ইতিহাস এভাবেই বুঝি খুঁজে পায় ঠিকানা। ঘুরে ফিরে পেয়ে যায় গন্তব্য। এরপর মিলেমিশে হয়ে যায় একাকার। যে সম্পর্ক এক সুঁতোয় বাঁধা থাকে তার মেলবন্ধন কখনো না কখনো হবেই। একটু দেরিতে হলেও হবে। খুব দ্রুত হলেও হবে।
এই যেমন দিল্লিতে বিশ্বকাপ মঞ্চে প্রয়াত রমন লাম্বার সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেটের মেলবন্ধন হয়ে গেল। অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামের হোম ড্রেসিংরুম ২০১৭ সালে ভারতের সাবেক ক্রিকেটার রমন লাম্বার নামে নামকরণ করে দিল্লি অ্যান্ড ডিস্ট্রিক্ট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল দুই বছর পর ভারতের এই স্টেডিয়ামে প্রথমবার পা রাখে। কিন্তু দ্বিপক্ষীয় সিরিজে মাহমুদউল্লাহ-মুশফিক-সৌম্যদের ঠিকানা হয় অ্যাওয়ে ড্রেসিংরুম।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশ নিজেদের অষ্টম ম্যাচ খেলবে ১৮৮৩ সালে চালু হওয়া স্টেডিয়ামে। যেখানে লাল-সবুজের প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা। হোম টিম হিসেবে বাংলাদেশের ঠিকানা হয়েছে রমন লাম্বা ড্রেসিংরুমে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচের আগে বাংলাদেশ দল গতকাল অনুশীলন করে দিল্লিতে। ড্রেসিংরুমের বাইরে ‘রম্বন লাম্বা ড্রেসিংরুম’ মাইলফলকের পাশে লাল সবুজের পতাকাও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। লম্বা সময় পর আবার বাংলাদেশ ক্রিকেটের সঙ্গে মিলে গেলেন লাম্বা।
লাম্বার সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেটের যোগসূত্র বেশ পুরোনো। অসম্ভব গভীর। সুখস্মৃতিতে মোড়ানো। কিন্তু দুঃস্মৃতিতে পরিসমাপ্তি!
ভারতের হয়ে চার টেস্ট, ৩২ ওয়ানডে খেলা এক ক্রিকেটার লাম্বা। ভারতীয় ক্রিকেটে এসেছিলেন অনেক প্রতিশ্রুতি নিয়ে। তার অভিষেকটাও যথেষ্ট ঈর্ষনীয়ভাবে হয়েছিল। ১৯৮৬-৮৭ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ছয়টি একদিনের ম্যাচে একটি সেঞ্চুরি এবং দুটো হাফ হাফসেঞ্চুরি করেছিলেন। কিন্তু, পরের পাঁচটা একদিনের ম্যাচে তিনি মাত্র ৮ রান করতে পেরেছিলেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে তার আধিপত্য বজায় থাকলেও চারটে টেস্ট ম্যাচে তিনি কিছুই করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত নিতান্তই ভাড়াটে ক্রিকেটার, যিনি খেলে বেড়িয়েছেন আয়ারল্যান্ড-বাংলাদেশের ক্লাব ক্রিকেটে।
আশির দশকের ভারতের ক্রিকেটের অন্যতম সেরা তারকা, বাংলাদেশে ঘরোয়া ক্রিকেটে ‘ঢাকার ডন’ নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন। বাংলাদেশের ঘরোয়া লীগে তখন যে কয়কজন বিদেশী ক্রিকেটার খেলতে আসতেন, লাম্বা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রায় ৯ বছর তিনি বাংলাদেশের ঘরোয়া লীগে নিয়মিত খেলেছেন। কিন্তু তার শেষটা হয়েছে বিষাদমাখা।
১৯৯৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। ঢাকা লিগে মুখোমুখি হয়েছিল আবাহনী ও মোহামেডান। আবাহনীর হয়ে মাঠে নেমেছিলেন লাম্বা। আবাহনী তখন জয়ের দ্বারপ্রান্তে। ক্রিজে মেহরাব হোসেন অপি। অধীর আগ্রহে শেষ উইকেটের অপেক্ষা করছেন লাম্বা। একেবারে শর্ট ফাইন লেগে চলে এলেন। শফিউল্লাহ খানের খাটো লেন্থের বলে পুল করলেন অপি। বল গিয়ে লাগল লাম্বার মাথায়।
লাম্বার মাথায় লেগে ফেরত আসা বল ক্যাচ নিয়ে আবাহনীকে জয়ের স্বাদ দেন পাইলট। কিন্তু ততক্ষণে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন লাম্বা। পরে হেঁটে ড্রেসিংরুমেও গিয়েছিলেন। কিন্তু ড্রেসিংরুমে ফিরেই বমি করে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। আর কোনোদিন জ্ঞান ফেরেনি তার।
পাইলট তাকে হেলমেট পরার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে রমন জানান যে ‘একটি বলই তো আর বাকি আছে, কোনও অসুবিধা হবে না।’ ওই খামখেয়ালিতেই সব শেষ। মস্তিষ্কের বাঁদিকে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছিল। সেটা অপারেশনও করা হয়। দিল্লি থেকে এক চিকিৎসককেও উড়িয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু লাম্বা সবাইকে ফাঁকি দিয়েছেন। তিনদিন হাসপাতালের বিছানায় কোমায় পড়ে ছিলেন। কৃত্রিমভাবে যন্ত্রের সাহায্যে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। পরে পরিবারের সম্মতিতেই সেই যন্ত্র খুলে দেন চিকিৎসকেরা্। নিথর হয়ে যান লাম্বা।
তার আইরিশ স্ত্রী কিম ঢাকায় এসে স্বামীর মৃতদেহ গ্রহণ করেছিলেন। বাংলাদেশে চিকিৎসার অব্যবস্থাপনার অভিযোগও করা হয়েছিল পরিবারের পক্ষ থেকে। কিন্তু ততক্ষণে তো দূর আকাশের তারা হয়ে গিয়েছেন রমন লাম্বা।
বাংলাদেশ কিংবা আবাহনী কেউ রমন লাম্বাকে মনে রাখেনি। তার মৃত্যুর পূর্তির দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি আবাহনী নামটি পর্যন্ত মুখে নেয় না। কীর্তিমানের মৃত্যুর পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল তার নামে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের একটি বোলিং প্রান্তের নামকরণ হবে। ওই আলোচনা পরবর্তীতে বোর্ড কর্তাদের টেবিল পর্যন্ত গড়িয়েছিল কিনা কেউ বলতে পারে না।
লাম্বার স্ত্রী কিম দুই সন্তান জেসমিন ও কামরানকে নিয়ে আয়ারল্যান্ডের পর এখন পোলান্ডে থিতু হয়েছেন। দিল্লিতে তাদের আনাগোনা একদমই কম। লাম্বার নামে ড্রেসিংরুম উদ্বোধনীতে তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু পরিবারের কেউ যোগ দেননি। সেই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন তার বড় বোন সুনিতা, ছোট বোন অনিতা ও ভাই অজিত লাম্বা। কয়েক বছর আগে একটি ভারতীয় পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কিম বলেছিলেন, ‘ক্ষতটা খুব গভীর, শূন্যতা বিশাল।’ কেন-ই বা হবে না?
সার্কাসের ট্রাপিজের খেলার মতো ক্রিকেটও বিপজ্জনক। ওখানে সরু সুতোয় ঝুলে থাকে জীবন-মৃত্যু। এখানেও তাই। একটু খামখেয়ালি হলেই সব শেষ। এই হাসিখুশি জীবন, তো এই মৃত্যু!
রমন লাম্বার ড্রেসিংরুমে ঢুকে বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবেই খুঁজে বেড়াবে দেশের প্রথম বিদেশি মহাতারকাকে যিনি বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন একটা হাওয়াও বইয়ে দিয়েছিলেন। রাশি রাশি রান আর উদ্বুদ্ধ করা প্রেরণাদায়ী বার্তা দিয়ে। যা ওই সময়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে শুরু করা বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য অমূল্য।