খেলাধুলা

তারুণ্যের তেজে নবযুগের ভেলায় বাংলাদেশ

মার্ক উডকে নাজমুল হোসেন শান্তর টানা চারটি চার, হাসান মাহমুদের ভয়ংকর ইয়র্কারে জস বাটলারের অসহায় আত্মসমর্পণ, আদিল রশিদের গুগলিকে মামুলি বানিয়ে তৌহিদ হৃদয়ের ছক্কা কিংবা কাভার থেকে ক্ষীপ্রতার সঙ্গে বাটলারকে মেহেদি হাসান মিরাজের রানআউট— সবকিছু মিলিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তারুণ্যে গড়া সাকিব আল হাসানের দল ছিল দুর্বার।

শের-ই-বাংলায় এর আগেও বহুবার বড় দলগুলোকে হারানোর উৎসবে মেতেছিল লাল সবুজের দল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩-০ ব্যবধানে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয় এই আর এমন কি? এমন প্রশ্ন অনেকের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছে। বুঝে হোক না বুঝে অনেকেই আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার বিষয়বস্তু বানিয়ে ফেলেছেন।

অন্য অনেক জয় থেকে, অনেক সিরিজ থেকে এই জয় বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টির ধূসর ইতিহাসে রঙিন হয়ে থাকবে। চনমনে থেকে আগ্রাসী ক্রিকেট, ভয়ডরহীন মনোভাব, হার না মানা মানসিকতা সবকিছুই দেখা গেছে বাইশ গজে। দলের নবীনতম সদস্য থেকে শুরু করে দেড়যুগ ধরে খেলা ক্রিকেটার, এই সিরিজেই দ্বিতীয় মেয়াদে যোগ দেওয়া কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে সবাই যেন ছিলেন একই সূত্রে গাঁথা।

এই সিরিজের অন্যতম আবিস্কার অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। অধিনায়ক হিসেবে, ক্রিকেটীয় বুদ্ধিতে সাকিবের কোনো কমতি ছিল না। কিন্তু এবার যেন আরও আলাদা। যেন নিজের খোলনলচে বদলে ফেলেছেন। ২২ গজে তার বিচরণ, সতীর্থদের সঙ্গে রসায়ণ, ব্যাটিং-বোলিং পারফরম্যান্সে অসাধারণ; সবমিলিয়ে এক অনন্য সাকিবকেই দেখা গেছে।

টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের আক্ষেপ ছিল ঝিমিয়ে পড়া মানসিকতা নিয়ে। যাদের ব্যাটে রানের ফুলঝুরি, বোলিংয়ে উইকেটের মিছিল তারা যেন খেই হারিয়ে ফেলতেন। আগ্রাসী মনোভাব তো দূরের বিষয়। অধিনায়ক বদলেছে, প্রধান কোচকে বিশ্রাম দিয়ে উড়িয়ে আনা হয়েছিল টি-টোয়েন্টির জন্য বিশেষজ্ঞ কোচ; কিন্তু একটা জিনিসই বদলায়নি সেটি ২২ গজের পারফরম্যান্স। এবার সেটি দেখা মেলে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে স্পোর্টিং উইকেটে।

এই সিরিজ যেন টি-টোয়েন্টিতে নবযুগের ইঙ্গিত। ক্রিকেটারদের অ্যাপ্রোচের ভিন্নতাই বলে দিচ্ছে তা। যেমনটা বলছেন বিশ্বজুড়ে টি-টোয়েন্টি খেলে বেড়ানো অধিনায়ক সাকিব, ‘আমরা কোন সিরিজের সাথেই কোন সিরিজের তুলনা করতে চাই না। প্রতিটা ম্যাচই জেতা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যেভাবে খেলে জিতেছি আমার কাছে মনে হয় এটা একটা সময় আমরা খুব একটা করিনি। সেদিক থেকে আমার কাছে মনে হয় আমরা পুরো দলই সন্তুষ্ট।’

একইভাবে জাতীয় নির্বাচক হাবিবুল বাশারও বলেছেন। সাকিবদের ব্র্যান্ড অব ক্রিকেটে তার ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি, ‘সাফল্য যে আগে ছিল না, তা নয়। তবে আমরা যেভাবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি, এই সিরিজে কিছুটা হলেও পেরেছি। সিরিজের ফল ২-০ হয়ে গেছে। আমরা সিরিজ জিতে গেছি। তবে যেটা বেশি তৃপ্তিদায়ক ছিল, টি-টোয়েন্টি সংস্করণে যেভাবে আমরা খেলতে চাই, তার কিছুটা হলেও এই সিরিজে এখন পর্যন্ত আমরা প্রকাশ করতে পেরেছি।’

এই সিরিজে দুই দলের মধ্যে সর্বোচ্চ রান নাজমুল হোসেন শান্তর (১৪৪), সর্বোচ্চ উইকেট যৌথভাবে মেহেদি হাসান মিরাজ-তাসকিন আহমেদ (৪), সর্বোচ্চ ডিসমিসাল লিটন দাশের (৫) এবং সর্বোচ্চ ক্যাচও শান্তর (৪)।

দেশের মাঠে খেলা মানেই যেন স্পিন উইকেট। বিপিএলের পর এবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মরা উইকেটের ধারা থেকে বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। তবুও কিছুটা সহায়তা ছিল স্পিনারদের। এমন উইকেটে বাংলাদেশের তিন পেসার তাসকিন-মোস্তাফিজ-হাসান মাহমুদ যেভাবে বোলিং করে গেছেন তা এক কথায় অতুলনীয়। ডেথ ওভারে কৃপণ বোলিং, ব্রেক থ্রু এনে দিয়ে ম্যাচের নাটাই নিজেদের হাতে নিয়ে আসা; সর্বোচ্চটুকুই দিয়েছেন এই ত্রয়ী।

মোস্তাফিজ ৫.৫৮ ইকোনোমিতে উইকেট নিয়েছেন ৩টি, তাসকিন ৭.৩৩ ইকোনোমিতে উইকেট নিয়েছেন ৪টি। আর হাসান ৬.৫০ ইকোনোমিতে রান দিয়ে নিয়েছেন ৩ উইকেট। ইংল্যান্ডের পেসারদের মধ্যে একমাত্র জোফরা আর্চার দারুণ বোলিং করেছেন, ৪ উইকেট নিয়েছেন ৬.৬৩ ইকোনোমিতে। বাংলাদেশের তিন পেসারের সঙ্গে তুলোনা করলে একমাত্র তিনি আছেন তাসকিনের আগে (ইকোনোমির ভিত্তিতে)। বাকিরা সবাই ৬.৫০ এর বেশি। কারানের ইকোনোমি ৬.৭৭, জর্ডানের ইকোনোমি ৮.৯১, ওকসের ইকোনোমি ১০ ও এক ম্যাচ খেলা উডের ইকোনোমি ১২।

পেসারদের নিয়ে প্রশ্নে সাকিবের উত্তর, ‘আমাদের বোলিং ইউনিট ভালো ছিল। আমরা ৬ জন প্রপার বোলার নিয়ে খেলেছি। হয়তো আমাদের আরও অনেক কিছু টিউনিংয়ের দরকার আছে। বিশ্বকাপের কথা চিন্তা করলে আমাদের শুরুটা ভালো হলো।’

ব্যাটিং-বোলিং কিংবা ফিল্ডিং ২২ গজের সব বিভাগেই বাংলাদেশ ছিল অদম্য। পরিসংখ্যানও বলছে তাই। টি-টোয়েন্টিতে বদলে যাওয়া বাংলাদেশ নিয়ে সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট বলেন, ‘এত তাড়াতাড়ি বিচার করা যদিও কঠিন। তবে এটা সত্য বাংলাদেশ তিন বিভাগেই ভালো খেলেছে, আগে কি হতো আমাদের ব্যাটিংয়ে ১০-১৫ রান কম হতো, বোলাররা রান বেশি দিয়ে ফেলতো এবার এসবে ঘাটতি কম ছিল। ফিল্ডাররা ভালো করেছে। যে অ্যাপ্রোচে বাংলাদেশ খেলেছে এটা প্রশংসনীয়, তবে এটা ধরে রাখতে হবে। যদি ধরে রাখতে না পারে তাহলে এই জয় নিয়েও কথা হবে পরে।’

ইংল্যান্ড সিরিজে তারুণ্যের তেজে তেজোদীপ্ত এক বাংলাদেশকে দেখেছে বিশ্ব। তাদের পারফরম্যান্সে ভর করে বাংলাদেশ ভাসতে শুরু করেছে নবযুগের ভেলায়। তারুণ্যের ছোঁয়ায় বাংলাদেশের ক্রিকেটে ফুটুক নবযুগের রক্তরাগ।