ভারতের বেশ জনপ্রিয় ক্রিকেট প্রতিযোগিতা আইপিএলের আদলে গড়া ভারতের প্রো-কাবাডি লিগ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে খেলোয়াড়রা এ লিগে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশও তাদের মধ্যে অন্যতম। এবারের আসরে বাংলাদেশ থেকে অংশগ্রহণ করবেন তিন খেলোয়াড়। তবে নিলামে ছিলেন আটজন। এদের মধ্যে তুহিন তরফদার, মাসুদ করিম ও জিয়াউর রহমানকে কিনে নিয়েছে প্রো-কাবাডির তিন দল।
ডিফেন্ডার তুহিন তরফদারকে ১০ লাখ রুপি দিয়ে কিনেছে তামিল তালাইভাস। সর্বশেষ আসরের মতো এবারও ১০ লাখ রুপি দিয়ে রেইডার মাসুদ করিমকে কিনেছে ইউপি যোদ্ধা। আর জিয়াউর রহমানের ঠিকানা বেঙ্গালুরু বুলসে। এই ডিফেন্ডারের পারিশ্রমিক ১২ লাখ ২০ হাজার রুপি।
পেশাদার কাবাডি লিগ প্রো-কাবাডির এটি অষ্টম আসর। আগামী ডিসেম্বরে হবে টুর্নামেন্টের অষ্টম আসর। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের আসরটি আয়োজন সম্ভব হয়নি। এবারের আসরটি হওয়ার কথা ছিল জুন-জুলাইয়ে। কিন্তু পিছিয়ে গেছে শেষ পর্যন্ত। এবারের নিলামে দল পাওয়া তিন খেলোয়াড়েরই প্রো কাবাডিতে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালে মুম্বাইয়ের ইউ মুম্বাইয়ে খেলেছেন তুহিন। জিয়াউর খেলেছেন কলকাতার বেঙ্গল ওয়ারিয়র্সে, ২০১৮ সালে। আর মাসুদকে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে দলে নিয়েছিল মুম্বাইয়ের ইউ মুম্বাই।
গত মার্চে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক প্রীতি কাবাডি টুর্নামেন্ট। পাঁচ দেশের ওই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। দেশকে শিরোপা জয়ে বড় ভূমিকা রাখার সুবাদে নিলামে ডাক পেয়ে যান তুহিন, মাসুদ ও জিয়া। সেই সঙ্গে আসন্ন প্রো-কাবাডি লিগে নিজেদের সেরাটা দিয়ে পারফর্ম করতে মুখিয়ে আছেন নিলামে দল পাওয়া বাংলাদেশের এ ত্রিরত্ন।
চলুন পাঠক; এখন তাহলে আপনাদেরকে বাংলাদেশে কাবাডি জাতীয় দলের এই ত্রিরত্ন সম্পর্কে জানা যাক। তাদের জীবনের গল্প, কাবাডিতে উঠে আসার অজানা গল্প শুনুন তাহলে-
প্রথম টুর্নামেন্টে মাত্র ২০ টাকা পান তুহিন তরফদার
কাবাডিতে এ পযার্য়ে আসার পেছনে অনেকটা চড়াই-উতরাই পাড়ি দিতে হয়েছে। বাগেরহাটের কচুয়ায় জন্মগ্রহণ করা তুহিন ছোটবেলা থেকে বেশ ভালো ফুটবল খেলতেন। বৃষ্টির মৌসুমে বৃষ্টি ভেজা মাঠে গ্রামের সবাই মিলে আয়োজন করতেন হা-ডু-ডু খেলার। বলা যায়, ছোট থেকেই তুহিন ফুটবলের পাশাপাশি হা-ডু-ডু যথেষ্ট ভালো খেলতেন। তবে তার বাবা কখনোই চাইতেন না ছেলে হা-ডু-ডু খেলুক। বাবার চোঁখ ফাঁকি দিয়ে তুহিন এলাকার বিভিন্ন জায়গায় হা-ডু-ডু খেলে বেড়াতেন। এমনকি খেলা চলা অবস্থায় বাবাকে দেখলে দৌড়ে পালাতেন তিনি।
এই হা-ডু-ডুতে তুহিন বাংলাদেশের প্রায় ৬৪ জেলার ৫৫ থেকে ৫৬ জেলায় খেলেছেন। ক্যারিয়ারের প্রথম টুর্নামেন্টে পেয়েছিলেন মাত্র ২০ টাকা। শুরুতে বাগেরহাটের কচুয়ায় নিজ গ্রামে খেলতেন। এরপর আশপাশের বিভিন্ন ইউনিয়ন ও জেলায় নাম ছড়িয়ে পড়ে তার। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় এক টুর্নামেন্টে খেলে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পারিশ্রমিক পাওয়ার রেকর্ডও আছে তার। একবার জয়পুরহাটে এক টুর্নামেন্ট ছিল, সেখানে আন্তর্জাতিক কোচ আব্দুল জলিল স্যার অতিথি হিসেবে আসেন। মূলত তুহিনের খেলা দেখেই আব্দুল জলিল নৌবাহিনীর কোচকে তার কথা জানান। তারপরের গল্পটা তো যেন শুধুই তুহিনের।
এরপর তুহিনকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। নৌবাহিনীতে তার ডাক আসে। আর এই চাকরির সুবাদে ২০১৫ সালে জাতীয় দলে তার অভিষেক ঘটে যায়। প্রো-কাবাডি ছাড়া শুধু বিভিন্ন জেলা পর্যায়ের টুর্নামেন্ট খেলেই এ পর্যন্ত আয় করেছেন তিনি ৪০ লাখ টাকার মতো। খেলোয়াড় হিসেবে চাকরি করে ব্যাংকে জমিয়েছেন আরও ৪০ লাখ। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে খ্যাপ খেলতেন। এলাকার সবাই ডাকতেন ‘খ্যাপ মাস্টার’ বলে। আর কাবাডি খেলার সুবাদেই তুহিনের চাকরি হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে। সেই সঙ্গে কাবাডি খেলার সুবাদেই যেন বদলে গেল তুহিন তরফদারের জীবন।
হাত-পা ভেঙে যাওয়ার শঙ্কায় কাবাডি ছাড়তে চেয়েছিলেন মাসুদ করিম
স্ত্রী আর পাঁচ সন্তানের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো মাসুদ করিমের কৃষক বাবা ফজলুর রহমানকে। ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করা বাংলাদেশ জাতীয় কাবাডি দলের খেলোয়াড় তার সংসারের সেই অসচ্ছ্বলতা দূর করেছেন কাবাডি খেলেই। হালুয়াঘাটের বাড়িতে টিনের ঘরের জায়গায় করেছেন পাকা দালান। ময়মনসিংহ শহরে জমি কিনেছেন। ছোট ভাইকে পড়াশোনা করিয়েছেন। সেই ভাই এখন চাকরি করছেন বাংলাদেশ পুলিশে।
মাসুদ কখনোই ছোট থেকে খেলাধুলার জগতে আসতে চাননি। খেলতে গিয়ে হাত-পা ভেঙে যেতে পারে, সেই আশঙ্কায় মা–বাবা ফুটবলে লাথি দিতেও নিষেধ করতেন। তার স্কুল-কলেজ জীবনে কোনোদিন কাবাডি খেলা হয়নি । ২০০৮ সালে বাংলাদেশ পুলিশে চাকুরি হওয়ার পরে গোপীরঞ্জন তালুকদার স্যারের হাত ধরেই তার কাবাডিতে আসা। তার উচ্চতা দেখে পুলিশ দলের সাবেক কোচ আশরাফুল দুলু কাবাডি দলে নিয়ে আসেন তাকে। একবার খেলায় জোর করে খেলতে নামিয়ে দিয়েছিল তাকে। আশরাফুল বলেছিলেন, ‘তুমি বেশ লম্বা আছ। সেই সঙ্গে তোমার শরীরের গঠনও বেশ ভালো আছে।’ এ বলেই মাসুদকে খেলতে নামিয়ে দেন তিনি।
তারপর বেশ কয়েকদিন খেলার পর মাসুদ কোচকে বলেন, তিনি আর কাবাডি খেলবেন না। কারণ এ খেলায় হাত-পা ভাঙে। এ কথা বলার পর তিনি মাসুদকে ৭ দিনের জন্য ছুটি দেন। পরে তিনি ভেবে দেখেন কিছুটা চেষ্টা করতে ক্ষতি কী! এরপর আস্তে আস্তে কাবাডিতে আসা তার।
জাতীয় দলে মাসুদের যাত্রা শুরু হয় ২০১৩ সালে। আন্তবাহিনীর টুর্নামেন্টে ভালো করায় ডাক পান ২০১৪ সালের এশিয়ান গেমসের দলে। অথচ তখনো তার পরিবারের লোকজন জানতেন না তার খেলোয়াড়ি পরিচয়, টিভিতে জাতীয় দলের তালিকায় মাসুদের নাম দেখে প্রথমবার মা–বাবা জানতে পারেন, তিনি জাতীয় দলের হয়ে কাবাডি খেলেন।
মাশরাফিকে অনুপ্রেরণা মানেন জিয়াউর রহমান
জিয়াউরের গল্পটা বেশ ভিন্ন। বাংলাদেশের হয়ে এশিয়ান গেমস কাবাডিতে ২০০৬ সালে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন জিয়া। কুড়িগ্রামের এই ছেলের কাবাডিতে আসার আগে সবসময় খেলা হতো ফুটবল। কিন্তু নৌবাহিনীতে যোগদানের পরই মূলত কাবাডিতে আসা হয় তার। তার কাবাডি খেলায় আসা মূলত ২০১৪ সালে।
প্রথমে তিনি বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে চাকরি করতেন। ট্রেনিং করার সময় সেখানে ইউনিটভিত্তিক কাবাডি লিগ অনুষ্ঠিত হতো। তিনি যে ইউনিটে ছিলেন সেখান থেকে একটি দলকে অংশগ্রহণ করতে হবে। সেই দলে খেলার জন্য তার ডাক আসে। সেখানে ভালো খেলার সুবাদে নৌবাহিনীর প্রধান কোচের নজড়ে পড়ে যান জিয়া।
নৌবাহিনীতে আসার পর কোচ আব্দুল জলিল তাকে বেশ ভালোভাবে কাবাডির প্রশিক্ষণ দেন। তারপর তিনি জাতীয় দলে আসেন। ২০১৬ সালে কাবাডি বিশ্বকাপ দিয়েই তার জাতীয় দলে কাবাডি খেলা শুরু হয়। বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের সাবেক ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজাকে নিজের বড় অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখেন তিনি। মাশরাফি তার কাছের বন্ধু ও ভাইয়ের মতো।
জিয়া বলেছেন, ‘মাশরাফি ভাই দারুণ মানুষ। আমরা যখন বাংলাদেশে কাবাডির জাতীয় শিবিরে, তখন তিনি এসেছিলেন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। সেটাই প্রথম আলাপ। সেদিন আমার সঙ্গে দাবা খেলেছিলেন উনি। এত সফল খেলোয়াড়, কিন্তু একবিন্দু অহংকার নেই। খুব সহজে মিশে যেতে পারেন সবার সঙ্গে। তারপর অনেকবার কথা হয়েছে তার সঙ্গে।’
একজন খেলোয়াড় হিসেবে কাবাডি খেলে যা যা পাওয়া সম্ভব এ দেশে তার প্রায় সবই পেয়েছেন জিয়া।
তুহিন, মাসুদ, জিয়া; তাদের এ সাফল্যের পেছনে যে কাবাডি ফেডারেশনের ভূমিকা নেহাত কম নয়; সেটার কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কার্পণ্য নেই কারও। ফেডারেশনকে ধন্যবাদ জানিয়ে তারা বলেন, ‘আসলে আগে ফেডারেশনের যে অবস্থা ছিল, তাতে এখানে আসা কখনোই সম্ভব হতো না। তবে বর্তমানে ফেডারেশনে যে কমিটি আছে তারা যেভাবে আগাচ্ছে তাতে আমরা বলব কাবাডিতে আমাদের অনেক কিছুই করা সম্ভব। সব থেকে বড় কথা না বললেই নয়, হাবিব স্যার-মোজাম্মেল স্যার আছেন এখানে। উনাদের আন্তরিকতায় এটা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে কাবাডি ফেডারেশনের এত বড় বিল্ডিং আমরা দেখব, তা আমরা কখনোই আশা করতাম না। কিন্তু ফেডারেশনের বর্তমান কমিটি সেটিকে সম্ভব করে দেখিয়েছে। এমনকি তারা আমাদের ট্রেনিংয়েরও ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। কাবাডির বর্তমান এ উন্নতিকে আমরা ফেডারেশনের অক্লান্ত পরিশ্রম হিসেবেই দেখছি। ফেডারেশন কর্তাদের পরিশ্রমেই কাবাডির উন্নতি হচ্ছে বলে মনে করি আমরা এবং বাকি খেলোয়াড়রা।’
তাছাড়াও তারা মনে করেন, ফেডারেশনের কল্যাণে তারা একজন আন্তর্জাতিক মানের ফিটনেস ট্রেনার নিয়ে কাজ করতে পারছেন। সেই সঙ্গে জিম ব্যবহারও শুরু করতে পেরেছেন। ট্রেনার থাকায় এখন ইনজুরি থেকে সেরে ওঠার সময় সঠিক দিক নির্দেশনা পাচ্ছেন তারা। এছাড়াও সেক্রেটারি ও জয়েন্ট সেক্রেটারি ফান্ডিংয়েরও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন সব খেলোয়াড়দের জন্য।
প্রো কাবাডি লিগ অনেকটা আইপিএলের মতো। পিকেএলে (প্রো কাবাডি লিগ) অনেক ধরনের খেলোয়াড়রাই খেলবেন সেখানে। প্রত্যেকটা দেশ থেকে বাছাই করা ভালো খেলোয়াড়রাই খেলতে যাবেন। সেখানে খেলার সুযোগ পাওয়াটা আসলেই বড় ভাগ্যের ব্যাপার হিসেবেই দেখছেন জাতীয় দলের এ তিন কাবাডি খেলোয়াড়। সেখানে তারা চাচ্ছেন নিজেদের পারফরম্যান্স দেখিয়ে সেরাটা দিয়ে খেলার। আর সেখানে খেলে ভালো কিছু শিখবেন বলে আশাবাদী তারা। বিদেশি যারা ভালো খেলোয়াড় আছেন, তাদের দুর্বল পয়েন্ট জেনে এসে দেশের জন্য কাজে লাগিয়ে সামনে যে এশিয়ান গেমস আছে তাতে ভালো করবেন বলে বেশ আত্মবিশ্বাসী তুহিন, মাসুদ ও জিয়া। সেই সঙ্গে বিশ্বকাপের মতেকা মঞ্চেও বাংলাদেশ দলের হয়ে পদক নিয়ে আসবেন বলে যথেষ্ট আশাবাদী তারা। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত কাবাডির সর্বশেষ বিশ্বকাপে তৃতীয় হয়েছিল বাংলাদেশ।
এ কাবাডিতেই যেন নিজেদের জীবনের সব আনন্দ খুঁজে পান তারা। ক্যারিয়ার শেষে নিজেদেরকে দেখতে চান কোচিং ক্যারিয়ারে। এমনকি নিজেদের একটি একাডেমি করারও স্বপ্ন দেখেন। সেই সঙ্গে তাদের তিনজনেরই চাওয়া, যাতে ভারতের প্রো-কাবাডি লিগের মত যেন দেশেও এমন কাবাডি লিগের আয়োজন করা হয়, তাহলে আমাদের দেশের কাবাডির রূপটাই বদলে যাবে এবং আরও ভালোমানের খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে।