বার্সেলোনায় কতশত ট্রফিই তো ছুঁয়ে দেখেছেন লিওনেল মেসি। রেকর্ড সংখ্যক ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট আর ব্যালন ডি’অরও জেতা হয়ে গেছে। আর্জেন্টিনার হয়েও সবচেয়ে বেশি গোল তার, খেলেছেন রেকর্ড ম্যাচ। জাদুকরী ড্রিবলিং আর ফ্রি কিকে তাক লাগাতে পারেন, তার বাঁ পা তো একবার চেয়েই বসেছিলেন তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। তাকে সর্বকালের সেরা ফুটবলার তো বলাই যায়, নাকি! না, নিন্দুকরা একটি জায়গায় তার শ্রেষ্ঠত্ব আটকে দিয়েছেন। আর্জেন্টিনার জার্সিতে একটি ট্রফি!
সেটা জিতলেই ভিনগ্রহের এই ফুটবলার হয়ে যাবেন বিশ্বের সর্বকালের সেরা। আর সেই সুযোগ আরও একবার পেয়ে গেলেন মেসি। অনেক প্রহর গুনে আরেকবার ফাইনালের মঞ্চে। কোপা আমেরিকার ফাইনাল, প্রতিপক্ষ আর্জেন্টিনার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিল। এই শতাব্দীর সেরা ফাইনাল বললেও বোধহয় ভুল হবে না। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা মুখোমুখি নামছে, এটাই তো বিশাল একটা ব্যাপার। সেখানে শিরোপার লড়াই, তাও আবার মেসির জীবনের একমাত্র আক্ষেপ ঘুচানোর! বেজে উঠেছে যুদ্ধের ডামাডোল। রাত পোহালেই মারাকানায় নামবে হলুদ আর আকাশী-নীল জার্সিধারীরা।
আগেও চারটি ফাইনাল খেলেছেন মেসি, কোপাতেই তিনবার। ২০০৭ সালে প্রথমবার। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই হুয়ান রিকুয়েলমে, হাভিয়ের জানেত্তি ও ভেরনের মতো তারকাখচিত দলের হয়ে ব্রাজিলের মুখোমুখি হয়েছিলেন মেসি। তখনও তিনি আকাশের উজ্জ্বলতর নক্ষত্র হয়ে ওঠেননি। আর্জেন্টিনার জার্সি পরেছেন দুই বছর হলো। ওইবার জিতলেই তো আক্ষেপ কেটে যেতো, কিন্তু পারেনি তারা। হুলিও বাপতিস্তা ও রবিনহোর ব্রাজিলের কাছে ৩-০ গোলে উড়ে গিয়েছিল। তাতে শিরোপা খরা থেকে যায় ১০ বছরের। এটা বাড়তে বাড়তে গিয়ে এখন ঠেকেছে ২৮ বছরে।
ভেনেজুয়েলার ওই কোপা ফাইনালের পর মেসিকে ঘিরে আর্জেন্টিনা একটি শিরোপার স্বপ্ন দেখতে থাকে। এলএমটেন যতই বার্সেলোনায় উড়তে থাকেন, সেই স্বপ্নটা আরও বড় হতে থাকে। ন্যু ক্যাম্পে একের পর এক শিরোপা আর রেকর্ড তখন তার পায়ের নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কিন্তু আর্জেন্টিনাকে এনে দিতে পারেননি একটি শিরোপাও।
আর্জেন্টিনার মানুষরা যতই শিরোপার জন্য পিপাসার্ত হয়ে ওঠেন, মেসির ওপর চাপও যেন বাড়তে থাকে। এই প্রত্যাশার বোঝা কাঁধে নিয়ে ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে তোলেন। করেছিলেন চার গোল। মিনেইরোতে আগের ম্যাচে ব্রাজিলকে উড়িয়ে দেওয়া জার্মানিকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রুখে দিয়েছিল মেসির দল। কিন্তু গোলমুখের সামনে তার ও গনসালো হিগুয়েইনের একেকটি ভুল কাঁটা হয়ে বিঁধেছিল বুকে। অতিরিক্ত সময়ে গিয়ে হঠাৎ মারিও গোৎসের চমৎকার ভলি, তাতে আলবিসেলেস্তের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার। পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে ট্রফির পাশ দিয়ে মেসির মাথা নিচু করে হেঁটে যাওয়ার ছবি এখনও কষ্ট দেয় ভক্তদের। টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার গোল্ডেন বল হাতেও বিষাদের ছায়া ছিল তার চেহারায়।
ওই আক্ষেপ আরও দুইবার পরপর কাটানোর সুযোগ পেয়েছিলেন মেসি। বিশ্বকাপে হেরে যাওয়ার ক্ষতে প্রলেপ দেওয়া যেতো পরের বছরই। ২০১৫ সালের কোপা আমেরিকায়। স্যান্টিয়াগোর ফাইনালে চিলির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল আর্জেন্টিনা। নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ের খেলা গোলশূন্য ড্র হলে টাইব্রেকারে গড়ায়। মেসি প্রথম শট জালে পাঠালেও হিগুয়েইন ও বানেগা মিস করেন। মারাকানার ক্ষত শুকাতে না শুকাতে তা দগদগে হয়ে ওঠে।
যাই হোক, মেসিকে আরেকবার সুযোগ করে দেয় ভাগ্যদেবতা। পরের বছর আবারও কোপার ফাইনালে। মর্যাদাপূর্ণ টুর্নামেন্টেট শতবার্ষিকীতে এই বিশ্বসেরা ফুটবলার ট্রফিতে হাতছোঁয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। আবারও ফাইনাল, আবারও চিলি। পাঁচ গোল করে উড়ছিলেন মেসি। টানা দুটি ফাইনালে ব্যর্থতা যেন জেকে বসেছিল তার ওপর। নয়তো টাইব্রেকারে কেন ওভাবে ক্রসবারের ওপর দিয়ে মারলেন! এবারও হেরে গেলো আর্জেন্টিনা। কান্নায় বুক ভাসালেন, এমনকি অবসরও নিয়ে ফেলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবারও ফেরানো হয়েছে।
পাঁচ বছর পেরিয়ে আরেকটি ফাইনাল, মেসির পঞ্চম। বয়স ৩৪ হয়ে গেছে। হয়তো খেলবেন সামনের কাতার বিশ্বকাপও। কিন্তু বিশ্বসেরা হতে একটি শিরোপার জন্য এটাই মেসির শেষ সুযোগ মনে করা হচ্ছে। এবার আছেন দুর্দান্ত ফর্মেও। আর্জেন্টিনার ১১ গোলের মধ্যে ৯টিতে তার অবদান, গোল চারটি, অ্যাসিস্ট পাঁচটি। কী অসামান্য দলগত প্রচেষ্টা! সব কিছু তো বলছে এবার জিতবেনই মেসি। তাহলেই তো সর্বকালের সেরা হওয়া নিয়ে আর প্রশ্নবিদ্ধ হবেন না। তারপরও কিন্তু… তবুও… থেকে যাচ্ছে। আশায় বুক বেঁধে বসে থাকতে তো আর সমস্যা নেই। কারণ এবার তিনি গোটা বিশ্বকে সঙ্গে পাচ্ছেন। এমনকি তার শত্রুরাও চাইছেন একটি আন্তর্জাতিক ট্রফি তার হাতে উঠুক। মেসি হাতে নিতে পারবেন তো শত সাধনার একটি ট্রফি?