খেলাধুলা

সেরার মঞ্চে ‘ট্রু চ্যাম্পিয়ন’ হয়েই সাকিবের প্রস্থান

সাকিব আল হাসানকে প্রথম দেখার দিনটা এখনো ভুলতে পারেন না হাবিবুল বাশার। হাবিবুল তখন জাতীয় দলের অধিনায়ক। সাকিবরা কেবলই এসেছেন বিসিবির আওতায়। বিসিবির অফিস তখন গুলশানের নাভানা টাওয়ারে। কোনো কাজে হাবিবুল গিয়েছিলেন বিসিবিতে। সাকিবদের ব্যাচ তখন বিসিবির অফিসেই।

পরে কি হলো শুনুন হাবিবুলের কণ্ঠে, ‘২০০৬ সালে নাভানা টাওয়ারে প্রথম সাকিবকে দেখেছি। কতগুলো তরুণ ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ঢুকছি। সালাম দিলো সবাই (হাসি)। তখন তো ঘরোয়া ক্রিকেটে তেমন হতো না। কিন্তু শুনেছিলাম যে ওর (সাকিব) সঙ্গে কতগুলো খেলোয়াড় খুব ভালো খেলছে আর কি।’

‘তখন আমাদের দলটা পরিবর্তন হওয়া শুরু হয়েছে কেবল। সাকিব, মুশফিক, তামিম আসলো। আমরা কিছু সিনিয়র খেলোয়াড় ছিলাম একসঙ্গে। ওরা আসার পর পুরো দলের খেলার ধরণ পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। নিশ্চিতভাবেই তারা মাঠেই নামত জয়ের জন্য। সাকিবের আগমন দলে ভারসাম্য এনে দিয়েছিল। ব্যাটিং হোক বা বোলিং।’ – যোগ করেন হাবিবুল।

এরপর খুলনা বিভাগীয় দলের হয়ে একই জার্সিতে দেখা যায় হাবিবুল-সাকিবকে। কয়েক মাসের ভেতরে জাতীয় দলের জার্সিতে। হাবিবুলের হাত ধরেই সাকিবের অভিষেক, ‘জিম্বাবুয়ে সিরিজে প্রথম খেলালাম জাতীয় দলের হয়ে। তখন মেহরাব জুনিয়র ওর থেকে বেশি আলোচনায় ছিল। মেহরাব জুনিয়রকে বলা হচ্ছিল ভবিষ্যৎ। কিন্তু আমি দুজনের কাউকেই বেশি চিনতাম না। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওই সিরিজের পর আমার মনে হচ্ছিল সাকিব ভিন্ন কেউ। বাকিদের থেকে একটু আলাদা ছেলে।’

কেন আলাদা মনে হয়েছিল সেই ব্যাখ্যাও দিলেন হাবিবুল, ‘আমরা তো আলাদা বিচার করি…শুধু তো স্কিল নয়, মানসিক শক্তির দিকটাও। সাথে খেললে বোঝা যায়। কার কতোটা মানসিক শক্তি কিংবা কার কতোটা স্কিল রয়েছে। বড় জায়গায় গিয়ে ওর স্কিলটা ভালো হবে। ওই সিরিজেই বুঝতে পারছিলাম। তাই বাকিদের চেয়ে আলাদা লাগছিল।’

সেখান থেকে সাকিবকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কখনো পারফরম্যান্সের কারণে দল থেকে বাদ পড়েননি। কখনো আলোচনার আড়ালে থাকেননি। ২০০৬ সালের আগস্টে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ট্রেনে উঠেছিলেন। দেখতে দেখতে সেই ট্রেন নানা গন্তব্য পেরিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে সতেরো বছর। নানা উত্থান-পতন, অলিগলি, সাফল্য ব্যর্থতা মিলিয়ে কেটেছে তার এই অফুরন্ত সময়। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই কাল পেরিয়ে সমকালে চিরঞ্জীব থাকতে যতটুকু করে দেখানোর দরকার ছিল ততটুকু কিংবা তারচেয়ে বেশিই করেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের ধ্রুবতারা। তাই তো ইতিহাসের অক্ষয় কালিতে লেখা হয়ে গেছে তার নাম। 

এবারের ভারত বিশ্বকাপে তার থেকে প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী। কিন্তু বাংলাদেশের অধিনায়ক নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। দিল্লিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২ উইকেট ও ৮২ রানের আগে সাকিব রান করেছিলেন কেবল ১০৪। তার পারফরম্যান্সের শূন্যতায় দলও ভুগেছে। আট ম্যাচে জয় কেবল দুটি। সেমিফাইনাল খেলার লক্ষ্য নিয়ে আসলেও তা পূরণ হয়নি। বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচে পুনেতে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু এই ম্যাচে সাকিবকে পাচ্ছে না বাংলাদেশ। আঙুলে চিড় ধরা পড়ায় তাকে ফেরত পাঠানো হয়েছে দেশে। তাহলে কি বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচ খেলে ফেলেছেন সাকিব? দিল্লিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটিই কী শেষ হয়ে থাকল?

হাবিবুলের হাত ধরেই ২০০৭ বিশ্বকাপে যাত্রা শুরু করেছিলেন সাকিব। এরপর ২০১১, ২০১৫, ২০১৯ এবং ২০২৩ বিশ্বকাপ খেললেন। সাকিবের প্রথম অধিনায়ক অবশ্য তার শেষ দেখছেন না। যদিও বিশ্বকাপে আসার আগে এক সাক্ষাৎকারে সাকিব বলেছিলেন, ‘'আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার আমি যদি দেখি, এখন পর্যন্ত, ২০২৫-এর চ্যাম্পিয়নস ট্রফি (ওয়ানডের জন্য)।' তবুও হাবিবুল বললেন, ‘ইউ নেভার নো। স্পোর্টসম্যানদের জীবনটা আসলে কেমন, পরিস্থিতি অনুযায়ী ভাবনার বদল হয়। অতীতে আমরা অনেক বড় স্পোর্টসম্যানদের দেখেছি নিজেদেরকে পুশ করে পরের ধাপে নিয়ে যায়। তাই টু আর্লি টু কল। অনেক পরের বিষয় এটা। এখনই সাকিবের উপসংহার টানা ঠিক হবে না।’

ব্যাটিংয়ে ১৩৩২ রান ও বোলিংয়ে ৪৩ উইকেট নিয়ে অলরাউন্ড নৈপুণ্যে সাকিব বিশ্বকাপের অন্যতম সেরাদের কাতারে। ২০১৯ বিশ্বকাপে সাকিব যা করেছেন তা করতে পারেনি ক্রিকেট বিশ্বের কেউ। ৮ ম্যাচে ব্যাট হাতে ৮৬.৫৭ গড়ে ৬০৬ রান করার পাশাপাশি বল হাতে ১১ উইকেট। বিশ্বের একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে বিশ্বকাপের এক আসরে কমপক্ষে ৫০০ রান ও অন্তত ১০ উইকেট নেওয়ার বিশ্বরেকর্ড গড়েন।

বাংলাদেশের ক্রিকেটের অবাক রাজপুত্তুরের অতিমানবীয় কীর্তির কারণে তাকে সব সময় চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটার বলে আসছেন হাবিবুল। পুনেতে দলের টিম হোটেল জে ডব্লিউর ম্যারিয়টে লবিতে বসে আরো একবার সাকিবকে স্তৃতিতে ভাসালেন, ‘এজন্য আমি তাকে সব সময় ট্রু চ্যাম্পিয়ন বলি। ২০০৭ বিশ্বকাপে প্রথম খেললো, তখনেই তার মধ্যে ওই জেলটা দেখতে পেয়েছিলাম। ইংল্যান্ডের সঙ্গে একটা ইনিংস খেলেছিল খুব কঠিন কন্ডিশনে। ২০০৭ সালেই নিজেকে চিনিয়েছিল। নিজের জাত বুঝিয়েছিল। ২০০৮-০৯ এর দিকে পুরোপুরি নিজেকে মেলে ধরে। ২০১৯ বিশ্বকাপ ওর সবচেয়ে ভালো বিশ্বকাপ। কিন্তু যখনই খেলে সেটা বিশ্বকাপ হোক, কোনো দ্বিপক্ষীয় সিরিজ হোক বা টুর্নামেন্ট হোক; ও কিন্তু সেরাদের কাতারেই থাকে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বাকি যারা আছে তাদের সঙ্গে সেরাদের কাতারে থাকে।’

‘ট্রু চ্যাম্পিয়ন বেসিক্যালি। আগের থেকে মানসিকভাবে খুব শক্ত ছিল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে গেলে শুধু ব্যাটিং বোলিং দিয়ে হয় না। মানসিক জোর প্রচন্ড কাজে লাগে। সে হচ্ছে সেই বড় খেলোয়াড়দের মতো যারা খেলাটাকে পরের ধাপে নিয়ে গেছে। যেমন টেন্ডুলকার, লারা, কোহলিরা। যাদের সামর্থ্যের মধ্যে একটা এক্স ফ্যাক্টর থাকে। সাকিবের মধ্যে ওই এক্স ফ্যাক্টরটা আছে। ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় বড় ম্যাচ, বড় খেলা চাপের মুহূর্তে সব সময় নিজেকে নিংড়ে দেওয়ার একটা তাড়না থাকে ওর। সফলতার হারটাও বেশি তার। ভিন্ন খেলোয়াড়।’ -যোগ করেন হাবিবুল।

শেষের গল্পে যেন খানিকটা আক্ষেপ ঝরলো বিশ্বমঞ্চে সাকিবকে প্রথমবার আগলে রাখা অধিনায়কের কণ্ঠে, ‘এই বিশ্বকাপ অনেক কঠিন ছিল। তবে ওর স্ট্যান্ডার্ডে আরো ভালো করতে পারতো নিশ্চিতভাবেই। একটা ম্যাচে করলো তো।’

আরেকটি বিশ্বকাপে সাকিবকে দেখা যাবে কিনা সেই আলোচনা সময়ের কাছেই তোলা থাক। বাঁহাতে স্পিন ও ব্যাটিংয়ে ক্রিকেট বিশ্বকে লম্বা সময় ধরে বুদ করে রাখা, বিমুদ্ধ করা ও হাজারো তরুণকে ক্রিকেটের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ানোর জন্য ফুলের মালায় সিক্ত হতে পারেন সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার।