খেলাধুলা

ম্যারাডোনাকে মনে পড়ে, মন পোড়ে 

দিনটা ছিল বুধবার, ২৫ নভেম্বর ২০২০। এমন এক খবর ব্রেকিং হলো, যা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না বিশ্বের কেউ। ফুটবল ঈশ্বর ডিয়েগো ম্যারাডোনা চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আর কখনও, কোনোদিন তার মুখ থেকে শোনা যাবে না ‘বেফাঁস ও ঝাঁঝালো’ কথা। অদ্ভুত কাণ্ড করে তুলবেন না বিতর্কের ঝড়। তাকে যারা ঘৃণা করেন, তাদেরও হৃদয়ও যেন নাড়া দিয়ে উঠেছিল মৃত্যুসংবাদে। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে পরলোকে পাড়ি জমান আর্জেন্টিনার ফুটবল কিংবদন্তি। 

যে মাসে মৃত্যু হলো ম্যারাডোনার, সেই মাসে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হন। তারও আগে কয়েক বছর ধরে স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। পাকস্থলিতে রক্তক্ষরণের কারণে ২০১৯ সালের শুরুর দিকে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল তাকে। সবশেষ নিজের ৮০তম জন্মদিনে আর্জেন্টাইন ক্লাব জিমন্যাসিয়ার ডাগআউট থেকে অসুস্থ হন, ২ নভেম্বর ভর্তি হন হাসপাতালে, ধরা পড়ে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ। অস্ত্রোপচার করা হয়, সুস্থ অবস্থায় বাড়ি ফেরেন তিনি ১২ নভেম্বর। ঘুণাক্ষরেও কেউ ভাবতে পারেননি বাসায় ফেরার দুই সপ্তাহ পর ম্যারাডোনা চিরজীবনের জন্য ঘুমিয়ে যাবেন। তার এই অপ্রত্যাশিত বিদায় হতভম্ব করেছিল গোটা বিশ্বকে।

কী এক সংগ্রামের জীবন পার করেছিলেন ম্যারাডোনা! দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত পরিবারে চার কন্যার পর প্রথম ছেলে এসেছিল চিতোরো ও ডোনা তোতার ঘর আলো করে। মাত্র তিন বছর বয়সে একটি ফুটবল উপহার পান, গোল চামড়ার বলের প্রতি নিজেকে এতটাই সপে দেন যে কিংবদন্তির আসনে জায়গা করে নেন। পাড়ার ক্লাব এস্ত্রেল্লা রোজার হয়ে খেলার সময় একটি ট্যালেন্ট স্কাউট ৮ বছর বয়সী ম্যারাডোনার প্রতিভা আবিষ্কার করেন এবং বুয়েন্স আয়ার্সের আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সে নাম লেখান। ১৯৭৬ সালে ১৬তম জন্মদিনের ১০ দিন আগে পেশাদার ক্লাব ক্যারিয়ার শুরু হয় দলটির সঙ্গে। পরের বছর অভিষেক আন্তর্জাতিক ফুটবলে। নজর কাড়া পারফরম্যান্স করলেও কোচ সিজার লুইস মেনোত্তির গড়া ১৯৭৮ বিশ্বকাপ দলে জায়গা করে নিতে পারেননি শুধু বয়স কম হওয়ার কারণে। পরের বছর ১৮ বছর বয়সী ম্যারাডোনা জাপানে একাই জেতান ফিফা যুব চ্যাম্পিয়নশিপ, ফাইনালে সোভিয়েত ইউনিয়নকে হারানোর পথে ছয় ম্যাচে করেন ৬ গোল। ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় যুব বিশ্বকাপে তার পারফরম্যান্স নিয়ে ৩০ বছর পর ফিফার সাবেক প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটার বলেছিলেন, ‘দিয়েগো আর্মান্ডো ম্যারাডোনাকে নিয়ে প্রত্যেকেরই মতামত আছে। তার খেলার দিনগুলো থেকেই এটা একটা আলোচনার বিষয়। আমার সবচেয়ে প্রাণবন্ত স্মৃতি তাকে নিয়ে ১৯৭৯ সালের ফিফা যুব বিশ্বকাপে, কী অসাধারণ প্রতিভাবান শিশু। যখনই সে বল পাচ্ছিল, তখন প্রত্যেকের মুখ হা হয়ে যাচ্ছিল।’

ছোটদের বিশ্বকাপ মাতিয়ে ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপ দলে ম্যারাডোনা জায়গা পান ট্রফি ধরে রাখার মিশনে। পূরণ করতে পারেননি প্রত্যাশা। আগের আসরের চ্যাম্পিয়নরা বেলজিয়ামের কাছে হার দিয়ে শুরু করে। হাঙ্গেরি ও এল সালভাদরকে হারিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠলেও অভিজ্ঞ ও তারুণ্যের সংঘর্ষ তৈরি করে অন্তর্কলহ। পাঁচ ম্যাচের সবগুলোতে খেলেন ম্যারাডোনা, ছিলেন মূল একাদশে। প্রতি ম্যাচেই তাকে বোতলবন্দি করে রেখেছিল প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডাররা, ফাউলও হয়েছেন বারবার। বাজে রেফারিং ও সহিংস ফাউলের কারণে নকআউটের আলোচিত ব্রাজিল ম্যাচে মেজাজ ধরে রাখতে পারেননি ম্যারাডোনা, বাতিস্তাকে গুরুতর ফাউল করে খেলা শেষ হওয়ার পাঁচ মিনিট আগে লাল কার্ড দেখেন।

চার বছর পর মেক্সিকো বিশ্বকাপ তো ম্যারাডোনাকে নিয়ে গেলো অনন্য উচ্চতায়, তাও অধিনায়ক হিসেবে। ওই এক বিশ্বকাপ দিয়েই ‘ঈশ্বর’ হিসেবে ফুটবলে আবির্ভাব হয় তার। পাঁচ গোল ও পাঁচ অ্যাসিস্ট করেছেন প্রত্যেক ম্যাচের পুরোটা সময় খেলে। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হাত দিয়ে গোল করে ‘হ্যান্ড অব গড’ শব্দযুগল তৈরি করেন। এই গোলের কারণে শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে যেন প্রশ্ন না ওঠে, সেজন্যই হয়তো ওই গোলের চার মিনিট পর করেন ‘শতাব্দি সেরা গোল’। যুক্তরাজ্য ও আর্জেন্টিনার ফকল্যান্ড যুদ্ধ এতটাই তাঁতিয়ে দিয়েছিল ম্যারাডোনাকে, যে কোনও কিছুই দমাতে পারেনি তাকে। ম্যাচ শেষে তাকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘আজ যেন একটি ফুটবল দলের বিপক্ষে নয়, দেশের বিপক্ষে যুদ্ধ জিতলাম।’ শেষ পর্যন্ত ২০০৫ সালের ২২ আগস্ট একটি টেলিভিশন শোয়ে ম্যারাডোনা স্বীকার করেন ইচ্ছা করেই হাত দিয়ে গোল করেছিলেন, তার মাথার সঙ্গে বলের কোনও সংযোগই ছিল না।       

সেমিফাইনালে বেলজিয়ামের বিপক্ষে অপ্রতিরোধ্য ম্যারাডোনা করেন দুটি গোল। ফাইনালে পশ্চিম জার্মানি তাকে ডাবল মার্কিং করলে গোল পেতে কষ্ট হয়েছিল। তবে হোর্হে বুরুচাগাকে দিয়ে জয়সূচক গোলে শেষ পাসটি দেন তিনিই। ৩-২ গোলে জার্মানদের হারিয়ে ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরেন ম্যারাডোনা।

১৯৯০ সালে ইতালি বিশ্বকাপেও দলকে নেতৃত্ব দিয়ে ফাইনালে তোলেন ম্যারাডোনা। কিন্তু চার বছর আগের সেই দাপট দেখাতে পারেননি। গোড়ালির ইনজুরি তাকে খোলসে পুরে রেখেছিল। সেরা তিন খেলোয়াড়ও ছিলেন না। কষ্টেসৃষ্টে শিরোপা নির্ধারণী মঞ্চে উঠলেও ৮৫তম পেনাল্টিতে পশ্চিম জার্মানির কাছে ১-০ গোলে হেরে যায় আর্জেন্টিনা। আশির দশকের শুরুর মাদকাসক্তি তাকে এতটাই কাবু করেছিল যে লম্বা করতে পারেননি আন্তর্জাতিক ফুটবল ক্যারিয়ার। নব্বইয়ের বিশ্বকাপের পরের বছর ড্রাগ টেস্টে কোকেইনের উপস্থিতি টের পাওয়ার পর ১৫ মাস নিষিদ্ধ ছিলেন ম্যারাডোনা। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে ফিরে ক্যামেরার সামনে চোখ-মুখ রগড়ে দিয়ে গোল উদযাপন। কিন্তু মাঝপথেই বহিষ্কৃত হন ড্রাগ টেস্টে এফিড্রিন নামের নিষিদ্ধ দ্রব্যের কারণে পজিটিভ হলে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে গ্রিস ও নাইজেরিয়ার বিপক্ষে মাত্র দুটি ম্যাচ খেলেই দেশে ফিরতে হয় তাকে। আফ্রিকান দেশটির বিপক্ষে খেলেন শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। ৯১ ম্যাচ খেলে ৩৪ গোল পাশে নিয়ে ১৭ বছরের ক্যারিয়ারের ইতি টানতে হয় বিশ্বকাপে বিজয়ী ও রানার্সআপের একটি করে পদক নিয়ে।

অনিয়ন্ত্রিত জীবনের পাশাপাশি মাদকসেবনের কারণে বাড়তে থাকে ওজন। তবে বেহিসেবী জীবন থেকে সরে আসেননি। সুস্বাস্থ্য ফিরে পাওয়ার জন্য কত কষ্টই না করতে হয়েছিল তাকে। ২০০৫ সালে ১৩০ কেজি ওজন থেকে স্বাভাবিক হতে লড়াই, কলম্বিয়াতে গ্যাস্ট্রিক বাইপাস সার্জারি। স্বাভাবিক ওজন ফেরাতে তিন মাসের শুধু তরল খাবার খাওয়ার নির্দেশ। সুস্থ হয়ে জনসম্মুখে এসেছিলেন। কিন্তু ২০০৭ সালের মার্চে হেপাটাইটিস ও অ্যালকোহল অ্যাবিউজের কারণে আবারও হাসপাতালে ভর্তি হন। ওই বছর এপ্রিলে এক মাসের মধ্যে তিনবার তার মৃত্যুর গুজব ছড়ায়। মাদকসংক্রান্ত সমস্যা কাটিয়ে আবারও ফেরেন এবং দেশের এক টেলিভিশনে জানান, আড়াই বছর ধরে মদ্যপান ও ড্রাগ নেওয়ার ছেড়েছেন।

এর মাঝে ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে এক ঘটনায় আলোচিত হন ম্যারাডোনা। বার্লিনে জার্মানির কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে হারের ম্যাচে এক বন্ধু টিকিট না পাওয়ায় স্টেডিয়ামেই ঢোকেননি। চারটি ভিআইপি টিকিট তার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল, কিন্তু ঢুকতে চেয়েছিলেন চারজন। অলিম্পিয়া স্টেডিয়ামে পা রাখার পরই আরেকটি টিকিট না পেয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়ে চলে যান ম্যারাডোনা।

এর পরের বিশ্বকাপে তো কোচ হয়েই আর্জেন্টিনার সঙ্গে ছিলেন। ২০০৮ সালে আলফিও বাসিল পদত্যাগ করলে জাতীয় দলের কোচ হন। কোচ হিসেবে প্রথম তিন ম্যাচ জিতলেও বাছাইয়ে বলিভিয়ার কাছে ৬-১ গোলে হারের পর ২০১০ সালের বিশ্বকাপে খেলা নিয়েই শঙ্কা জেগেছিল। পঞ্চম স্থানে ছিল তারা, কিন্তু শেষ দুই ম্যাচে জিতে অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনে দক্ষিণ আফ্রিকার টিকিট কাটে তার দল। আর্জেন্টিনা চূড়ান্ত হওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে মিডিয়ার সদস্যদের গালিগালাজ করে নিষিদ্ধ হন দুই ম্যাচ। ভবিষ্যতে এমন কা- করলে আরও বড় শাস্তির হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।

অবশ্য সাংবাদিকদের সঙ্গে ম্যারাডোনার শত্রুতা খেলার ক্যারিয়ার থেকেই। ১৯৯৪ সালে বুয়েন্স আয়ার্সে নিজ বাড়ির সামনে ফটোগ্রাফার ও সাংবাদিকদের তাক করে গুলি ছোড়েন। ২০১০ বিশ্বকাপের দল ঘোষণা শেষে সংবাদ সম্মেলন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে এক টিভি ক্যামেরাম্যানের পায়ের উপর চালিয়ে দেন গাড়ি। আহত ওই ক্যামেরাম্যানকে গালিও দেন। তিন বছর পর তখনকার বান্ধবী ওলিভাকে সঙ্গে নিয়ে দুবাই থেকে বুয়েন্স আয়ার্সে ফেরার পর ক্যামেরাম্যানরা পিছু নিলে পেছন ফিরে তাদের দিকে ঢিল ছোড়েন ম্যারাডোনা। একজনকে তো লাথিও মারেন। ২০১৪ সালে আরেক বান্ধবী ভেরোনিকাকে চোখ মারার অভিযোগে গাড়ি থেকে নেমে তো কষে চড়ই বসালেন।  

শুধু সাংবাদিক নয়, আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গেও বনিবনা হচ্ছিল না। কোচ হিসেবে প্রথম বিশ্বকাপে গ্রুপ ম্যাচে নাইজেরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও গ্রিসকে হারিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছিল ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা। মেক্সিকোকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালেরও দেখা পায় দল। কিন্তু জার্মানির কাছে ৪-০ গোলে ধরাশায়ী আর্জেন্টিনা। জানিয়ে দেন তিনি সম্ভবত আর দায়িত্বে থাকছেন না। কিন্তু অ্যাসোসিয়েশন জানায়, তাকে আরও চার বছরের চুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হবে। হঠাৎ করে এএফএ’র রূপ বদল, তাকে সরিয়ে কোচ করা হয় ড্যানিয়েল পাসারেল্লাকে। ম্যারাডোনা দাবি করেন, প্রেসিডেন্ট হুলিও গ্রোন্দোনা ও ডিরেক্টর কার্লোস বিলার্দো তাকে মিথ্যা বলেছেন এবং প্রতারণা করেছেন।

এরপর ম্যারাডোনা দুবাই ক্লাব আল ওয়াসল ও আমিরাতের দ্বিতীয় বিভাগীয় ক্লাব ফুজাইরাসহ আরও কয়েকটি ক্লাবের কোচিং স্টাফ ছিলেন। কিন্তু বিশ্বকাপ এলেই বিতর্ক আর ম্যারাডোনা যেন একসূত্রে গাঁথা। ২০১০ সালে বিশ্বকাপের আগে জার্মানির সঙ্গে এক প্রীতি ম্যাচের আগে থমাস মুলারকে বলবয় সম্বোধন করে তার সঙ্গে একই রুমে সংবাদ সম্মেলন করেননি তিনি। সেই বলবয়ই শেষ আটে আর্জেন্টিনার জালে দুইবার বল পাঠালেন, বিদায় নিতে হয় ম্যারাডোনাকে।

২০১৪ বিশ্বকাপেও সরব ছিলেন ম্যারাডোনা। সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে হারার পর ব্রাজিলকে নিয়ে উপহাস করতে ভোলেননি তিনি, ‘এবারের আসরে ব্রাজিলকে এক মুহূর্তের জন্যও ভালো লাগেনি। কিন্তু আমি মনে করিনি যে জার্মানি এতটা ভালো খেলবে। ব্রাজিলের তো মিডফিল্ডই ছিল না। ম্যাচের পুরোটা জার্মানির নিয়ন্ত্রণে ছিল। ৬-১ স্কোর হতেই ম্যাচ বন্ধ করে দেওয়া লাগতো, কারণ সেট (টেনিস) তো হয়েই গিয়েছে।’

ফাইনালে উঠেছিল ম্যারাডোনার দেশ আর্জেন্টিনা। দলটির অধিনায়ক লিওনেল মেসিকে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার গোল্ডেন বল দেওয়ার পর ৮৬-র বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দলের ফরোয়ার্ড বলেন, ‘মেসি? যদি সম্ভব হতো তাকে আমি স্বর্গ এনে দিতাম। কিন্তু এটা ঠিক নয় যে কেউ এমন কিছু জিতলো যেটা তার জেতা উচিত নয়, শুধুমাত্র বাণিজ্যিক পরিকল্পনার জন্য দেওয়া হলো।’

২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপে তো বিতর্কিত আচরণ করে শিরোনাম হয়েছেন বেশ কয়েকবার। আইসল্যান্ডের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ম্যাচ চলাকালে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে চুরুট টানেন। দক্ষিণ কোরিয়ার এক ভক্ত তার নাম ধরে চিৎকার করে হাত নাড়লে ম্যারাডোনা আঙুল দিয়ে নিজের চোখ টেনে ধরে সরু করে ফেলেন। ওই আচরণকে অনেকেই বর্ণবাদী বলেছিলেন। 

আর আইসল্যান্ডের সঙ্গে ড্র ও ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে খাদের কিনারায় থেকে যখন নাইজেরিয়ার মুখোমুখি আর্জেন্টিনা, সেদিন তো ক্যামেরা বারবার তার দিকেই ঘুরছিল। নাইজেরিয়ান এক নারী দর্শকের সঙ্গে নেচেও ছিলেন। প্রথমার্ধে মেসি যখন গোল করলেন তখন হাত প্রসারিত করে আকাশের দিকে তাকালেন। তারপর ক্রস করে সে কী হুঙ্কার! ম্যাচ চলাকালে একবার ঘুমাতেও দেখা গেলো তাকে। আর নাইজেরিয়া সমতা ফেরানোর পর রোহোর জয়সূচক গোলে তো সীমা ছাড়ালেন। কাউকে উদ্দেশ্য করে দুই হাতের মধ্যাঙ্গুলি দেখালেন। তার বন্ধু ও অন্যরা তাকে থামাতে যেন রীতিমতো যুদ্ধ করেছেন। একসময় অসুস্থ হয়ে গেলে তাকে ধরাধরি করে গ্যালারি থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। লাতিন আমেরিকার এক গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছিল, ‘ঈশ্বরের হাত থেকে লজ্জার আঙুল।’ 

সেন্ট পিটার্সবার্গে ওই ম্যাচে কেন ওমন অদ্ভুত আচরণ, জবাবে এক টেলিভিশন শোয়ে ম্যারাডোনা বলেন, ‘ওই দিন বেশিমাত্রায় রেড ওয়াইন খেয়েছিলাম।’ তার প্রতিক্রিয়ায় অনেকে তাকে স্টেডিয়ামে নিষিদ্ধের দাবিও জানান। হ্যাঁ, আর কোনোদিন স্টেডিয়ামে দেখা যাবে না তাকে। তিনি এখন নাগালের বাইরে। ফুটবলে ম্যারাডোনার আবির্ভাবের পর তাকে ছাড়া প্রথম বিশ্বকাপ। আর কখনও বিতর্কিত আচরণের কারণে হবেন না শিরোনাম। মেসিদের অনুপ্রাণিত করবেন না তিনি গ্যালারিতে থেকে। তবে তার ‘স্বর্গবাস’ ঠিকই উজ্জীবিত করেছে দলকে, তিনি সেখান থেকেই দেখেছেন কোপা আমেরিকা জয়ী আর্জেন্টিনার হাতে ২৮ বছর পর শিরোপা। তার শূন্যতার প্রথম বিশ্বকাপে কি মেসিরা পারবেন আরেকটি ট্রফি জিততে? সেটা দেখতে করতে হবে অপেক্ষা। কিন্তু ভক্তদের মনে কিছুটা হাহাকার থাকছেই, একজনকে বলতে শোনা গেলো, ‘বিশ্বমঞ্চে আর দেখতে পাবো না ম্যারাডোনার পাগলামি’। একই কথা হয়তো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তার অন্য ভক্তদেরও মনে।