মিশ্র অভিজ্ঞতার সিরিজ! যেখানে বল ছিল সবচেয়ে বড় প্রভাবক। নতুন বলে বোলারদের মুখে হাসি ফোটে। পুরোনো হলেই বিষন্ন! তারা যেন একেবারেই নির্বিষ। ব্যাটসম্যানদের জন্য ঠিক উল্টো। নতুনে পা কাপাকাপি। পুরোনোতে হাসির ঝিলিক। উইকেটে ভেদে পরিস্থিতি পাল্টেছে আরো। চট্টগ্রামে ব্যাটসম্যানরা থিতু হতে পারলে রান করতে পারেন অনায়াসে। ঢাকায় থিতু হলেও প্রতিটি মুহূর্তে মুহূর্তে দিতে হয় পরীক্ষা। বাংলাদেশ ও ভারতের দুই টেস্টের ফল সফরকারীদের পক্ষে গেছে। বন্দরনগরীতে পেরে না উঠলেও ঢাকায় স্বাগতিক দল শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করেছে। শেষ হাসিটা হাসতে না পারলেও ভারতের দম্ভ চূর্ণ করেছে। দুই দলের জয়-পরাজয়ের পার্থক্য করে দিয়েছে ১.০৭ গ্রামের কোকাবুরা বল। যে বল গড়ে দিয়েছে পার্থক্য।
ঢাকা টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে ছড়িয়েছিল রোমাঞ্চ। ১৪৫ রানের পুঁজি নিয়েও ম্যাচ জমিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ। রাহুল, গিল, পুজারা, কোহলি, পান্তদের ফিরিয়ে ম্যাচটা প্রায় বাগিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু শেষ দিকে অশ্বিন, শ্রেয়াসের দেয়াল ভাঙতে পারেনি। কারণ ওই কোকাবুরা বল। দুই দলের টেস্ট সিরিজ হয়েছে অস্ট্রেলিয়ায় প্রস্তুত হওয়া কোকাবুরা বল। এই বলের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য প্রথম ২০-৩০ ওভারে ডিউক বা এসজির তুলনায় বেশি সুইং করে। এরপর এটি নরম হয়ে যায় আর সিমও নষ্ট হয়ে যায়। তখন বল আর সুইং করে না। মিরপুরের ২২ গজে চতুর্থ ইনিংসে দেখা গেল কোকাবুরা বলের সেই বৈশিষ্ট্য। নতুন বলে সাকিব, তাইজুল, মিরাজ, এই ‘স্পিন ত্রিফলায়’ স্রেফ এলোমেলো ভারতের টপ অর্ডার। তৃতীয় দিনের পড়ন্ত বিকেলে রাহুল, গিল, পুজারা ও কোহলিকে ৪৫ রানের ভেতরে আটকে রেখে জয়ের ছবি আঁকতে শুরু করে বাংলাদেশ। সেদিন বোলিং করেছে কেবল ২৩ ওভার। রোববার চতুর্থ দিন সকালে ৭ ওভার শেষ হওয়ার আগেই ড্রেসিংরুমে উনাদকাট, পান্ত ও অক্ষর। ৭৪ রানে নেই ভারতের ৭ উইকেট। ভারতের জয় তখন অনেকদূরে (৭১ রান)। বাংলাদেশের প্রয়োজন কেবল ৩ উইকেট। অক্ষরের বিদায়ে ক্রিজে আসেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। এসে ১ রানে জীবন পান। এরপর আর তাকে ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্রিজে তার কাজটা সহজ করে দেয় কোকাবুরা বল। বল পুরোনো হওয়ায় স্পিনাররা কেউই বল গ্রিপ করতে পারেনি। বল তেমন ছোবলও দেয়নি। সঙ্গে সূর্যের তেজ বেড়ে যাওয়ায় সকালের আর্দ্রতা কমে যায়। ফলে উইকেটের কার্যকারীতাও কিছুটা কমে যায়। বল ও উইকেট পুরোপুরি অশ্বিন-শ্রেয়াসের পক্ষে যায়। অনায়াসে তারা ব্যাটিং করে চোখের পলকে বাংলাদেশের হাতের মুঠোয় থেকে ম্যাচ বের করে নেন। অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়ে জেতান দলকে। আর বাংলাদেশ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেও ব্যর্থ। উইকেট ও বল কতটা প্রভাবক রেখেছে তা জানা যায় ম্যাচের পর।
৪২ রানের দায়িত্বশীল ইনিংস খেলে দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যাওয়া অশ্বিন পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে বলেছেন, ‘পিচ আসলে ভালো ছিল। যদিও কিছুটা ধীরগতির ছিল। আসলে বলটা অন্য সবকিছুর চেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। আসলে যেকোনো জায়গায় কোকাবুরা বল ৩০-৩৫ ওভার পর নরম হয়ে যায়। আর এই নরম বল ব্যাক ও ফ্রন্ট ফুটে খেলা যায়। বাংলাদেশকে কৃতিত্ব দিতে হবে। তারা এই কন্ডিশন সবচেয়ে ভালো চেনে। তারা আমাদের অনেক চাপে রেখেছিল। আসলে এটা এমন একটা ম্যাচ ছিল যেটা জিততে যেকোনো দলকে কাঠখড় পোড়াতে হতো।’ ব্যাটিংয়ে সেই চিত্র ফুটে উঠেছিল। ৪২ রানের অর্ধেকই তুলেছেন বাউন্ডারিতে (৪ চার ও ১ ছক্কা)। ড্রাইভ, পুল, ফ্লিক শটে উইকেটের চারিপাশেই রান করেছেন অশ্বিন। ২৯ রান করা শ্রেয়াসও এগিয়েছেন সমান তালে। বাংলাদেশের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান সংবাদ সম্মেলনে বল ও উইকেট নিয়ে একই কথা বলেছেন,‘মিরপুরে যখন বলটা একটু পুরোনো হয়ে যায় তখন কঠিন। ব্যাটসম্যানদের জন্য একটু সহজ হয়ে যায়।’
একাধিক সুযোগ হাতছাড়ার হতাশা সাকিবের ছিল। সঙ্গে আরো ভালো বোলিংয়ের হাহাকারও পাওয়া গেল কণ্ঠে, ‘আরো একটু ভালো বল করতে পারতাম। আরো একটু সুযোগ তৈরি করতে পারতাম। যেমন ধরণের উইকেটে খেলা হচ্ছিল সেখানে আমাদের আরো একটা দুইটা সুযোগ তৈরি করা উচিত ছিল।’ ফল নিজেদের পক্ষে না আসায় সাকিবের আফসোস নেই। শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ে থাকায় খুশি সাকিব। এই আত্মবিশ্বাসকেই জ্বালানি হিসেবে কাজে লাগাতে চান অধিনায়ক, ‘এটাও ভালো যে অন্তত আমরা কাছে যেতে পারছি এখন। আশা করি, পরের বছর থেকে ভালো ফল দেখাতে পারব।’