নিল ওয়াগনারের বল লিটন কখনো ডাক করছেন, কখনো জোনে পেয়ে পুল করছেন। যেটা পুল করছেন সেটায় কখনো এক রান পাচ্ছেন। নয়তো গ্যাপে গিয়ে চার। লং লেগ, ডিপ স্কয়ার লেগ ও ফাইন লেগে ফিল্ডার রেখে তাকে আটকানোর কত-ই না চেষ্টা। কিন্তু তার মাঝ ব্যাটে যে বল লাগছে সেটা থামানোর সুযোগই কারো ছিল না।
শুধু ওয়াগনার কেন, ট্রেন্ট বোল্টকে এক ওভারে ৪ চার মেরে যে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন লিটন, তা উপভোগ করেননি কে? নিউ জিল্যান্ড, ইংল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের ধারাভাষ্য বরাবরই আবেগপ্রবণ, উল্লাসে ভরপুর ও ছন্দ ধরে রাখার অনুপম মিশ্রণ।
লিটনের একেকটি শটে, একেকটি বাউন্ডারিতে ধারাভাষ্য থেকে যে স্তুতি ছড়িয়েছে তা শেষ একটা জায়গা গিয়ে থেমেছিল, ‘লিটন শুধু চমৎকার ক্রিকেটারই নয়। সে জানে কী করতে যাচ্ছে। এক কথায় এমনটা দেখতে পাওয়া দারুণ।’
কোনো ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরি করলে তা বরারবই বিশেষ কিছু হয়। কিন্তু লিটনের সেঞ্চুরি মানে বিশেষ কিছু। উইকেটের চারপাশে মুগ্ধতা ছড়ানো শট। প্রতিপক্ষের বোলারদের চোখে চোখ রেখে কথা বলা। প্রতি আক্রমণে বোলিং আক্রমণ এলোমেলো করে দেওয়া। ২২ গজে তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায় নান্দনিক সব শটে।
বলা হয় একজন শিল্পী ক্যানভাসে নিজের মতো করে তুলির আঁচড় ছড়ান। নিজের কল্পনা করা একটি শিল্প ফুটিয়ে তোলেন মনের মতো করে। ২২ গজে লিটন সেই শিল্পী। নিজের দিনে যেভাবে চান সেভাবেই রান তুলতে পারেন। নিজের মতো বোলারদের শাসন করতে পারেন।
ক্রাইস্টচার্চে তার সামনে ছিল বর্তমান সময়ের সেরা পেস চতুষ্টয়। টিম সাউদি, ওয়াগনার, ট্রেন্ট বোল্ট ও কাইল জেমিসন। তাদের মাটিতে তাদের সামনে বিরুদ্ধ কন্ডিশনে রান তোলা সহজ কথা নয়। কিন্তু লিটনের ব্যাটিং দেখলে কে বলবে কন্ডিশন সেখানে বিরুদ্ধ ছিল। প্রতিপক্ষের বোলাররা ছিলেন বিশ্বসেরা।
অন ড্রাইভ, স্কয়ার কাট কিংবা পুল যতগুলো খেলেছেন, প্রত্যেকটি স্কোরিং। তাই তো ১০২ রানের ঝকঝকে ইনিংসে বাউন্ডারির সংখ্যা ১৪টি। একমাত্র ছক্কাটি তো চোখ ধাঁধানো। জেমিনসনের বাউন্সারে আপার কাট করে বল পাঠান বাউন্ডারিতে।
তার সেঞ্চুরিতে বড় অবদান রেখেছেন নুরুল হাসান সোহান। দুজনের ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে আসে ১০১ রান। লিটন সেঞ্চুরির সম্ভাবনা তখনই দেখা দেয়। সোহান বিদায় নিলে লিটন প্রায় একাই হয়ে পড়েন। কারণ মিরাজ নিজের উইকেট উপহার দিয়ে আসেন জেমিনসনকে।
তবুও বিচলিত হন না লিটন। ওয়াগনারকে ৮১ রানে থেকে দুটি চার হাঁকান। একটি পুল করে। আরেকটি এগিয়ে এসে কভারের উপর দিয়ে। পরের ওভারে জেমিসনের প্রথম দুই বলে দুটি ডাবলস। তৃতীয় বল কিপারের মাথার উপর দিয়ে চার। ওই চারে লিটনের রান ৯৮ তে।
ইনিংসের এমন মুহূর্তে নিজেকে স্থির রাখা কঠিন। অবসাদ কাজ করে। কিন্তু লিটনের বুঝি কিছুই কাজ করল না। জেমিসনের পরের বল ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে পাঠিয়ে ২ রান নিয়ে তিন অঙ্কের ম্যাজিকাল ফিগার স্পর্শ করেন। সাদা পোশাকে তার দ্বিতীয় সেঞ্চুরি।
লিটন সাদা পোশাকে কতটা ধারাবাহিক তা একটি পরিসংখ্যান দিলে বোঝা যাবে। সবশেষ ৭ ইনিংসে দুটি সেঞ্চুরি, দুটি হাফ সেঞ্চুরি তার। এছাড়া একটি ৪৫ ও একটি ৮ ও ৬ রানের ইনিংস রয়েছে। সব মিলিয়ে তার গড় ৬০। ভাবা যায়?
লিটনের ব্যাটিংয়ের আকর্ষণীয় দিন স্ট্রাইক রোটেট ও শট খেলতে পারার দক্ষতা। ৬৯ বলে ছুঁয়েছিলেন ফিফটি। পরের ৩৭ বলে তার রান সেঞ্চুরিতে। ম্যাচ পরিস্থিতি বিবেচনায় ফিফটির পর দ্রুত রান তোলা দরকার ছিল। সেভাবেই এগিয়েছে তার রান। আবার ফিফটির আগে জুটি গড়েছিলেন সোহানের সঙ্গে। সেখানে টিকে থাকাই ছিল একমাত্র লক্ষ্য।
ক্রাইস্টচার্চে ইনিংস ব্যবধানে হেরেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সঙ্গী করেছে হতশ্রী ব্যাটিং ও দুঃসহ হারের যন্ত্রণা। তবে লিটনের সেঞ্চুরি নিশ্চিতভাবেই কিছুটা প্রশান্তি দিচ্ছে। যে প্রশান্তি বার্তাও দিচ্ছে, উপরের সারির ব্যাটসম্যানরা একটু দায়িত্ব নিয়ে খেললে ম্যাচটা বাঁচানোও যেত।