ছাপ্পানো হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে ক্রিকেট কেবল একটি খেলা নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। ক্রিকেট বাংলাদেশিদের আবেগের নাম। ক্রিকেট মিশে আছে এদেশের মানুষের অস্থিমজ্জায়, রক্তকণিকায়। তাইতো হোক পুরুষ কিংবা নারী, জাতীয় দল কিংবা বয়সভিত্তিক; বাংলাদেশ পৃথিবীর যে প্রান্তেই খেলুক সে বিষয়ে জানার আগ্রহের কমতি থাকে না। যেকোনো প্রান্তেই ক্রিকেটে বাংলাদেশের জয় আন্দোলিত করে কোটি প্রাণকে। বড় জয় কিংবা অর্জনের জয়োল্লাসে নেচে ওঠে ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল। ভরদুপুর কিংবা গভীর রাত; মিছিল বের হয় বিজয়ের, উল্লাসের। আবার ব্যর্থতায় মুষড়ে পড়ে তারা। স্বজন হারানোর বেদনার মতো হু হু করে ওঠে ভেতরটা।
এমন একটি ক্রিকেটপাগল জাতি বিশ্বকাপে খেলবে সেই স্বপ্ন ছিল অনেক পুরনো। আরাধ্য স্বপ্ন। কিন্তু স্বপ্নের সেই পথ স্বপ্নের মতো মসৃণ ছিল না। ছিল অনেক চড়াই-উৎরাই। অনিশ্চয়তা আর শঙ্কার গল্প।
১৯৭৫ সাল থেকে নিয়মিত বিশ্বকাপ আয়োজন করে বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি। কিন্তু বাংলাদেশ আইসিসির প্রথম কোনো ইভেন্টে অংশ নেয় ১৯৭৯ সালে। সে সময় সহযোগী দেশগুলোর বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করার মানদণ্ড ছিল আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়া। সেবার ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফিতে অংশ নিয়ে ‘বি’ গ্রুপে কানাডা ও ডেনমার্কের কাছে বাংলাদেশ হারলেও জয় পায় ফিজি ও মালয়েশিয়ার বিপক্ষে। ফিজিকে ২২ রানে ও মালয়েশিয়াকে হারায় ৭ উইকেটে। আইসিসি ট্রফির সেই আসরে বাংলাদেশের সৈয়দ আশরাফুল হক ১০ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারিদের তালিকায় চতুর্থ স্থানে ছিলেন।
১৯৮২ সালের আইসিসি ট্রফির পরের আসরেও অংশ নেয় বাংলাদেশ। এবার অবশ্য বেশ ভালো করে। ১৬ দলের সেই আসরে গ্রুপপর্বে বাংলাদেশ ৭ ম্যাচ খেলে ৪টিতে জয় পায়, ১টিতে হার মানে ও ২টি ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়। তাতে ২০ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ রানার্স-আপ হয়ে সেমিফাইনালে উন্নীত হয়। অবশ্য সেমিফাইনালে শক্তিশালী জিম্বাবুয়ের কাছে ৮ উইকেটের বড় ব্যবধানে হেরে বিদায় নেয়। ব্যর্থ হয় বিশ্বকাপে জায়গা করে নিতে।
১৯৮৬ সালে যথারীতি আবার আইসিসি ট্রফিতে অংশ নেয় বাংলাদেশ। এবার অবশ্য সুবিধা করতে পারেনি। ৬ ম্যাচের মাত্র ২টিতে জিতে ও ৪টিতে হেরে সাত দলের মধ্যে ষষ্ঠ হয়ে গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নেয়।
১৯৯০ সালে চতুর্থবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা পরিমাপের টুর্নামেন্টে অংশ নেয় বাংলাদেশ। প্রথম রাউন্ডে কেনিয়া, ফিজি ও বারমুডাকে হারিয়ে তিন ম্যাচের তিনটিই জিতে পূর্ণ ১২ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে যায় লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। পরের রাউন্ডে ‘বি’ গ্রুপ থেকে ৩ ম্যাচের ২টিতে জিতে দ্বিতীয়বারের মতো সেমিফাইনালেও যায়। যদিও সেমিতে আবার সেই জিম্বাবুয়ের কাছে ৮৪ রানের ব্যবধানে হেরে বিদায় নেয় মিনহাজুল আবেদিন নান্নুরা। আবারও স্বপ্নভঙ্গ হয় বিশ্বকাপে খেলার।
১৯৯৪ সালে পঞ্চমবারের মতো আইসিসি ট্রফিতে অংশ নেয় বাংলাদেশ। সেবার প্রথম রাউন্ডে আর্জেন্টিনা, ইস্ট অ্যান্ড সেন্ট্রাল আফ্রিকা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে যায়। পরের রাউন্ডে হংকংয়ের বিপক্ষে জিতে এবং নেদারল্যান্ডস ও কেনিয়ার বিপক্ষে হেরে বিদায় নেয় লাল-সবুজের পতাকাবাহীরা।
১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ায় আয়োজিত আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সপ্তমবারের মতো অংশ নেয় বেঙ্গল টাইগাররা। এবার শুরুটা হয় দুর্দান্ত। প্রথম রাউন্ডে ডেনমার্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আয়োজক মালয়েশয়া, পশ্চিম আফ্রিকা ও আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে পাঁচ ম্যাচের পাঁচটিই জিতে পরের রাউন্ডে যায়।
দ্বিতীয় রাউন্ডে হংকংকে ৭ উইকেটে, নেদারল্যান্ডসকে ৩ উইকেটে, আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে পয়েন্ট ভাগাভাগি করে তৃতীয়বারের মতো সেমিফাইনালে যায়। সেমিফাইনালে স্কটল্যান্ডকে ৭২ রানের বড় ব্যবধানে উড়িয়ে দিয়ে প্রথমবারের মতো ফাইনালে নাম লেখায় বাংলাদেশ। ১২ এপ্রিল কুয়ালালামপুরের কিলাত ক্লাব মাঠে ফাইনালে কেনিয়ার মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। বৃষ্টির কারণে যে ফাইনালটি অনুষ্ঠিত হয় দুইদিন ব্যাপী।
কেনিয়া আগে ব্যাট করে স্টিভ টিকোলোর অনবদ্য ১৪৭ রানের ইনিংসে ভর করে ৭ উইকেটে ২৪১ রান তোলে। বৃষ্টির কারণে পরদিন ডার্কওয়ার্থ লুইস তথা বৃষ্টি আইনে বাংলাদেশের সামনে জয়ের লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ২৫ ওভারে ১৬৬ রান। সেই রান তাড়া করতে নেমে ১৫১ রান তুলতে ৮ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। ক্রিজে থাকা খালেদ মাসুদ পাইলটের সঙ্গে এসে যোগ দেন হাসিবুল হোসেন শান্ত। তারা দুজন দলকে এগিয়ে নিতে থাকেন জয়ের বন্দরের দিকে।
জিততে ২৫তম ওভারের শেষ বলে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল ১ রান। স্ট্রাইকে ছিলেন হাসিবুল। বোলার ছিলেন মার্টিন সুজি। তার করা শেষ বলটি খেলতে পারেননি বাংলাদেশের পেসার। বল তার প্যাডে লাগতেই প্রান্ত বদল করতে ভোঁ দৌড় দেন হাসিবুল ও পাইলট। যে দৌড়ে নতুন এক ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো জায়গা করে নেয় ক্রিকেট বিশ্বকাপে। ২৫ বছর ধরে ক্রিকেট খেলা স্বাধীন বাংলাদেশের এটা ছিল প্রথম কোনো শিরোপা জয়। যে জয়োৎসবের রঙে রঙিন হয়ে উঠেছিল ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল। সেই থেকে আমরা বিশ্বকাপে। সেই পথ বেয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট আজকের এই অবস্থানে।