খেলাধুলা

‘উপরে হাত না থাকলে পাকিস্তানে ক্রিকেট খেলা যায় না, ওমান গিয়ে পিয়নের চাকরি করেছি’

ক্রিকেটের সহযোগী দেশ ওমানের হয়ে পেস বোলিংয়ে ঝাণ্ডা উড়াচ্ছেন। তবে, বিলাল খান আদতে ওমানি নন। পেসারদের আঁতুড়ঘর পাকিস্তানের পেশোয়ারে জন্ম। বড় ভাইয়ের কাছ থেকে বোলিং শেখা বিলাল বালক বয়সে ভাইকেও ছাড়িয়ে যান। কিন্তু সুযোগ মেলে না পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটে। ‘ক্রিকেট রাজনীতির’ শিকার হয়ে একটা সময় দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।   

বিলাল এখন ওমানের হয়ে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে সর্বোচ্চ উইকেটধারী। তার আশপাশেও কেউ নেই। প্রথমবারের মত বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) খেলতে এসেছেন। চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের হয়ে ছয় ম্যাচে ৯ উইকেট নিয়ে আছেন শীর্ষ উইকেট সংগ্রাহকের তালিকায়। ক্রিকেটের জন্য দেশত্যাগসহ জীবনের বাঁকবদল নিয়ে বিলালের সঙ্গে সিলেট আউটার স্টেডিয়ামের ড্রেসিংরুমে রাইজিংবিডির একান্ত আলাপ হয়। পাঠকদের জন্য চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো…   

রাইজিংবিডি: প্রথমবার বিপিএল খেলছেন, কেমন লাগছে?  বিলাল খান: আমি এবার প্রথম বিপিএল খেলতে এসেছি। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আমি এখানে এসে পারফর্ম করতে পারছি। এ কারণে খুব খুশি। আমি কঠোর পরিশ্রম চালিয়ে যেতে চাই। এই পারফরম্যান্স পুরো বিপিএলজুড়ে ধরে রাখতে চাই। আর আমি সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাব। 

রাইজিংবিডি: বোলিংয়ে আপনার মূলমন্ত্র কী?  বিলাল খান: আমার কাছে মনে হয় মূল বিষয়টা সাধারণ হিসেবে রাখতে হবে। কোনও প্রেডিক্ট করা যাবে না। জাস্ট কিপ ইট সিম্পল। আমি বল দ্রুত করার চেষ্টা করি না কেন, অতিরিক্ত কিছুর চেষ্টা করি না। আমি ঠিক জায়গায় বল ফেলার কাজটা করে যাচ্ছি। প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করি নেটে। ম্যাচে আসলে ম্যাচের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিই। দিনশেষে ক্রিকেট মাইন্ডগেম। আমি গতির বলও করতে পারি, কিন্তু এখানে উইকেট কিছুটা স্লো। ফিঙ্গার ব্যবহার করে সাফল্য পাওয়ার চেষ্টা করি।

রাইজিংবিডি: ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন ক্রিকেটার, মানিয়ে নিচ্ছেন কীভাবে?   বিলাল খান: সত্যি কথা বলতে, আমার সতীর্থরা অনেক ভালো। তারা আমাকে অনেক আগ থেকে চিনেন। বাংলাদেশের বিপক্ষে এর আগেও খেলেছি। তারা আমার সম্পর্কে ভালোই জানেন। এটা আমার জন্য অনেক ভালো দিক। আমি যথেষ্ট সম্মান পাচ্ছি। 

রাইজিংবিডি: আপনার জন্ম পাকিস্তানের পেশোয়ার। খেলছেন ওমানের হয়ে, কীভাবে সম্ভব? বিলাল খান: আমি পেশোয়ার, পাকিস্তান থেকে এসেছি। আফগানিস্তানের উইকেটরক্ষক মোহাম্মদ শেহজাদের মাধ্যমে আমি আসি। সে জানায়, ওমানের একজন বোলার প্রয়োজন, তুমি ওখানে যাও। আমি একটি চাকরির ব্যবস্থা করে ওমানে গিয়ে ক্রিকেট খেলা শুরু করি। আইসিসির একটি নিয়ম রয়েছে, কোনও দেশের হয়ে খেলতে হলে ৩ বছর দেশটিতে অবস্থান করতে হয়। আমি সেটি পূর্ণ করি, এরপর সুযোগ পেয়ে যাই। 

রাইজিংবিডি: পাকিস্তান ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ। আপনি ইচ্ছে করে দেশ ছেড়েছেন, নাকি অন্যকিছু?  বিলাল খান: শেহজাদ যখন আমাকে জানায়, তখন আমি পাকিস্তানে ছিলাম। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলতাম কিন্তু সুযোগ পেতাম না। আমি খুব একটা সাপোর্টও পেতাম না। আপনি হয়ত জানো, সেখানে অনেক রাজনীতি জড়িত। আপনার যদি সাপোর্ট (উপরের লোকদের সঙ্গে সম্পর্ক) না থাকে, তাহলে আপনি ভালো ক্রিকেট খেলতে পারবেন না। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। আমার জন্য এ সমস্যা আরও প্রকট ছিল। 

রাইজিংবিডি: কোন ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন?  বিলাল খান: এটা বারবার বলতে চাই, আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। এখানে যদি সমর্থন না থাকে, পেশোয়ারের মত জায়গায় আপনি ভালো ক্রিকেট খেলতে পারবেন না। আমি অর্ধযুগে মাত্র ৬টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছি। বছরে একটি করে ম্যাচ পেয়েছি। ওখানকার শাস পেশোয়ার ক্রিকেট পছন্দ করতেন না। মাঝে রমিজ রাজার বোর্ড আসায় ঠিক হয়েছিল। এখন আবার আগের অবস্থা। এসব কারণে পাকিস্তানের অনেক ক্রিকেটার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছেন। 

রাইজিংবিডি: তার মানে, খেলার চেয়ে খেলার বাইরের বিষয় নিয়ে আপনাকে বেশি ভাবতে হয়েছে? বিলাল খান: প্রত্যেক দিন আমি খারাপ কিছুর মুখোমুখি হয়েছি। আপনি ভালো খেলে যাচ্ছেন, কিন্তু যথার্থ সুযোগ পাচ্ছেন না— এটা অনেক কষ্টের। এ কারণে পাকিস্তানের অনেক ক্রিকেটার বিভিন্ন দেশে খেলতে চলে যান। তারাও সুযোগ পান না।

রাইজিংবিডি: আপনি বলছিলেন, শুরুর দিকে ওমানে চাকরি করেছেন। কীসের চাকরি?   বিলাল খান: ভারতীয় একজনের মাধ্যমে আমার চাকরি শুরু। উনি এখন ভারতে থাকেন। কিন্তু আমার সঙ্গে উনার ভালো সম্পর্ক বজায় আছে। আমি পিয়ন হিসেবে একটি ব্যাংকে কাজ শুরু করি। ব্যাংকে নানা ধরনের কাজ থাকে, সেগুলো করতাম। জিনিসপত্র আনা-নেওয়া করা, ব্যাংকের টাকা ডিপোজিট করা— এসব। 

রাইজিংবিডি​​​​​​​: চাকরির পাশাপাশি ক্রিকেট কীভাবে চালিয়ে যেতেন?  বিলাল খান: সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চাকরিতে সময় চলে যেত। এরপর আমি মাঠে চলে যেতাম। প্রতিদিন চার থেকে ছয় ঘণ্টা বোলিং করতাম। শুক্রবার-শনিবার ম্যাচ খেলতাম। এটা খুব কঠিন ছিল। মাঝামাঝি সময়ে একটা বিরতি থাকত, দুঘণ্টার মতো। এ সময় জিম করতাম। এরপর আবার অফিসে গিয়ে বাকি সময়ের কাজ শেষ করতাম। অফিস শেষ হলে কখনও ট্যাক্সিতে, কখনও পায়ে হেঁটে অনুশীলনের জন্য যেতাম। ওমানের তাপমাত্রা অনেক বেশি ছিল, মাথা ঢেকে হাঁটা শুরু করতাম। মাথায় একটি বিষয় সব সময় কাজ করতো, আমাকে অনুশীলন করতে হবে। 

রাইজিংবিডি​​​​​​​: ওমানের হয়ে খেলার সুযোগ আসে কীভাবে? বিলাল খান: তিন বছর ওমানে অবস্থান করেছি। ঘরোয়া আর ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলেছি। যেখানে কাজ করতাম, তাদের হয়ে আমি টুর্নামেন্ট খেলতাম। এখানে ভালো করার পর ওমান জাতীয় দলে সুযোগ পাই। এরপর চাকরি ছেড়ে দিই। শুধু ক্রিকেটে ফোকাস করি।

রাইজিংবিডি​​​​​​​: ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু কীভাবে?  বিলাল খান: ক্রিকেট খেলা শুরু হয় আমার ভাইয়ের মাধ্যমে। উনার বয়স এখন ৪৫ বছর। ওই সময় আমাদের গ্রামে অনেক ভালো একজন বোলার ছিলেন। তিনি আমাকে সব সময় সাপোর্ট করতেন, জোর করতেন খেলার জন্য। আর বলতেন, একদিন ভালো করবে, খেলা চালিয়ে যাও। ভাইয়ের সমর্থনে আমি ক্রিকেট চালিয়ে যেতে থাকি, কঠোর পরিশ্রম শুরু করি। 

রাইজিংবিডি​​​​​​​: পরিবারসহ ওমানে বসবাস করেন, ওখানকার নাগরিকত্ব পেয়েছেন?  বিলাল খান: গত একবছর ধরে পরিবারসহ অবস্থান করেছি। পাসপোর্ট (নাগরিকত্ব প্রশ্নে) নেই, তবে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাই। গালফে এটা পাওয়া খুব কঠিন। কিন্তু আমার কোনও সমস্যা হচ্ছে না। বিষয়টা এমন, আপনি সব করতে পারবেন কিন্তু পাসপোর্ট পাবেন না (হাসি)।

রাইজিংবিডি​​​​​​​: ওমানে নিশ্চয়ই এখন ভালো আছেন?  বিলাল খান: আলহামদুলিল্লাহ, এখন অনেক ভালো আছি। পাকিস্তান না ছাড়লে এই জীবন পেতাম না। আমাকে উপরে উঠানোর জন্য আমার ভাই, ওমান ক্রিকেট বোর্ড চেয়ারম্যান ও সহকারী কোচ মাজহার সেলিমের অবদান ভুলবার নয়। 

রাইজিংবিডি​​​​​​​: ওমান জাতীয় দলে বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার অন্য দেশের। ওমানিদের আগ্রহ নেই ক্রিকেটে?  বিলাল খান: ওমান ক্রিকেটে দারুণ কাজ করছে। এখন হয়ত দলটিতে বাইরের ক্রিকেটার বেশি। কিন্তু নিকট ভবিষ্যতে আমরা ওমানিদেরই দেখতে পাব এই দলে। ঘরোয়া ক্রিকেটে ওমানিরা খেলছেন। তরুণরা আসছেন। এখন বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দল ওমানিদের মাধ্যমেই গড়া হয়েছে।  

রাইজিংবিডি​​​​​​​: আপনার বয়স এখন ৩৫, কোথায় থামতে চান?  বিলাল খান: আমি আরও তিন-চার বছর খেলতে চাই। এরপর পেস বোলিং কোচ হতে চাই। তবে আমার ফিটনেস যতদিন আছে, আমি খেলে যেতে চাই।