রাইজিংবিডি স্পেশাল

‘গোছানো সংসারটা ধ্বংস করে দিয়েছে’

পরিবারের বড় মেয়ে ছিল অরিত্রী অধিকারী। পরিবারকে সব সময় মাতিয়ে রাখত। পরিবারের সব বিষয় নখদর্পণে ছিল তার। মেধাবী ছাত্রী ছিল সে। পড়ত ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। 

নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর সঙ্গে ঘটে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। বার্ষিক পরীক্ষায় মোবাইল ফোন নিয়ে নকল করার অভিযোগ তোলেন শিক্ষকরা। পরীক্ষার হল থেকে বের করে দেওয়া হয় তাকে। মা-বাবাকে ডেকে এনে অপমান করেন শিক্ষকরা। তা সহ্য করতে পারেনি অরিত্রী। পরে নিজ বাসায় তার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরিবারের অভিযোগ, মা-বাবার অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে সে। 

সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখা মেয়েকে হারিয়ে কাঁদছে তার পরিবার ও স্বজনরা। পরিবারের ভাষ্য—তাদের সাজানো-গোছানো সংসার ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

ছয় বছর আগে ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে তার বাবা দিলীপ অধিকারী রাজধানীর পল্টন থানায় মামলা দায়ের করেন। 

মামলা তদন্ত করে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস ও শাখাপ্রধান জিনাত আক্তারকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ২০১৯ সালের ১০ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা (তৎকালীন) জজ রবিউল আলম। সাক্ষ্য গ্রহণও হয়। 

পরে মামলাটি ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ-১২ এর বিচারক আব্দুল্লাহ আল মামুনের আদালতে পাঠানো হয়। গত ২৭ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত রায়ের তারিখ ধার্য করেন। 

রায়ের তারিখ ৬ দফা পেছানো হয়। সর্বশেষ গত ২৫ জুলাই রায় ঘোষণার তারিখে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) পুনরায় মামলা তদন্তের নির্দেশ দেন। মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতি পাওয়া গেছে মর্মে আদেশে উল্লেখ করেন বিচারক।

মামলা সম্পর্কে অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী বলেছেন, “ছয় বছর হলো মেয়েটাকে হারিয়েছি। কিন্তু, যাদের কারণে মেয়েটাকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হলো, তাদের সাজা হলো না। আসামিদের বিচারের জন্য আদালতে লড়াই করেছি। সবার সাক্ষ্য নেওয়া হলো। অবশেষে মামলাটা রায়ের পর্যায়ে এলো। গত বছরের ২১ জানুয়ারি রায়ের তারিখ ছিল। ছয় বার রায়ের তারিখ পিছিয়ে আবার মামলাটি পুনরায় তদন্ত করতে পিবিআইকে দায়িত্ব দিয়েছে। কী কারণে মামলাটা পুনরায় তদন্তে দিল, বুঝতে পারছি না। কী করব, বুঝতে পারছি না। বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারাতে পারি না। তবে আশায় ছিলাম, রায় হলে ন্যায়বিচার পাব। কিন্তু, হলো না।”

তিনি বলেন, “একটা কথা স্পষ্ট, ন্যায়বিচার চাই। মেয়েটার বিরুদ্ধে যে ব্লেম দিয়েছিল, তার সম্পৃক্ততা পাইনি। মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয় মেয়েটাকে। মানসিকভাবে টর্চার করেছে। একজন আসামিকেও ছাড় দেব না। ১৫ বছরের মেয়েটার সাথে কি নিষ্ঠুর আচরণটাই না করেছে! যেসব টিচার এমন আচরণ করেছে, তারা টিচার হওয়ার অধিকার রাখে না। লাইফটা শেষ করে দিয়েছে। আমাদের সাজানো-গোছানো সংসারটা ধ্বংস করে দিয়েছে।”

দিলীপ অধিকারী বলেন, “অরিত্রীর ছোট বোন সব সময় সামনে ছবি নিয়ে বসে থাকে। সব সময় বোন বোন করে। এই শোকে ওর মা স্ট্রোক করেছে। রাতে ঘুমাতে পারি না। সব জায়গায় দেখি যেন অরিত্রী আছে। ও ছিল বড় মেয়ে। বাসাটা ওর হাতেই গোছানো। সব জায়গার ওর ছোঁয়া লেগে আছে। এ কারণে আগের বাসাটা ছেড়ে দিয়েছি। যে রুমে ও সুইসাইড করে, সেই রুমটা দেখলে কান্না আসে। এসব চিত্র দেখে আমরা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলাম। অরিত্রীর মা মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকে। কারো সাথে সেভাবে কথা বলতে চায় না। প্রয়োজন ছাড়া মিশতেও চায় না। অরিত্রীর অনেক বান্ধবী এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। তাদের দেখে ওর মা ভাবে, আমাদের মেয়েটাও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। এভাবে হাসি-খুশি থাকত। আমাদের লাইফটা শেষ হয়ে গেছে। কতদিন এ যন্ত্রণার মধ্যে থাকতে হবে, বুঝতে পারছি না। তবে, আমরা ন্যায়বিচারের আশায় আছি। ন্যায়বিচার চাই।”

অরিত্রীর মা বিউটি অধিকারী বলেন, “অরিত্রী আমাদের প্রথম সন্তান। তার প্রতি আলাদা একটা ভালোবাসা কাজ করে। তাকে হারানোর পর রাতে চোখে ঘুম থাকে না। সব জায়গায় অরিত্রীকে দেখি। আমার মেয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ ছিল, সেটার জন্যই লড়ছি। কিন্তু, এখন পর্যন্ত আমরা বিচার পেলাম না।”

আসামিপক্ষের আইনজীবী মশিউর রহমান বলেন, “মামলাটা রায়ের পর্যায়ে ছিল। আশায় ছিলাম, রায় হবে। আসামিরা সাজা পাবে বা খালাস পাবে। একটা রেজাল্ট তো আসত। আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলাটি পুনরায় পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।”

অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে দণ্ডবিধির ৩০৫ ধারায় মামলা দায়ের করেন। তিনি অভিযোগ করেন, ৩ ডিসেম্বর পরীক্ষা চলাকালে অরিত্রীর কাছে মোবাইল ফোন পান শিক্ষক। মোবাইল ফোনে নকল করেছে, এমন অভিযোগে অরিত্রীকে পরদিন মা-বাবাকে নিয়ে স্কুলে যেতে বলা হয়। দিলীপ অধিকারী স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে ওই দিন স্কুলে গেলে ভাইস প্রিন্সিপাল তাদের অপমান করে কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। মেয়ের টিসি নিয়ে যেতে বলেন। পরে প্রিন্সিপালের কক্ষে গেলে তিনিও একই রকম আচরণ করেন। এ সময় অরিত্রী দ্রুত প্রিন্সিপালের কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়। পরে শান্তিনগরের বাসায় গিয়ে তিনি দেখেন, অরিত্রী তার কক্ষে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়নায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় ঝুলছে। তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।

মামলায় তিনজনকে আসামি করা হয়। মামলা দায়েরের পর ৫ ডিসেম্বর শ্রেণি শিক্ষক হাসনা হেনাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরের দিন আদালত জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পরে ৯ ডিসেম্বর জামিন পান হাসনা হেনা। ১৪ জানুয়ারি নাজনীন ফেরদৌস ও জিনাত আক্তার আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন।

২০১৯ সালের ২০ মার্চ নাজনীন ফেরদৌস ও জিনাত আক্তারকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক কামরুল হাসান তালুকদার। শ্রেণিশিক্ষক হাসনা হেনাকে অভিযুক্ত করার মতো সাক্ষ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় তার অব্যাহতির আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

নির্দয় ব্যবহার ও অশিক্ষকসুলভ আচরণের কারণে অরিত্রী আত্মহত্যায় প্ররোচিত হয় বলে চার্জশিটে উল্লেখ করেন তদন্ত কর্মকর্তা।