগেই পুরো কলেজের নিয়ন্ত্রণ নেয় সেনাবাহিনী।