কেরোসিন নেই। রান্নাঘরে জ্বলছে না চুলো। ফিশিংবোট নিয়ে জেলের সমুদ্রে যাওয়ার উপায়ও নেই। ইঞ্জিন নৌকার জ্বালানি কই? পেট্রোল পাম্পের সামনে গাড়ি, ট্যাক্সির লম্বা সারি। রেশনিং করে অল্পস্বল্প জ্বালানি মিলছে। তাও প্রতি ফোঁটার হিসাব রাখতে হচ্ছে।
চরম অর্থনৈতিক মন্দায় পুরো শ্রীলঙ্কা। মুদ্রাস্ফীতি অস্বাভাবিক। দ্রব্যমূল্যের দাম আকাশচুম্বী। ডিম-আলু কিনে মামুলি তরকারি রান্নার জন্যও দ্বিতীয়বার ভাবতে হচ্ছে গৃহকর্তাকে। গোটা দেশ অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলায় বিপর্যস্ত। শ্রীলঙ্কান ৩৬০ রুপির সমান এখন ১ মার্কিন ডলার।
এই শ্রীলঙ্কা আর হাসে না। হাসতে ভুলে গিয়েছিল। সেই শ্রীলঙ্কা রোববার রাতে হাসলো আনন্দের হাসি। সাফল্যের হাসি। ক্রিকেট জয়ের হাসি। এশিয়া কাপের এই ট্রফি জয় শ্রীলঙ্কার চলতি রাজনৈতিক সঙ্কট বা অর্থনৈতিক মন্দা দুর করবে না। কিন্তু যা দেবে তার নাম কষ্টের দিনে একটু হাসি। রক্তঝরা ঠোঁটের কোণে এক চিলতে আনন্দের স্বস্তি। ক্রিকেট মাঠে এগারো জনের একটা দল, চরম সঙ্কটে থাকা পুরো দেশের মানুষের মধ্যে ক্ষণিকের জন্য হলেও আনন্দ হাসি এনে দিতে পেরেছে; শ্রীলঙ্কার এশিয়া কাপ জয় সেই স্পিরিট জেতারই গল্প। গর্বের অংশ।
মাঠে জেতা এই শ্রীলঙ্কান খেলোয়াড়রা কেউ কিন্তু টুর্নামেন্ট শুরুর আগে হম্বিতম্বি করে আসেননি। কিন্তু মাঠে কীভাবে লড়তে হয়, জিততে হয়; জেতার জেদ দেখাতে হয়— সেই চেষ্টাই তারা করেছে প্রতিটি ম্যাচে। তাই তারা আজ হাসছে। মাশরাফি ঠিকই বলেছেন— ‘সিংহকে প্রতিদিন চিৎকার করে বলতে হয় না যে আমিই বনের রাজা। সে শুধু মনে মনে ভাবে আমিই বনের রাজা। ব্যস, এটুকুই তার জন্য যথেষ্ট’।
পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে শ্রীলঙ্কা দারুণ উজ্জীবিত ঐক্যবদ্ধ একটা দল হিসেবে লড়ে। অর্থনৈতিক কারণে এই প্রথম ক্রিকেট বিশ্বে কোনও দেশ নিজ মাটিতে টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে পারলো না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ বা রাজনৈতিক সঙ্কট, নিরাপত্তা ইস্যুতে এর আগে কোনও আয়োজক দেশের ভেন্যু বদলের ঘটনা ঘটলেও; শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণে এই প্রথমবারের মতো এটা ঘটলো। অর্থনৈতিক সক্ষমতা নেই, এই কারণে নিজ মাটিতে টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে পারছে না এটা কোনও দেশের জন্য অনেক বেদনাদায়ক একটা বিষয়। এই অক্ষমতা অনেক কষ্টকরও বটে। যে শ্রীলঙ্কা বিশ্বকাপের আয়োজন করেছে সেই দেশ এশিয়া কাপের মতো একটা আঞ্চলিক টুর্নামেন্টের আয়োজন করতে পারছে না। কারণ তাদের জ্বালানি নেই। পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ নেই। আর্থিক সঙ্গতি নেই। আয়োজক হলেও তাদের এখন দূরদেশের মাটিতে গিয়ে খেলতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে অন্য কোনও দল হলে হয়তো মানসিকভাবে ভেঙে পড়তো। কিন্তু শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দল এই কঠিন পরিস্থিতিতে পুড়ে ছারখার হলো না। খাঁটি সোনা হয়ে উঠলো। শপথ নিলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। আর কোনও দল যখন একজোট হয়ে লড়াইয়ে নামে তখন তাদের কেউ দমিয়ে রাখতে পারে না।
টুর্নামেন্টের শুরুটা হলো তাদের হার দিয়ে। আফগানিস্তানের কাছে সেই হারে তারা মুষড়ে পড়েনি। নিজেদের ভুলগুলো বরং শুধরে নিলো। ফলাফল পরের পাঁচ ম্যাচেই জয়! গ্রুপপর্বে বাংলাদেশের সঙ্গে ক্লোজ ম্যাচটা তাদের জোস আরও বাড়ালো। নিজেদের শক্তিমত্তা সম্পর্কে পুরোদস্তুর একটি ধারণা পেল তারা। সেই ম্যাচের আগে তাদের শুনতে হলো বাংলাদেশ শিবির থেকে বলা হচ্ছে ‘শ্রীলঙ্কার এই দলে কোনও তারকা খেলোয়াড় নেই। বিশ্বমানের কোনও বোলার নেই’। এইসব কথার লড়াইয়ের প্রতিটি শব্দ শুনলো তারা। কিন্তু জবাব দেওয়ার জন্য জায়গা হিসেবে বেছে নিলো ২২ গজের মাঠের মঞ্চকে। কারণ তারা জানতো সংবাদ সম্মেলনে এসে আপনি কথা বলে হয়তো নিজেকে জাহির করতে পারেন, কিন্তু ম্যাচ জেতাতে পারবেন না। ম্যাচ জেতাতে হলে মাঠের পারফরম্যান্সই আসল। তাই ম্যাচ শুরুর আগে প্রতিপক্ষের প্রতিটি অবহেলা শ্রীলঙ্কার এই দলটিকে আরও বেশি তাঁতিয়ে দিলো। বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে হবে— এমন একটা জোস তাদের জাগিয়ে তুলল। সেই থেকে সব ম্যাচের প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপে শ্রীলঙ্কা সেই সাহসের গানই গাইল কণ্ঠ ছেড়ে। যখন দল বিপদে পড়লো, প্রতি ম্যাচেই কেউ না কেউ ঠিকই দাঁড়িয়ে গেলো। লড়লো বুক চিতিয়ে। গ্রাউন্ড ফিল্ডিং, ক্যাচিং, ব্যাটিং এবং বোলিংয়ে নিজেকে মেলে ধরার যে স্পিরিট তারা দেখালো সেটা শুধুমাত্র ক্রিকেটীয় কোচিংয়ের কাগজ-কলমের ফর্মুলা নয়। স্কিলের সঙ্গে হৃদয় আবেগ এবং মস্তিষ্কের যোগ এই শ্রীলঙ্কা দলকে অপরাজেয় শক্তিমান করে তুললো।
এই মানসিক দৃঢ়তাই তাদের পুরো টুর্নামেন্টে একটা বিশ্বাস এনে দিল, আমরা যে কাউকে হারাতে পারি। জিততে জানি, পারি। সেই শক্তিতেই শ্রীলঙ্কা দেখিয়ে দিল তাদের হয়তোবা বিশ্বমানের কোনও বোলার নেই, কিন্তু বিশ্বমানের একটা দল ঠিকই আছে। তারা একজন দুজনের দল নয়। তারা সত্যিকার অর্থেই একতাই বল!
মাইকেল জর্ডান তাই বলে গেছেন, ‘প্রতিভা আপনাকে ম্যাচ জেতাবে, কিন্তু টিমওয়ার্ক ও বুদ্ধিমত্তা চ্যাম্পিয়নশিপ এনে দেবে।’
প্রতিভা, টিমওয়ার্ক ও বুদ্ধিমত্তা— এবারের এশিয়া কাপে এই তিন খাতেই বাংলাদেশ দল ব্যর্থ। আর এই তিন বিভাগেই শ্রীলঙ্কা দারুণ সফল। তাই তারা চ্যাম্পিয়ন। আর আমরা আরেকবার টি-টোয়েন্টির প্রাথমিকের হোমওয়ার্ক কষছি।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, রাইজিংবিডি ও ক্রিকেট বিশ্লেষক।