খেলাধুলা

ফ্লাইং শিখ: দৌড়ে অমরত্বের স্বীকৃতি

জীবনের ট্র্যাকে শেষ রেসটা দৌড়ে ফেললেন ‘ফ্লাইং শিখ।’ মিলখা সিং থামলেন ৯১ এর ঘরে। কাঁটা বিছানো একেকটি পথ পেরিয়ে তিনি নেমেছিলেন অ্যাথলেটিক্সের ট্র্যাকে। যেখানে তিনি একমাত্র রাজা।

শুধু দেশসেরা-ই হননি, এশিয়ার পুরস্কার, কমনওয়েলথের পুরস্কার জিতে ভারতের তেরাঙ্গা উড়িয়েছেন বিশ্ব দরবারে। অলিম্পিকে চতুর্থ হওয়ার কীর্তিও তাঁর নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে। জীবনের কঠিনতম একেকটি অধ্যায় দাপিয়ে বেড়িয়ে, বিরুদ্ধ সময় কাটিয়ে, স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। কতশত অর্জনে ঝুলি ভারী করেছেন। শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে পেয়েছেন অমরত্বের স্বীকৃতি।

সেই তাকেই কেড়ে নিল করোনা। করোনামুক্তির পর কিংবদন্তী অ্যাথলিট গুরুতর অসুস্থ হয়ে ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে। সেখান থেকে আর ফিরে আসেননি। এক সপ্তাহ আগে তাঁর স্ত্রী নির্মল কৌড়ও কোভিডোত্তর জটিলতায় মারা যান।

 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রয়াত এই অ্যাথলেটকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে টুইট করেছেন। মিলখা সিংকে স্বাধীন ভারতের প্রথম ক্রীড়াবিদ হিসাবে আখ্যায়িত করে মোদী লেখেন, ‘মিলখা সিংয়ের মৃত্যুতে আমরা একজন কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদকে হারালাম, যিনি তার ক্রীড়ার মাধ্যমে পুরো জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষাকে নিজের মাঝে ধারণ করেছিলেন। তিনি অগণিত ভারতীয়দের হৃদয়ে বিশেষ স্থান জুড়ে আছেন। তার অনুপ্রেরণামূলক ব্যক্তিত্ব তাকে বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে প্রিয় করে তুলেছিল। তাঁর মৃত্যুতে আমি ব্যথিত।’

মিলখা সিং অবিভক্ত ভারতের মুলতান প্রদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ দেশ ভাগের সময়ে ভারত-পাকিস্তান আলাদা হলে তার বাবা-মা এবং সাত ভাইবোনকে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর পূর্বে ছেলেকে বাঁচাতে তার বাবার শেষ কথা ছিল ‘ভাগ মিলখা ভাগ।’

বাবার বলা শেষ কথাটিই মিলখাকে জীবনে দৌড়বিদ হতে জেদ তৈরি করেছে। পরবর্তীতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হয়ে দক্ষ দৌড়বিদ হয়ে ওঠেন তিনি। প্রথম তিনবারে ব্যর্থ। চতুর্থবার দিয়ে সুযোগ পান সেনাবাহিনীতে।

মিলখা সিং, তার খেলোয়াড়ি জীবনে চারটি এশিয়ান গোল্ড মেডেল ও আন্তর্জাতিক দৌড়ের প্রতিযোগিতায় পাঁচটি গোল্ড মেডেল জিতেছেন। ১৯৫৮ সালে কার্ডিফের কমনওয়েলথ গেমসে স্বর্ণ জেতেন এবং রোম অলিম্পিকের ৪০০ মিটারে চতুর্থ স্থান অর্জন করেছিলেন।

১৯৫৯ সালে তার ৮০টি আন্তর্জাতিক দৌড়ের মধ্যে ৭৭ টিতে জয়ের জন্য তিনি হেলস ওয়ার্ল্ড ট্রফি অর্জন করেন। ১৯৬০ সালে, পাকিস্তানের লাহোরে একটি আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিক প্রতিযোগিতায় ২০০ মিটার ইভেন্টে অংশ নিতে মিলখাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে ভারতে যাওয়ার পরে তিনি পাকিস্তানে ফিরে আসেননি।

 

 

আমন্ত্রিত হবার পর শুরুতে যেতে অস্বীকার জানিয়েছিলেন। তবে তিনি শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী, পাকিস্তানের আব্দুল খালিকের স্টেডিয়ামে বিপুল সমর্থন থাকা সত্ত্বেও মিলখা সেই প্রতিযোগিতাটি জিতেছিলেন। তার অভুতপুর্ব দৌড়ের দৃশ্য দেখে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি জেনারেল আইয়ুব খান তাকে তাকে ‘ফ্লাইং শিখ’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

খেলোয়াড়ি জীবনে মিলখা কখনও অলিম্পিক পদক জেতেননি। তার সারাজীবনের একমাত্র ইচ্ছা ছিল ভারতের হয়ে কেউ সেই পদক জিতুক। বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে মিলখা জানিয়েছিলেন, তিনি প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা দৌড়ের প্র্যাকটিস করতেন।

তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আমাদের সময়ে বর্তমান সময়ের মত এত কিছু ছিল না। সেই দিনগুলোতে ক্রীড়াবিদরা খুব বেশি অর্থ উপার্জন করতেন না। আমরা দেশের জন্য খেলেছি, জনগণের প্রশংসাই আমাদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।‘

তার জীবনের উপর ভিত্তি করে ২০১৩ সালে ভারতে ‘ভাগ মিলখা ভাগ’ নামে সিনেমা বানানো হয়েছিলো যেখানে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে দর্শকদের বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন অভিনেতা ফারহান আক্তার। সিনেমা মুক্তির পর মিলখা জানান, তার জীবনের গল্প পরবর্তী প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করবে।