১৯৭৫ এর বিশ্বকাপের ফাইনাল, আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমি তখন পাঁচ। বাবা-মার সাথে যুক্তরাজ্যের এবারিস্টউইথ-এ বাস করি। আমার বাবা ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছিলেন।
বিশ্বকাপ গ্রীষ্মকালে হওয়াতে তখন আমাদের স্কুল ছুটি। টিভিতে খেলার হাইলাইট দেখি। বাসায়, আমার বাবার উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠা লক্ষ্য করি। আমি কিছু বুঝতে পারছিনা। কিন্তু দেখছি।
আমি খুব ছোট হলেও, ইতিহাসের একটা সন্ধিক্ষণে বিশ্বকাপ দেখছিলাম। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফাইনালে পৌঁছানোর পরে খেলার মাঠে আমার ক্যারিবিয়ান বন্ধুদের কাছ থেকে বুঝলাম ফাইনালে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ার কোন দল সেমি-ফাইনাল পৌঁছাতে পারেনি সেবার। সেমি-ফাইনাল থেকে আমার বাবা আর তার বন্ধুদের পুরা সমর্থন চলে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজের দিকে।
ফাইনালে আমার কয়েকটা স্মৃতি আছে। ভিভ রিচার্ডসের একটা রান-আউট, ক্লাইভ লয়েডের ইনিংস, আর খেলা শেষে লয়েডের শিরোপা উত্তোলন, এরপর উদযাপন।
গ্রীষ্মের ছুটি শেষে সে বছর যখন আমরা স্কুলে ফিরে এলাম, তখন বুঝলাম, আজকের ‘ফায়ার ইন ব্যাবিলন’ কিভাবে একটা প্রজন্মে দাবানল ছড়িয়ে দিয়েছিল। ১৯৭৯-র ফেব্রুয়ারিতে আমরা বাংলাদেশ ফিরি। সে বছরের বিশ্বকাপ আর দেখা হয়নি। ১৯৮৩-র বিশ্বকাপেও একই সন্ধি। যদিও দেখার দরকারও ছিল না।
১৯৭৬-এ ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইংল্যান্ড সফর সিরিজটা মিডিয়ার কল্যাণে আকাশে বাতাসে মেশানো ছিল। ওভালে ভিভ রিচার্ডসের ২৯১ ও মাইকেল হোল্ডিংয়ের ১৪ উইকেটের রেশ যুক্তরাজ্যে বসবাসরত সে সময়ের যে কোন শিশুকে প্রভাবিত করেছে। আমিও এর ব্যতিক্রম ছিলাম না।
দেশে ফেরার পর ১৯৮৫ পর্যন্ত ক্রিকেট ওভাবে অনুসরণ করা হয়নি। সে বছর এসএসসির পর আমার বাবা-মা আমাকে একটা স্টেরিও সিস্টেম দেন। আমাকে তখন আর কে পায়? শর্ট ওয়েভ রেডিওর কল্যাণে অ্যাশেজ আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট সিরিজ নেশায় পরিণত হয়ে গেল।
উইজডেন, ক্রিকেটার, স্পোর্টস ওয়ার্ল্ড, স্পোর্টস স্টার ম্যাগাজিনের পুরানো কপি নীলক্ষেত থেকে কিনি। অবশ্যই অন্য দল ছিল। কিন্তু, অন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছিল না।
আর কি দলটাই-না ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। গ্রিনিজ, হেইন্স ও রিচার্ডসের উইকেট পেলেও, গোমস আর লয়েডকে সামলাতে হত। প্রতিভার কোন ঘাটতি ছিল না। ইচ্ছা করলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুইটা কেন, তিনটা দলও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাঠাতে পারত। অ্যান্ডি রবার্টস, ম্যালকম মার্শাল, জোয়েল গার্নার, মাইকেল হোল্ডিংয়ের পরে অপেক্ষমাণ ফাস্ট বোলার সারিতে কলিন ক্রফট, সিলভেস্টার ক্লার্ক চেয়ে থাকত। ব্যাটিংয়ে ঐ একই সারিতে চেয়ে থাকত লরেন্স রো, এলিভন কালিচরণ, ডেভিড মারে প্রমুখ। কখন তারা সুযোগ পাবে?
তখন কারো চোখে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফাটল ধরা দেয়নি। ধরা দেয়া সম্ভবও ছিল না। কারণ, সব জায়গায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের তখন জয় জয়কার। ১৯৮২ আর ১৯৮৩-তে দক্ষিণ আফ্রিকাতে দুইটা বিদ্রোহী দল সফর করে। তাদের মধ্যে দ্বিতীয় সারির বেশ কয়েকজন ছিল। এই বিদ্রোহী খেলোয়াড়রা আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলতে পারেনি।
আজকে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট আছে। আছে কোটি ডলারের এন্ডোর্সমেন্ট। আরও কত কি আছে। তখনকার দিনে জাতীয় দল আর ইংলিশ কাউন্টি ছাড়া অধিক টাকা উপার্জন করবার কোন প্লাটফর্ম ছিল না। ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়রা বিদ্রোহী সফরের অফার কিভাবে ছাড়ত?
কিন্তু কোথায় যেন একটা গলদ ছিল। টেস্টে বিশ্বসেরা, কিংবা কাল সেরা থাকলেও, যে ওডিআই ওয়ার্ল্ড কাপ টুর্নামেন্টের প্রথম তিনটাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফাইনাল পর্যন্ত গেছে, এর পরে আর কোনদিন সেমিফাইনাল পরে তারা পৌঁছাতে পারেনি। ওডিআই তালিকাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সবার আগে থাকছে। কিন্তু যখনই কোন বিশ্বকাপ আসছে, তারা কোন না কোন নকআউট স্টেজেই বাদ পড়ছে।
আমার চোখে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পতন শুরু হয় যখন কার্টলি অ্যামব্রোস আর কোর্টনি ওয়ালশ অবসর নেয়। ব্রায়ান লারা আর শিবনারায়ণ চন্দ্রপাল হাল ধরলেও, উইকেট নেয়ার মত বোলারের সরবরাহ থেমে যায়। এর পরের ধাক্কা আসে টি-টোয়েন্টির ক্রিকেটের আগমনে।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট আস্তে আস্তে সারা ক্যরিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। ফ্রাঞ্জাইজি ক্রিকেটের উত্থানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম সারির অনেক ক্রিকেটার দেখল বোর্ডেও বাইরে তাদের একটা উপার্জন উৎস আছে। বিভিন্ন দ্বীপের অন্তঃকলহ বোর্ডের রাজনীতি সামাল দেয়ার জন্য এটি একটা ভালো অপশন হিসাবে দেখা দেয়।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। ১৯৮০-র দশকে দক্ষিণ আফ্রিকার বিদ্রোহী দল মূল ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলটির চিড় ধরাতে পারেনি। এবার আর কিছু বাকি রইলো না। একটা যুক্তি অবশ্য দেয়া যায় যে, এত কিছুর পরেও, ওয়েস্ট ইন্ডিজ তো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দুইবার; ২০১২ আর ২০১৬-এ জেতে। আর চ্যাম্পিয়ানস ট্রফি ২০০৪ সালে একবার জেতে। কিন্তু তারপরেও ওয়েস্ট ইন্ডিজের আমেজটা অন্য যে কোন দলের থেকে আলাদা। ওডিআই বিশ্বকাপে তারা অংশগ্রহণের যোগ্যতা রাখতে পারবে না, তা চিন্তার বাইরে।
অনেকে এইবারের ওডিআই বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটের ইতি টানছেন। যদি তা-ই হয়, তা হবে খুবই দুঃখজনক। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ঘুরে দাঁড়ানোর মত ক্ষমতা রাখে। আমরা যারা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দেখে ক্রিকেটের প্রেমে পড়েছি, তাদের বিশ্বাস, পরের ওডিআই ওয়ার্ল্ড কাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আবার দেখা যাবে। ব্যাবিলনের দাবানল স্তিমিত হতে পারে। কিন্তু নিভে যেতে পারে না।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।