খেলাধুলা

হিরো থেকে জিরো, শান্তর বিভীষিকাময় বিপিএল

সেদিন রাতের আকাশ ঝলমলে হয়ে উঠেছিল তার জন্য। স্টেডিয়ামের হাজার বিশেক মানুষের একসঙ্গে করতালি। সতীর্থদের বাঁধভাঙ্গা উল্লাস। সবকিছুর কেন্দ্র বিন্দুতে ছিলেন। ছিলেন নয়নের মনি হয়ে। 

এই তো মাত্র এক বছর আগের কথা। অথচ বছর ঘুরতেই সবকিছু যেন পাল্টে গেল! যে ব্যাট তরবারী হয়ে শাসন করেছে একটা বোলিং সাম্রাজ্য, সেই ব্যাটই এলোমেলো করে দিলো চারপাশ। 

বিপিএলের নবম আসরের্ ৫১৬ রান করে নাজমুল হোসেন শান্ত ছিলেন রান সংগ্রহের তালিকায় সবার ওপরে। দুইয়ে থাকা ব্যাটসম্যানের চেয়ে প্রায় একশর বেশি রান করেছিলেন। হয়েছিলেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়। 

অথচ বছর না ঘুরতেই শান্তর জীবনে সব ওলটপালট। একই জার্সি, একই প্রতিপক্ষ, একই ময়দান। অথচ বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের ব্যাটে রান খরা। ১২ ম্যাচে তার রান মোট ১৭৫, ব্যাটিং গড় ১৪.৫৮ ও স্ট্রাইক রেট মাত্র ৯৩.৫৮। প্রতিযোগিতায় নিজেদের শেষ ম্যাচে তার ব্যাট থেকে আসে সর্বোচ্চ ৩৯ রান। রান করতে ভুলে যাওয়া এই ব্যাটসম্যানের পারফরম্যান্স এতোটাই এলোমেলো ছিল যে, গোটা টুর্নামেন্টে একটা ছক্কাও আসেনি তার ব্যাট থেকে।

অথচ গত বিপিএলের পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যান ছিলেন শান্ত। ওই বিপিএল দিয়ে তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরে যায়। নতুন গতিপথে শান্ত হয়ে উঠেন বাংলাদেশের ট্রাম্পকার্ড। তিন ফরম্যাটে ৩৯ ম্যাচে ৪২ ইনিংসে শান্তর রান ১৬১৪। 

বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান আগে এক বছরে পাঁচ সেঞ্চুরি করেননি। শান্ত আগের সব রেকর্ড ভেঙে গত বছর পাঁচ সেঞ্চুরি করেছেন। সঙ্গে তার নামের পাশে ছিল ৯ ফিফটি ছোঁয়া ইনিংস। ব্যাটিং গড়ও চমকপ্রদ, ৪৩.৬২। অফফর্ম, দল থেকে বাদ পড়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় চটকদার সব ট্রলের শিকার হয়েছেন শান্ত। সেসব পেছনে ফেলে ২২ গজে রানের ফোয়ারা ছুটিয়েছিলেন। 

ব্যাটিংযের এই নির্ভরতায় শান্তকে অধিনায়ক হিসেবেও বেছে নেওয়া হয়। বিশ্বকাপে দুটি ম্যাচে সাকিবের অনুপস্থিতিতে সহ-অধিনায়ক শান্ত দলকে নেতৃত্ব দেন। এরপর বিশ্বকাপের পর তাকে তিন ফরম্যাটেই অস্থায়ী অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সবশেষ গত ১২ ফেব্রুয়ারি বিসিবির বোর্ড সভায় শান্তকে ২০২৪ সালের জন্য তিন ফরম্যাটে অধিনায়কত্ব দেওয়া হয়েছে পাকাপাকিভাবে।

কিন্তু এবারের বিপিএলে তার পারফরম্যান্স স্রেফ বিভীষিকাময়। বেশ উচ্চ মূল্যে সিলেট তাকে রিটেইন করেছিল। কিন্তু প্রত্যাশামাফিক পারফরম্যান্স করতে পারেননি। তাতে দলও ভুগেছে। গত আসরের রানার্সআপরা এবার বিপিএল শেষ করেছে পয়েন্ট তালিকার পাঁচে নম্বরে থেকে।

গত বিপিএলে ধারাবাহিকতার সমার্থক ছিলেন শান্ত। এবার তার উল্টো। কোথায় তার সমস্যা? জানতে চাইলে সিলেটের অধিনায়ক মোহাম্মদ মিঠুন নির্দিষ্ট কিছু বলতে পারেননি। তবে তার দাবি, ছন্দে ফিরতে সবসরকম চেষ্টাই করেছেনি।

‘এটা তো ক্রিকেট… ও চেষ্টা কম করেনি। ওর দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। তবে হয়নি আর কি! সবসময় সবকিছু তো সবার হাতে থাকে না যে চাইলেই ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। ওর চেষ্টার কমতি ছিল না। দলে ওর পুরো সাপোর্ট ছিল, মাঠে পুরো সাপোর্ট করেছে। দল হিসেবে অবশ্যই আমরা ওর সার্ভিস মিস করেছি। তবে আমরা সবাই জানি, শান্ত গ্রেট খেলোয়াড়। আশা করি ও দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে।’

ব্যর্থতার অলিগলি পেরিয়ে শান্ত নিজের জায়গা শক্ত করেছেন ব্যাটিংয়ে রান করেই। ইতিবাচক মানসিকতা ছিল তার শক্তির জায়গা। কিন্তু এবার মাঠে তাকে লেগেছে বড্ড খেয়ালি। আউট হওয়ার ধরণগুলো ছিল বাজে। শরীরে জড়তা ছিল। আত্মবিশ্বাসে ছিল প্রবল ঘাটতি। তাতে এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল চারপাশ। তবে এসবের কিছুই মানতে চাইলেন না মিঠুন।

‘যেটা বললাম, ওর চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। ওর সঙ্গে যখন কথা বললাম, প্রতিটি ম্যাচেই তরতাজা হয়ে ইতিবাচক মানসিকতায় আসতো। তারপর আবারও ব্যর্থ হতো। একটা সময়ে খেলোয়াড় হিসেবে হতাশা একটু আসতেই পারে। ও শেষের দিকে চেষ্টা করেছে আরেকটু রিল্যাক্সড থাকতে। কারণ চেষ্টা করতে করতে যখন হয় না, তখন আরেকটু রিল্যাক্সড থাকাই ভালো।’-যোগ করেন সিলেট অধিনায়ক।

দেশের হয়েই পরের সিরিজে শান্ত নিজেকে ফিরে পাবেন জানিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন মিঠুন, ‘ও ঠিক কাজটিই করেছে। কিন্তু হয়নি। কেন হয়নি, সেই উত্তর আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। আশা করি, পরের আন্তর্জাতিক সিরিজে নিজেকে ফিরে পাবে।’

মার্চেই শুরু হচ্ছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সিরিজ। এ বছর শান্ত নেতৃত্ব দেবেন দলকে। গত বছর যেভাবে শেষ হয়েছিল এই বছরের শুরুটা তেমন হলো না বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের। সামনের দিনগুলোতে তার জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে বলতে দ্বিধা নেই। সেই চ্যালেঞ্জ উতরে যেতে পারলে লাভটা বাংলাদেশেরই।