গ্লেন ফিলিপস তখন মারমুখী। উইকেটের চারিপাশে শট খেলছিলেন। দ্রুত রান তোলার প্রয়োজন ছিল। দলের চাহিদা পূরণ করছিলেন। নাজমুল হোসেন শান্ত তাকে আটকানোর পথ খুঁজতে গিয়ে বোলিংয়ে আনেন মুমিনুল হককে।
‘ম্যান উইথ গোল্ডেন আর্ম’ - মুমিনুল দ্বিতীয় ওভারে ফেরান ফিলিপস। বাঁহাতি স্পিনারের ঘূর্ণিতে স্লিপে শান্তর হাতেই ক্যাচ দেন ফিলিপস। ক্যাচ নিয়ে অধিনায়কের শূন্যে লাফ দেওয়ার দৃশ্যর সারাংশ টানা যায় এভাবে, ‘প্ল্যান ওয়ার্কস।’
মুমিনুল আর শান্তর সেই পরিকল্পনা শুধু তখন-ই দেখা যায়নি। উইলিয়ামসন যেন রান খুঁজে নিতে না পারেন সেজন্য আক্রমণাত্মক ফিল্ডিং সাজিয়েছিলেন দুজন। সাবেক অধিনায়ক মুমিনুল বেশ স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে শান্তকে পরামর্শ দিতে এগিয়ে গেছেন। দেখা যায়, মুমিনুল কভারে ফিল্ডিং করছেন। শান্ত স্লিপে। প্রথমবার অধিনায়কত্ব করতে নামা শান্তর কাছে দৌড়ে গিয়ে তাকে পরামর্শ, টিপস দিয়ে আসছেন মুমিনুল। কেবল মুমিনুলই নয় মুশফিকুর রহিমকেও দেখা গেছে একই কাজ করতে। আবার কখনো শান্তর ডাকে তারা দুজনই দিয়েছেন সাড়া।
মাঠে তিনজনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রস্তুতি, সাবলীল মানসিকতা, সক্রিয় মনোভাব এবং স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কার্যক্রম দলকে এগিয়ে নিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছে তা বোঝা যায় দলীয় বোঝাপড়ায়। দলের প্রয়োজনে, অধিনায়কের প্রয়োজনে এমন ‘উদার’ মানসিকতা দেখিয়েছেন বলেই জানালেন মুমিনুল।
তার ভাষ্য, ‘অধিনায়কের অনেক সময় অনেক কিছু মিসিং হয়, হ্যাং (মাথা কাজ করে না) হয়ে যায় অনেক সময়। ওইটা দায়িত্ব সিনিয়র খেলোয়াড় হিসেবে এগিয়ে আসা।’ মুমিনুল ৫৮তম টেস্ট খেলছেন সিলেটে। মুশফিকের টেস্ট নম্বর ৮৭। তাদের পর এই দলে অভিজ্ঞতায় এগিয়ে তাইজুল। এরপর মিরাজ ও শান্ত।
স্বাভাবিকভাবেই মুমিনুল ও মুশফিক এগিয়ে না আসলে শান্তর কাজ চালিয়ে যাওয়াটা কঠিন হতো। সেই পথ মসৃণ করে দিয়েছেন তারা। প্রশ্ন উঠেছে, মুমিনুল অধিনায়ক থাকাকালীন সময়ে এমন স্বতঃস্ফূর্ত পরিবেশ পেয়েছিলেন কিনা? মুমিনুলের দাবি, ‘না মিসিং ছিল না। কোনোভাবেই মিসিং ছিল না।’ কিন্তু মুনিনুল জানাতে ভুল করলেন না, সিনিয়র ক্রিকেটারদের তিনি দলে পাননি তার পথ চলায়, ‘আমার সময়ে যদি দেখেন, সিনিয়র যারা ছিল তারা কিন্তু ছিল না ওইভাবে। এটা একটা ফ্যাক্ট সেটা বুঝতে হবে।’ নানা সময়ে, নানা কারণে সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালকে পাননি। কখনো ইনজুরির সমস্যা। কখনো ব্যক্তিগত। তাতে অস্বস্তির ফরম্যাটে তার লড়াইটা ছিল প্রায় একার। মুমিনুল বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ১৭ টেস্টে। মুশফিকুর রহিম ও সাকিবের পর তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জিতেছে ৩টি। এ সময়ে নিউ জিল্যান্ডের মাটিতে তাদেরকে হারানোর কীর্তিও রয়েছে যা বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবে ধরা হয়।
মুমিনুল তার ১৭ টেস্টের নেতৃত্বে সাকিবকে পেয়েছেন ৫ ম্যাচে। দেশের মাটিতে ৪টি। বাইরে ১টি। তামিম খেলেছেন ৯ ম্যাচে। দেশের মাটিতে ৫টি, বাইরে ৪টি। মুশফিক খেলেছেন সর্বোচ্চ ১৫ ম্যাচ। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ এক টেস্ট খেলার পরই নিয়ে নেন অবসর। এই চারজন বাদে মুমিনুলের চেয়ে বেশি টেস্ট খেলেননি কেউ। মুমিনুল দলের দায়িত্ব পেয়েছিলেন দেশের ক্রিকেটে যেদিন প্রলয়ঙ্করী ঝড় বয়েছিল। ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব গোপন করায় আইসিসি সাকিবকে এক বছর সব ধরণের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করে। টেস্ট ক্রিকেটের নেতৃত্ব তখন তার কাঁধে। এ ফরম্যাটে তখন নিয়মিত খেলছেন কেবল মুমিনুল । যার নামের পাশে ‘টেস্ট স্পেশালিষ্টের’ খেতাবও যুক্ত হয়ে যায়। বিসিবি তাকেই সাদা পোশাকে অধিনায়ক হিসেবে বেছে নেন।
কিন্তু অধিনায়ক হওয়ার জন্য কি মুমিনুল প্রস্তুত ছিলেন? নিজের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে মুমিনুল অকপটে বলেছিলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি আমি অধিনায়কত্ব করবো, সেজন্য মোটেও প্রস্তুতই ছিলাম না। কখনো ভাবিওনি বাংলাদেশের অধিনায়ক হবো।’ অপ্রস্তুত সেই অধিনায়ক পরবর্তী দুই বছরে হয়ে উঠেন ‘খলনায়ক’।
দলকে ঠিকঠাক মতো পরিচালনা করতে পারেননি। সঙ্গে তার ব্যাটে রানখরা। দ্বিমুখী চাপে প্রবলচাপে পিষ্ট মুমিনুল বাধ্য হয়ে দায়িত্বই ছেড়ে দেন। অধিনায়ক হিসেবে সতীর্থদের উদার মানসিকতা ও সিনিয়রদের সহযোগিতা কতটা প্রয়োজনীয় মুমিনুলের কথায় তা ফুটে উঠল, ‘আপনি যখন একটা দল হয়ে খেলবেন...আপনি যখন ঘরে থাকবেন, আপনার ঘরে যখন সিনিয়র কেউ থাকবে...যদি কিছু হয় আপনার না চাইলেও নিজের থেকে এগিয়ে আসা উচিত। যদি আপনি না আসেন তাহলে আপনি কাজের প্রতি অসম্মান করছেন। অধিনায়কের নেয়া না নেয়াটা ওর ব্যাপার।’ শান্তকেও ঠিক একই ভাবনা থেকে সহযোগিতা করেছেন মুমিনুল, ‘আমি তো অনেকগুলো টেস্ট খেলিছি। মুশফিক ভাইও আমার থেকে বেশি টেস্ট খেলেছে। মুশফিক ভাই আর আমি বলেছি ওকে। আমার মনে হয় লিডার হিসেবে ও ভালো। যেটা ভালো বোঝে সেটাই করে। ভেতরের জিনিসগুলো বোঝে। ’
মুমিনুলের নেতৃত্বকালীন দল ফল না পেলেও সামগ্রিক কিছুর পরিবর্তন হয়েছিল। পেসারদের ব্যাক করার, নিয়মিত খেলানো এবং একাধিক পেসার নিয়ে মাঠে নামার চর্চা মুমিনুল করেছিলেন। যার ফল বাংলাদেশ ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টিতেও পেয়েছিল। খেলোয়াড়দের পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া, সহজেই আস্থা না হারানোর কাজটাও তিনি করেছিলেন। কিন্তু ফল দিয়েই সাফল্য বিচার করা হয় বলে মুমিনুলকেও কাটা পড়তে হয়। সাকিবের হাত ঘুরে শান্ত এখন দায়িত্বে। মুমিনুল খোলামনেই শান্তর পাশে আছেন। যখন তখন প্রয়োজন হলেই পাওয়া যাবে। থাকবেন শান্তর ছায়া হয়ে। অধিনায়ক না হয়েও থাকবেন আনসাং হিরো হয়ে।