খেলাধুলা

বাংলাদেশের ক্রিকেটের নতুন ফ্রন্ট জয় 

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দুর্গম দুর্গ দক্ষিণ আফ্রিকায় স্বাগতিক দলের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ ২-১ ব্যবধানে জয়, বাংলাদেশ আরো একটি অজেয় ফ্রন্ট জয় করল। সেঞ্চুরিয়নে সুপারস্পোর্টস পার্কে ৩৮ রানে জিতে ২০ বছরের জয়খরা কাটিয়ে শুরু করেছিল তামিম বাহিনী। জোহানেসবার্গের ওয়ান্ডারার্সে ৭ উইকেটের পরাজয়ে দুইদিনেই চাঁদের দুপিঠ দেখে ফেলার পর সুপারস্পোর্টস পার্কে ৯ উইকেটের দাপুটে জয়ে ক্রিকেট ইতিহাসে নতুন পাতা জুড়ে দিলো। 

এই প্রথম বাংলাদেশ বিদেশ সফরে কোনো শক্তিশালী দেশের পূর্ণ শক্তির দলের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয় করল। দুই দলের সাম্প্রতিক অবস্থান, বিশেষ করে দুর্ধর্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা দলের সাম্প্রতিক ফর্মের বিবেচনায় অনেকেই এই অনন্য অর্জনকে আলাদা মর্যাদা দিতে কার্পণ্য করবেন না। ভাবতে অবাক লাগে এই দলটি কিছু দিন আগে শক্তিধর ভারতকে ওয়ানডে সিরিজে ধবলধোলাই করেছিল।

যদি শুধু ওয়ানডে সিরিজের কথা বলি, তাহলে কিন্তু দুই দলের খেলোয়াড়দের পারস্পরিক তুলনায় ক্রিকেট বিজ্ঞজনেরা বাংলাদেশকে বড় জোর কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে স্বীকৃতি  দিতো। তামিম, সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহর মতো বিশ্বমানের অভিজ্ঞ খেলোয়াড় দলে থাকায় ভালো কিছুর বিশ্বাস ছিল। কিন্তু এভাবে প্রথম ও শেষ ম্যাচ দুটি একচেটিয়া খেলে সিরিজ জয় করবে, সেটি কিন্তু খুব কম মানুষের ধারণায় ছিল। কিন্তু শরীরী ভাষা, নিবেদন সব কিছুতেই দলটি ছিল বদলে যাওয়া ইউনিট। জানি না তিন জন দক্ষিণ আফ্রিকান বিশেষত অ্যালান ডোনাল্ড ও আলবি মর্কেলের পরশ পাথরের ছোঁয়ায় দলটি বদলে গেল। 

সিরিজ জুড়ে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস ছিল। এমনকি দ্বিতীয় ম্যাচটিতে ৩৫ রানে ৫ উইকেট হারিয়েও আফিফ-মিরাজের ব্যাটিংয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। দলের সবার মাঝে জয়ের ক্ষুধা দৃশ্যমান ছিল। তামিম ছিলেন নিজের ছন্দে, লিটন এখন ম্যাচের পর ম্যাচ উন্নয়নের ধারায়।  কথিত অবসাদগ্রস্ত সাকিব তো প্রথম ম্যাচটিতেই নিজের জাত নতুন করে চিনিয়ে দেন। দলের নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান মুশফিক ব্যাটিংয়ে ছন্দে না থাকলেও উইকেটকিপিং করেছে স্বকীয় দক্ষতায়। নবীন ইয়াসির একটি ভালো ইনিংস খেলেছেন। আফিফ চমৎকার খেলে দলে নিজের অবস্থান মজবুত করেছেন। মাহমুদউল্লাহ ধারাবাহিক ছিলেন, মেহেদী হাসান মিরাজ ব্যাটিং-বোলিংয়ে অবদান রেখেছেন। তাসকিন সিরিজ জুড়েই দুর্দান্ত বোলিং করেছেন। শেষ ম্যাচে একাই ধসিয়ে দিয়েছেন প্রতিপক্ষকে। শরীফুল ধারাবাহিক ছিলেন। 

মোটকথা বাংলাদেশের সিরিজ জয়ে সবাই নিজেদের অবস্থান থেকে অবদান রেখেছেন। ফিল্ডিংয়েও উন্নতির ছাপ ছিল। শরীরী ভাষায় ‘আমরাও পারি’ মনোভাব ছিল। সিরিজ জয়ে ক্রিকেট বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে জয়ী হওয়ার আত্মবিশ্বাসের উন্মেষ ঘটাল।

এবার আসি সিরিজ বিশ্লেষণে। প্রথম ম্যাচে তামিম-লিটনের কৌশলী ব্যাটিং দলের বিশাল স্কোরের ভিত গড়ে দিয়েছিল। সেই ভিতের ওপর নির্ভর করে সাকিব, ইয়াসির দলকে ৩১৪ রানের পর্বত চূড়ায় নিয়ে যান। ছোট অথচ কার্যকরী অবদান রেখেছিলেন রিয়াদ, আফিফ ও মিরাজ। শরীফুল, তাসকিন, মিরাজের কার্যকরী বোলিং দলকে ৩৮ রানের জয় এনে দিয়েছিল। 

আগেই বলেছি দ্বিতীয় ম্যাচে পেস-বাউন্সি উইকেটে খেই হারিয়ে ফেলেছিল বাংলাদেশের টপ অর্ডার। ধস নামিয়েছিলেন তুখোড় রাবাদা। তবুও ৩৫ রানে ৫ উইকেট হারানোর অবস্থান থেকে দল ঘুরে দাঁড়িয়েছিল আফিফ, রিয়াদ ও মিরাজের দৃঢ়তায়। কিন্তু ১৯৪ রানের পুঁজি যথেষ্ট ছিল না। ওই ধরনের উইকেটে নিয়মিত খেলার অভিজ্ঞতা না থাকায় বাংলাদেশের বোলাররা মানিয়ে নিতে পারেননি। ৭ উইকেটের সহজ জয়ে ঘুরে দাঁড়ায় দক্ষিণ আফ্রিকা। 

শেষ ম্যাচটি সেই সেঞ্চুরিয়নে থাকায় কিছুটা ভরসা ছিল। তামিম টস হেরে যাওয়ায় হয়তো খেলা ভাগ্য সহায় হয়েছে। ওরা তেড়েফুঁড়ে শুরু করলেও তাসকিনের আগ্রাসী বোলিংয়ের সামনে তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়ে। সঙ্গে সাকিবের মিতব্যয়ী বোলিং এবং দলের উদ্দীপ্ত ফিল্ডিং দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস ১৫৪ রানে শেষ করে দিলো। অথচ বিশেষজ্ঞ ভাষ্যকারদের কেউ ব্যাটিং ধসের জন্য উইকেটকে দায়ী করেননি। আর যদি তাই হতো তাহলে রাবাদা, এনগিডি কেন সুবিধা আদায় করতে পারলেন না! 

বেশ কিছু দিন পর তামিম নিজের ছন্দে অপূর্ব অপরাজিত ৮৭ রানের ইনিংস উপহার দিলেন। লিটনের আত্মবিশ্বাসী ৪৮ রান এবং ওদের যোগাযোগে ১২৭ রানের নতুন মাইলফলক স্থাপন করল। হেসেখেলে ৯ উইকেটে ম্যাচ জয় করে দক্ষিণ আফ্রিকায় নতুন ইতিহাস রচনা করল বাংলাদেশ। 

তুখোড় ফর্মে থাকা এমন একটি শক্তিধর দলকে তাদের আঙিনায় হারিয়ে সিরিজ জয় বাংলাদেশকে আরো সাফল্যের আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছে নিঃসন্দেহে। অচিরেই শুরু দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে নিশ্চিতভাবে এই আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলন দেখতে পাবো বলে বিশ্বাস। বাংলাদেশকে নবীন প্রবীণের মণিকাঞ্চনযোগে অনেক পরিণত দল বলে মনে হচ্ছে। ধাবাহিকতা আসবে বলে মনে করার যথেষ্ট উপকরণ ছিল এই সিরিজ থেকে প্রাপ্য।

লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ক্রিকেট বিশ্লেষক।