ম্যাচ শুরুর ত্রিশ মিনিট আগেই লুসাইল স্টেডিয়ামে ফার্নান্দো সান্তোসের সিদ্ধান্তটা ছড়িয়ে পড়ে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে ছাড়াই পর্তুগাল কোচ সান্তোস সাজিয়েছেন সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে শুরুর একাদশ। ব্রুনো ফার্নান্দেজ, ফেলিক্স, বার্নার্ডো সিলভার সঙ্গে মাঠে নামবেন গঞ্জালো রামোস। ২১ বছর বয়সী রামোস আজই খেলবেন প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ। সেটাও পর্তুগাল ফুটবলের ধ্রুবতারা রোনালদোর জায়গায়। যার নামে ফুটবল পৃথিবীতে জাগরণ হয়।
মাঠে নামলেন রামোস। নিজেকে চেনাতে সময় নিলেন স্রেফ ৬৭ মিনিট। তাতেই ইতিহাস। ধূমকেতু হয়ে এসে কাতার বিশ্বকাপের প্রথম হ্যাটট্রিকটি নিজের নামে করে নিলেন পর্তুগালের তরুণ বিস্ময়। ২০০২ সালে মিরোস্লাভ ক্লোজা নিজের প্রথম ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেছিলেন। ২০ বছর পর তেমনই কেউ নিজের প্রথম ম্যাচে দেখালেন কারিশমা।
রোনালদোর জায়গায় মাঠে নেমে পারফর্ম করা পাহাড়সম চাপ। ইতিহাস, ঐতিহ্য, রেকর্ড, গৌরব কতো কিছু তার দুই পায়ের ফুটবলে মিশে আছে। তাকে বেঞ্চে বসিয়ে রেখে পর্তুগাল মেজর প্রতিযোগিতায় শেষ মাঠে নেমেছিল ২০০৮ সালে। এরপর টানা ৩১ ম্যাচে পর্তুগাল, রোনালদো এক সমান্তরালে এগিয়েছে। বিশেষ করে সান্তোস-রোনালদো জুটি পর্তুগালকে এগিয়ে নিয়েছে অনেকদূর। ২০০৬ সালে জিতিয়েছে ইউরোর শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটও। সেই রোনালদোকে বেঞ্চে বসিয়ে রাখার সাহস সান্তোস দেখিয়েছেন প্রতিশ্রুতিশীল রামোসে মুগ্ধ হয়ে।
আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন তরুণ তুর্কী। ধূমকেতু হয়ে আসা রামোসের কীর্তিতে আড়াল ধ্রুবতারা রোনালদো। তাকে বেঞ্চে বসিয়ে রাখার আলোচনটাই সবচেয়ে বেশি হচ্ছিল তখন রামোস গুনে গুনে দেন তিন গোল। সঙ্গে পেপে ও রাফায়েল জুরেরিও গোল করে এগিয়ে নেন পর্তুগালকে। ৭৩ মিনিটে রোনালদো যখন মাঠে নামলেন তখন উঠে আসেন রামোস। ততক্ষণে সুইসবধ হয়ে গেছে পর্তুগালের। ৫-১ গোলে এগিয়ে থাকা পর্তুগাল শেষ পর্যন্ত রাফায়েল লিওর গোলে ৬-১ ব্যবধানে জয় নিয়ে ১৬ বছর পর নাম লিখায় কোয়ার্টার ফাইনালে।
নতুনের আগমণে সব সময়ই পুরোনোকে স্থান ছেড়ে দিতে হয়। রোনালদো-রামোসের ক্ষেত্রেও তা অভিন্ন নয়। ৩৭ এর রোনালদোকে টেক্কা দিতে প্রতিজ্ঞাবব্ধ হয়েই সবুজের গালিচায় পা রেখেছেন ২১ বছর বয়সী রামোস। যা বোঝা গেছে তার ঠাণ্ডা মাথার সূচাগ্র ফিনিশিংয়ে। ১৭ মিনিটে ফেলিক্সের থ্রো থেকে ডি বক্সের ভেতরে বল নিয়ে ঢুকে জোড়ালো শট নেন টপ লেফট কর্নার বরাবর। চোখের পলকেই দৃষ্টিনন্দন গোল। বিরতি থেকে ফিরে আবার তার নিখুঁত ফিনিশিং।
৫১ মিনিটে দিয়াগো ডালোটের ক্রসে স্রেফ পা ছুঁয়ে দেন। গোলরক্ষক সোমারের পায়ের নিচ দিয়ে বল খুঁজে পায় ঠিকানা। ৬৭ মিনিটে বিশ্বকাপ পেয়ে যায় প্রথম হ্যাটট্রিক। সেটা রামোসের পায়ের জাদুতে। ফেলিক্সের বাড়ানো বল নিয়ে বক্সের ভেতরে ঢুকে আলতো টোকায় হাওয়ায় ভাসিয়ে বল পাঠান সুইস জালে। তাতেই হ্যাটট্রিক। আর ফুটবল মঞ্চে আগমণ হয়ে যায় নতুন ধূমকেতুর।
রোনালদোও এমন ধূমকেতু হয়ে এসে ধ্রুবতারার জায়গা দখল করে নিয়েছিলেন। যার উজ্জ্বল আলোয় জ্বলেছে গোটা ফুটবল বিশ্ব। ২১ এ পথ চলা শুরু করা রামোসের সামনে উন্মুক্ত দুনিয়া। ধ্রুবতারা হতে পারবেন কিনা তা সময় বলে দেবে। তবে তার আগমণে আড়াল হয়েছে রোনালদোর উপস্থিতি। ২১ মিনিট খেলতে পেরেছিলেন রোনালদো। দশ মিনিটের ভেতরেই একটি সুযোগ তৈরি করে বল জালে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু অফসাইডে তা বাতিল হয়ে যায়।
৬-১ গোলে দলের জয় নিশ্চিতের পর পর্তুগাল যখন উল্লাসে ব্যস্ত, খেলোয়াড়রা যখন সমর্থকদের অভিবাদন জানাচ্ছেন তখন টানেল দিয়ে বেরিয়ে যান অধিনায়ক রোনালদো। দলের সাফল্য, জয় উদযাপনে তাকে না পাওয়া বলেই দেয়, সুখে নেই রোনালদো! নিজেকে হারিয়ে অনলে পুড়ছেন।
এই ম্যাচে সব আলো কেড়েছেন রামোস। তার দেদীপ্যমান দিনে সুইজারল্যান্ডকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি। টানা দুই জয় নিয়ে শেষ ষোলোতে পা রাখা সুইসরা কখনো তিন ম্যাচ জিততে পারেনি বিশ্বকাপে। বিব্রতকর এই রেকর্ডের খাতায় কাতার অধ্যায়ও। অন্যদিকে রামোস, পেপে, জুরেরিও ও লিওর ঝকঝকে পারফরম্যান্সে পর্তুগাল এখন সেরা আটে। যেখানে আগে থেকেই তাদের অপেক্ষায় ছিল মরক্কো। শনিবার রাত ৯টায় সেমিফাইনালে যাওয়ার লড়াইয়ে মাঠে নামবে দল দুটি।