গেইটে পা ফেলতেই চোখ যায় খেলোয়াড়দের আবাসনের সামনে শেখ কামালের মুর্যালে। নিচের দিকে ভাঙাচোরা। ছবির অধিকাংশ জায়গা কালো রঙে ঢাকা। মুখের এক পাশ কোনোমতে বোঝা যায়। ভেতরে যতই এগোতে থাকি প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামালের ছবির মতো ঐতিহ্যবাহী ক্লাব আবাহনী লিমিটেডকে ততোই ধুসর মনে হয়েছে।
রাজধানীর অভিজাত এলাকা ধানমন্ডির বুকে বিশাল এক মাঠ নিয়ে গড়া আবাহনী। আগে থেকেই জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। চারদিক ঘেরা বেষ্টনিতে। কোথাও টিন আবার কোথাও গ্রিল। এক পাশে ক্লাবের অফিস, এক পাশে খেলোয়াড়দের আবাসন, আরেক পাশে নির্মিতব্য বিলাসবহুল কমপ্লেক্স।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামালের হাতে গড়ে ওঠে ঐতিহ্যবাহী আবাহনী। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিধ্বস্ত হয় ক্লাবটি। সমানে চলে লুটপাট। ঐতিহাসিক সব অর্জনের স্মৃতিফলক, ট্রফি বিলীন করে দেওয়া হয় চোখের পলকে। আসবাবপত্র ভাংচুরসহ এয়ার কন্ডিশনার, অফিসের যাবতীয় সম্পদ লুট করা হয়।
প্রতিষ্ঠা সূত্রে সরকার দল আওয়ামী লিগের কবজায় ছিল আবাহনী। শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগে স্বভাবতই আক্রোশ গিয়ে পড়ে ক্লাবটির উপর। বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) সরেজমিন গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন এক চিত্র। সাংবাদিক পরিচয় দিলে কোনো কিছু জিজ্ঞেষ না করে নিরাপত্তাকর্মী খুলে দেন গেইট।
ভেতরে ঢুকতে করিডোরে দেখা মেলে লম্বা অফিস ঘরের। কয়েকজন বসে আড্ডা দিচ্ছেন। অফিসের ৭/৮টি কক্ষের দেয়ালগুলো ছাড়া আর কোনো কিছু ঠিক নেই। খুলে নেওয়া হয়েছে সব। চেয়ার টেবিল কিছু থাকলেও তা ভাঙা। কিন্তু এগুলো সব কেনা যাবে, নতুন করে। যেটা কেনা যাবে না সেটা হলো ক্লাবের সব স্মরণীয় ট্রফি। শোকেস একদম খালি। একটি ভাঙা ট্রফি নিচে পড়ে আছে।
অফিসের ক্ষতি হলেও আরেক পাশে থাকা খেলোয়াড়দের আবাসন খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। করিডোরে কিছু এলোমেলো জিনিষপত্র ছাড়া বাকিসব ঠিক মনে হয়েছে। করিডোরে দেখা মেলে ৩৪ বছর ধরে ক্লাবটিতে চাকরি করা মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন মোল্লার সঙ্গে।
সেদিন কি হয়েছিল? ‘আমরা কয়েকজন গেইটে ছিলাম। হঠাৎ করে কয়েকজন এসে বলে গেইট খুলে দেন। এরপর তারা সবাইকে ঢুকতে বলে। একেকজন একেকদিকে গিয়ে ভাংচুর করতে থাকে, লুটপাট করতে থাকে। বাইকে করে এবার আরও অনেকে আসে। তাদের হাতে নানা যান্ত্র। এসব দিয়ে অফিসের এসিসহ সব খুলে নিয়ে যায়।’-বলছিলেন সাহাবুদ্দিন।
ক্লাবটির চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান। যিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছের একজন উপদেষ্টা ছিলেন। দেশ ছাড়েন তাকে সঙ্গে নিয়ে। ক্লাবের বড় কর্তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়েছিল? বা এমন কিছু হতে পারে বলে সাবধান করেছিল? সাহাবুদ্দিন জানান, সবকিছু আচমকা হয়েছে। আগেপরে কেউ এখন পর্যন্ত খোঁজ নেয়নি।
করিডোরে যারা আড্ডা দিচ্ছেন তারা কারা? সাহাবুদ্দিন জানান, তারা ক্লাব পাহারা দিচ্ছেন। একজন আছেন সাবেক হকি খেলোয়াড় রানা। তার সঙ্গে আছেন স্থানীয়রা। রানা বলেন, ‘ওইদিন একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেছে, আমরা আশা করবো ভবিষ্যতে দূর্ঘটনা ঘটবে না। আমরা এখন এলাকার বড় ভাইদের নিয়ে আছি, ক্লাবটিকে বাঁচাতে। কোনো ক্ষতি যাতে না হয় সার্বিকভাবে চেষ্টা করছি।’
স্থানীয়দের একজন বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব এখন ক্লাবটাকে রক্ষা করা। এখানে রাজনৈতিক কেউ আসবে না। মাঠ উন্মুক্ত থাকবে, সবাই আসতে পারবে। বাচ্চারা যাতে খেলাধুলা করতে পারে, ভবিষ্যতের খেলোয়াড় তৈরি হতে পারে।’
অপর পাশে নির্মাণাধীন কমপ্লেক্সের কাজ বন্ধ হয়ে আছে ৫ আগস্ট থেকে। কমপ্লেক্সের মালামাল সেদিন লুট হয়েছে। হাতে করে নেওয়ার মতো অনেক কিছু নিয়ে গেছে লুটকারীরা। এ ছাড়া অনেক কোম্পানি মালামালও সরিয়ে নিচ্ছে কমপ্লেক্স থেকে। কবে নাগাদ কাজ শুরু হতে পারে এটির সদুত্তর দিতে পারেননি ওখানকার কেউ।
ক্লাবটির নেতৃত্বের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তারা অধিকাংশই আওয়ামী লীগ সরকারের খুব কাছের ছিল। বর্তমানে তারা পলাতক অবস্থায় আছেন, কবে নাগাদ ঠিক হয় তার অনেক কিছুই নির্ভর করছে তাদের বার্তার উপর। এখন পর্যন্ত কোনো বার্তা না পেয়ে অন্ধকারে আছেন রক্ষণাবেক্ষণকারীরা।