খেলাধুলা

স্টেডিয়ামের গ্রাউন্ডসম্যান: যাদের কথা কেউ বলে না

ক্রিকেট স্টেডিয়ামে পিচ তৈরি, রক্ষণাবেক্ষণ, ঝড়-বৃষ্টি-কুয়াশা থেকে পিচের সুরক্ষা এমন কি পুরো স্টেডিয়ামের প্রতিটি ঘাষ থেকে ধুলিকণায় যাদের শ্রম আর ঘামের স্পর্শ- তারা গ্রাউন্ডসম্যান। স্টেডিয়ামে তারকা ক্রিকেটারদের নিত্য আনাগোনা, ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বড় বড় আসর, বড় বড় আয়োজন কিন্তু কিন্তু গ্রাউন্ডসম্যানরা কখনো আলোচনায় আসেন না। তাদের কথা বলেন না কেউ। চট্টগ্রাম সাগরপাড়ের জহুর আহাম্মদ চৌধুরী ক্রিকেট স্টেডিয়ামে কর্মরত গ্রাউন্ডসম্যানদের কথা তুলে ধরেছেন চট্টগ্রামে রাইজিংবিডির নিজস্ব প্রতিবেদক।

চট্টগ্রাম জহুর আহাম্মদ চৌধুরী ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ২০০৩ সাল থেকে গ্রাউন্ডসম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তপন। এখন বয়স ৫০ পার হয়েছে। মাত্র ২১০০ টাকা বেতনে বিসিবি’র এই কঠিন পরিশ্রমের চাকরিতে ঢুকেছিলেন। দীর্ঘ ২০ বছর চাকরিতে ২০২৩ সালে এসে তার বেতন মাত্র ১৫ হাজার টাকা। ২০ বছর ধরে ক্রিকেট পিচ, স্টেডিয়ামের ঘাষ, পানির সাথে ভালোবাসা। ২০ বছর ধরে তীব্র রোদে পুড়ছেন, ঘামে ভিজেছেন আবার বৃষ্টি জলে সেই ঘাম ধুয়ে নিয়েছেন। এভাবেই কেটে যাচ্ছে বছরের পর বছর।

চট্টগ্রামে বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড সিরিজের শেষ ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচের বিরতিতে গ্রাউন্ডসম্যান তপন রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘২০ বছর ধরে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাথে আছি। আমরা এখানে ২৫ জন গ্রাউন্ডসম্যান দায়িত্ব পালন করি। পিচ তৈরি করি, পিচের মাটি প্রস্তুত করি, কাঁধে বহন করি। পিচসহ পুরো স্টেডিয়াম রক্ষণাবেক্ষণ করি। স্টেডিয়ামের প্রতিটি ঘাষের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব, আমাদের ভালোবাসা। এই ভালোবাসা থেকেই আজও কাজ করে যাচ্ছি। ২১শ’ টাকার বেতন ২০ বছরে ১৫ হাজার টাকা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে ১৫ হাজার টাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সংসার চালানো যায় না। তবু আমরা খেয়ে না খেয়ে চালিয়ে নিচ্ছি।’

তপন জানান, স্টেডিয়ামে খেলা বা সিরিজ চললে সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা ১১টা পর্যন্ত ডিউটি করতে হয়। খেলা না থাকলে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ডিউটি। অতিরিক্ত কাজের জন্য আমরা কখনো অতিরিক্ত পারিশ্রমিক পাই না। মাসের বেতন আর দুই ঈদে দুটি বোনাস-এই দিয়েই আমরা চালিয়ে নিচ্ছি বছরের পর বছর। বিপিএল, লিগসহ ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক সিরিজের বড় বড় স্পন্সর আসেন। কিন্তু আমরা অবহেলিতই থাকি। আমাদের খবর কেউ রাখেন না।’

শাহজাহান, এরশাদ, তাপস, বাবুসহ আরও একাধিক গ্রাউন্ডসম্যান রাইজিংবিডিকে জানান, চট্টগ্রাম জহুর আহাম্মদ চৌধূরী স্টেডিয়ামে ২৫ জন গ্রাউন্ডসম্যান দায়িত্ব পালন করেন। এদের মধ্যে বিসিবির স্থায়ী ১০ জন। বাকি ১৫ জন মাস্টার রোলে। স্থায়ী গ্রাউন্ডসম্যানরা মাসে ১৩ হাজার টাকা এবং মাস্টার রোলের গ্রাউন্ডসম্যানরা মাসে ১১ হাজার টাকা বেতন পান। এই বেতনের তাদের রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে দায়িত্ব পালন করতে হয়। পিচের মাটি প্রক্রিয়াকরণ, পিচ তৈরি, রক্ষণাবেক্ষণ, ভারি রোলার চালানো, পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে ঘাষের পরিচর্যা, পানি ছিটানো, ঝড় বৃষ্টি কুয়াশা থেকে পিচের সুরক্ষা সব কিছুই করতে হয়।

কেউ ২০ বছর কেউ ১৫ বছর আবার কেউ ৭/৮ বছর ধরে স্টেডিয়ামের গ্রাউন্ডসম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের সব তারকা ক্রিকেটার তাদের চিনেন। কিন্তু তারা অবহেলিতই থাকেন। ১১ থেকে ১৫ হাজার টাকা বেতন পেয়ে খেয়ে না খেয়ে জীবন চালিয়ে নিচ্ছেন। দ্রব্যমূল্যের এই দুঃসময়ে ১১-১৫ হাজার টাকায় মাস চালিয়ে নেওয়া কোনভাবেই সম্ভব হয় না।

গ্রাউন্ডসম্যানরা চান তাদের কঠোর পরিশ্রমের কিঞ্চিত মূল্যায়ন হউক। বিসিবি বা স্পন্সর প্রতিষ্ঠানগুলো মাঝে মাঝে তাদের দিকে ফিরে তাকাক। বেতনের বাইরে কিছু বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পেলে হয়তো এই কঠিন সময়ে তারা সংসার, স্ত্রী সন্তানের মুখে তিনবেলা খাবার তুলে দিতে পারবেন।