এক-দুই বছর নয়, দেখতে দেখতে কেটে গেছে ১১ বছর। তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়, তবে ছয় খুনের মামলায় তদন্ত শেষ হয় না। বিচারের আশায় এখনো অপেক্ষা করছে নিহতদের পরিবারগুলো। কিন্তু, কবে বিচার পাবেন তারা, বলতে পারছেন না কেউ।
২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর গোপীবাগে নিজ বাসায় কথিত পীর লুৎফর রহমান ফারুকসহ ছয় জন খুন হন। সেই ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। কবে নাগাদ শেষ হবে, নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। দীর্ঘদিনেও মামলার তদন্ত শেষ না হওয়ায় হতাশ নিহতদের স্বজনরা। তবে, এখনো বিচারের আশায় বুক বেঁধে আছেন তারা।
ছয় জনকে খুনের ঘটনায় লুৎফর রহমান ফারুকের ছেলে আব্দুল্লাহ আল ফারুক ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর ওয়ারী থানায় মামলা দায়ের করেন। থানা পুলিশ, ডিবির হাত ঘুরে মামলাটির তদন্তভার এখন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের হাতে। প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এ পর্যন্ত ১৩৫ বার সময় নিয়েছে বিভিন্ন তদন্ত সংস্থা।
সর্বশেষ গত ১৮ ডিসেম্বর এ মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ ধার্য ছিল। কিন্তু, ওই দিনও কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। এজন্য ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আওলাদ হোসাইন মুহাম্মদ জোনাইদের আদালত আগামী ১৫ জানুয়ারি প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে। কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না যে, এখন কে এই মামলা তদন্ত করছেন।
এর আগের তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন কাউন্টার টেরোরিজম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের পরিদর্শক মোহাম্মদ শফিকুল আলম। তিনি বলেছেন, “ছয় মাস আগে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আমার এক পা ভেঙে যায়। এরপর আর মামলার খোঁজ-খবর নেওয়া হয়নি। শুনেছি, নজরুল ইসলাম নামের এক উপ-পরিদর্শক মামলার তদন্তভার নিয়েছেন। ৫ আগস্টের পরে আবারও নাকি তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে। এত দিনে তদন্ত শেষ হওয়ার মুখে। আমি থাকা অবস্থায় তদন্তে অনেক অগ্রগতি হয়েছিল। ক্লুলেস এ মামলায় বাদীর বড় ভাইয়ের স্ত্রী এক আসামিকে শনাক্তও করেছিলেন। আশা করছি, খুব দ্রুতই চার্জশিট জমা হবে।”
এ বিষয়ে মামলার বাদী আব্দুল্লাহ আল ফারুক বলেছেন,“তদন্ত কর্মকর্তা চেঞ্জ হয়। তদন্ত আর শেষ হয় না। এত সংখ্যক তদন্ত কর্মকর্তা অন্য মামলায় চেঞ্জ হয়েছে কি না, জানা নেই। তদন্ত সংস্থা সলিউশন পাচ্ছে না। যারা গ্রেপ্তার হয়েছে, তারা ঘটনার সাথে জড়িত কি না, শিউর না। সরাসরি দেখা কেউ তো নেই।”
তিনি বলেন,‘আমাদের মামলাটা তো রাজনৈতিক নয় যে তদন্ত শেষ হবে না। তদন্ত সংস্থা বলছে, সাধ্যমতো চেষ্টা করছে। কিন্তু, শেষ তো হচ্ছে না। বাবাকে হারিয়েছি, ভাইকে হারিয়েছি। আর যে চারজন খুন হয়েছে, তারাও ছিলেন ভাইয়ের মতো। আমাদের ফ্যামিলিটা নিঃশেষ হয়ে গেছে। ১১টা বছর হয়ে গেছে। তবু আশায় আছি, সুষ্ঠু তদন্ত হোক। দোষীরা সাজা পাক। এত বছর হওয়ার পরও আশা ছাড়িনি। দুনিয়াতে শাস্তি না পেলে যতদিন পরে হোক, আল্লাহ তাদের শাস্তি দেবেন। আমাদের প্রত্যাশা, মামলার সুষ্ঠু তদন্ত হোক। প্রকৃত দোষীরা সাজা পাক। নিরপরাধ কেউ যেন সাজা না পায়। আমরা বিচার চাই।”
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, লুৎফর রহমান ফারুক পীর ছিলেন। তার অনেক মুরিদ ছিলেন, যারা বাসায় যাতায়াত করতেন। লুৎফর রহমান ফারুক নিজেকে ইমাম মাহদীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে দাবি করতেন। তার ধর্মীয় মতাদর্শের সঙ্গে প্রচলিত ধর্মীয় মতাদর্শের পার্থক্য ছিল। এ কারণে আগেও লুৎফর রহমানের ওপর হামলা চালানো হয়েছিল।
২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর মাগরিবের নামাজের আগে ১০-১২ জন লোক ধর্মীয় বিষয়ে জানার জন্য এসেছেন বলে জানান। লুৎফর রহমান ফারুক সবাইকে দরবার ঘরে বসতে দিয়ে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য মুরিদ শাহিনকে বাজারে পাঠান। সন্ধ্যা ৬টার দিকে লুৎফর রহমান ফারুক, তার বড় ছেলে সরোয়ার ইসলাম ফারুক, মুরিদ শাহিন, মজিবুর, মঞ্জুরুল আলম, রাসেল ভূইয়াকে মুখে স্কচটেপ দিয়ে মুখ আটকিয়ে, হাত-পা বেঁধে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। একই সময়ে আসামিরা লুৎফর রহমান ফারুকের আত্মীয় আনোয়ার মিস্ত্রি ও অন্য একজন মুরিদকে হাত-পা-মুখ বেঁধে দরবার রুমে ফেলে রাখেন। ঘটনার সময় আসামিদের একজন বলেন, ওনার (লুৎফর রহমান ফারুক) আরেক ছেলে আছে আবদুল্লাহ। আবদুল্লাহ কোথায়? এরপর লুৎফর রহমান ফারুকের স্ত্রী ও তার পুত্রবধূর কাছে আসামিরা বলে যান, এই ছয় জনকে মারার অর্ডার ছিল, ছয় জনকে মারছি। তোরা যদি পুলিশ কিংবা মিডিয়ার কাছে মুখ খুলিস, তাহলে তোদের অবস্থাও ওদের মতো হবে।”
এ মামলায় এখন পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলেন—হাদিসুর রহমান সাগর, জাহিদুল ইসলাম, মামুনুর রশীদ রিপন, আব্দুল গাফ্ফার, তরিকুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর হোসেন, রফিকুল ইসলাম, সৈয়দ জিয়াউল ইসলাম ওরফে জিতু ওরফে নিরব ওরফে নিয়ন ওরফে হিমু, আবু রায়হান ওরফে মাহমুদ ওরফে আব্দুল হাদী, আব্দুল্লাহ আল তাসনিম, মো. গোলাম সরোয়ার, মো. আল আমিন ও আজমির অমিত। তাদের মধ্যে প্রথম সাত জন কারাগারে আছেন। মো. আলামিন পলাতক। অপর পাঁচ আসামি জামিনে আছেন।
আসামি জিয়াউল ইসলাম ও আল আমিনের আইনজীবী মোহাম্মদ জাকির হোসাইন বলেছেন, “মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা প্রতিবেদন জমা দিতে ব্যর্থ। এর ফলে আদালতের সময় অপচয় হচ্ছে। আমরাও চাই, মামলার প্রতিবেদন দ্রুত জমা হোক। দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকার কারণে আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষ উভয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “আমার দুই মক্কেলকে দুই দফায় ৬ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ডে কোনো তথ্যই উদ্ধার হয়নি। এই আসামিদের বিরুদ্ধে আগে রমনা থানায় তিনটা জঙ্গি মামলায় থাকায় এ মামলায় তাদের জড়ানো হয়। তবে, ওই তিন মামলায় আসামিরা নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। আশা করি, এই মামলায় তারা খালাস পাবেন।”