খেলাধুলা

ঈদগাহ থেকে ঘিঞ্জি ভাড়া ঘর: যেখানে লেখা হয়েছিল সিরাজের ভবিষ্যৎ

ট্যাক্সি যতই ভেতরে যাচ্ছে ততই লাগছে খটকা। রাস্তার পাশে ময়লার স্তুপ, কোথাও গবাদি পশু। আকাবাঁকা পথ পেরিয়ে অবশেষে পাওয়া গেল হায়দরাবাদের ফার্স্ট ল্যান্সার ঈদগাহের খোঁজ। বছরে দুই ঈদ ছাড়া এটি ব্যবহৃত হয় খেলার মাঠ হিসেবে। ভারতীয় তারকা পেসার মোহাম্মদ সিরাজের বেড়ে ওঠার পেছেন এই ঈদগাহের অবদান পাহাড়সম।

সিরাজের কারণে এই ফার্স্ট ল্যান্সার ঈদগাহের নাম সবার মুখে মুখে। তাইতো প্রায় ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটার দূর থেকে এসেও খুঁজে নিতে বেগ পেতে হয়নি। চারপাশ বসতিতে ঘেরা এই বালুর মাঠে আছে বড় এক মিম্বর। স্কুল পালিয়ে, পড়াশোনাকে একপাশে রেখে সিরাজ এখানেই লিখেছেন নিজের ভবিষ্যৎ।

মাঠের দিকে এগোতে দেখা যায় কয়েকজন কাজ করছেন নিবিড়ভাবে। উঠতি ক্রিকেটারসহ কয়েকজন মিলে পিচে রোল দিচ্ছেন, কেউ পানি দিচ্ছেন। টেনিস বলের একটি টুর্নামেন্টের জন্য তারা প্রস্তুত করছিলেন পিচটি। মোহাম্মদ সিরাজের কথা বলতেই মোহাম্মদ জাহিদ আলী নামে এক উঠতি পেসার খুলে বসলেন কথার ঝাঁপি।

‘সিরিজের পর ছুটি পেলেই সিরাজ ভাই এখানে আসেন। আমাদের সাথে এখানে খেলেন, আড্ডা দিয়ে মন তরতাজা করেন। আমাকে সবসময় বোলিং টিপস দেন। কখন কেমন বল দিতে হবে এগুলোও বলে দেন খুব ভালোভাবে।’

বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের পর সিরাজ বরাবরের মতো ছুটে এসেছেন হায়দরাবাদে, নিজের পুরোনো ডেরায়। আড্ডা, খাওয়া-দাওয়ায় মেতে থাকেন নিজের বেড়ে ওঠার সঙ্গীদের সঙ্গে। বোলিং করেন ফার্স্ট ল্যান্সারের উইকেটে।

জাহিদসহ সেখানে থাকা কয়েকজন বলছিলেন সিরাজের এসব গল্প। এরমধ্যেই এলেন এই তারকা পেসারের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ও বড় ভাই মোহাম্মদ আমজাদ খান। যিনি এখানে পরিচিত ম্যাডি ভাই নামে। ম্যাডি ভাই জানালেন সিরাজের বেড়ে ওঠার নানা কথা।

‘স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে এসে সে ক্রিকেট খেলতো। সবার সঙ্গে হাসি-তামাশায় মেতে থাকতো। ক্রিকেট নিয়ে সে খুব পাগল ছিল। জুনিয়র দলে খেললেও সে খুব জোরে বোলিং করতো। তার মতো কেউ এমন বোলিং করতো না।’

ম্যাডি ভাইয়ের মতে সিরাজ ছিলেন অলরাউন্ডার। বড় বড় ছয় মেরে আশপাশের বাড়িতে ফেলতেন। সিরাজ বদলায়নি একটুও, এখনো সেই আগেরমতো; উচ্ছ্বসিত কন্ঠে এসব বলছিলেন ম্যাডি ভাই।

‘ছোট থেকেই বড়দের সাথে খেলতো। সে অলরাউন্ডার ছিল এখানে। বড় বড় ছয় মারতো। এখনতো টেল এন্ডার, সুযোগ মেলে না। সে আগে যেমন ছিল এখনো তেমনই আছে। হাসি আড্ডায় মেতে থাকে বড়-ছোট সবার সাথে। সিরিজ শেষে এখানে না আসলে তার হয় না। সবাইকে বলতো ধৈর্যের ফল অনেক মিষ্টি।’

ম্যাডি ভাইয়ের কাছে খোঁজ পাওয়া গেলো সিরাজের পুরনো বাসার। মাঠের পেছনে আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে পাহাড়ের উপরে ঘিঞ্জি বাসায় থাকতেন সিরাজ। ‘মোহাম্মদ রফিক’ নামে ভাড়া এই বাড়ির দ্বিতীয় তলায় সিরাজ থাকতেন অটোচালক বাবাসহ। বাড়ির মালিক রফিক জানালেন, বড় তারকা হয়ে যাওয়ার পরও সিরাজ ভুলেননি তাদের, দাওয়াত দেন যেকোনো অনুষ্ঠান হলেই।

‘সে এখানে প্রায় পাঁচ বছরের মতো ছিল। এরপর আইপিএলে সুযোগ পায়, বানজারা হিলসে নিজের বাড়ি কেনে। সে কোনো ফাংশন হলেই আমাদের ডাকে। আমাদের কেমন পছন্দ করে আসলে আমি মুখে বলতে পারছি না। সে আগে যেমন ছিল এখনো তেমনই আছে আমাদের কাছে’ -বলছিলেন মোহাম্মদ রফিক।

ভাড়া বাড়িতে থাকতে সিরাজ খ্যাপ খেলে বিভিন্ন ট্রফি নিয়ে ঘরে ফিরতো। কখনো কখনো নগদ টাকাও পেতো। মোহাম্মদ রফিক জানালেন সিরাজের প্রথম আইপিএলের পর কয়েক মাস ধরে এই গলিতে মিডিয়ার ভিড় লেগেই ছিল।

মোহাম্মদ রফিক বলেন, ‘আর্থিক সমস্যা থাকলেও সিরাজের ছিল খেলার নেশা। নানা ট্রফি নিয়ে নিয়মিত ঘরে ফিরতো সে। তার বাবা ছিলেন অনেক ভালো মানুষ। তার বাবা তো এখন বেঁচে নেই। পরিবারের সঙ্গে এখনো আমাদের ভালো সম্পর্ক আছে, আগের মতোই।’

তবে এত বড় তারকা হওয়ার পরও সিরাজ কাট্টে নামে পরিচিত এই গলিকে ভুলে যাননি, সময় পেলেই আসেন ছুটে। সিরাজরা তো এমনই, আকাশে উড়লেও পা রাখেন মাটিতে।