খেলাধুলা

পাকিস্তান: টেস্ট বোলারদের ‘শ্মশান’

পাকিস্তানের মাটিতে টেস্টে বোলিং করতে হবে, এই কথা শোনা মাত্র যে কোনো বোলারের ঘাম ছুটে যেতে পারে। ছুটবেই না বা কেন? পাকিস্তানের পিচ যে টেস্ট বোলারদের জন্য দিনকে দিন মরুভূমি হয়ে উঠেছে। ব্যাটারদের তাণ্ডবে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে তাদের। উইকেটের জন্য তৃষ্ণার্ত কাকের মতো চেয়ে থাকতে হচ্ছে ভাগ্যের দিকে। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত তাদের মনে হয়তো ভেসে উঠছে প্রশ্নও; পাকিস্তান কি তবে টেস্ট বোলারদের শ্মাশান?

মুলতানে পাকিস্তানের বিপক্ষে ইনিংস ও ৪৭ রানে ইংল্যান্ডের জয়ের পর এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা চলছে সর্বত্র। সাম্প্রতিক সময়ের পাকিস্তানের মতো এমন ফ্ল্যাট পিচ বিশ্বের কোনো দেখা যাচ্ছে না। অনেকেই জানেন না ফ্ল্যাট পিচ কী। এ ধরনের পিচে মূলত শেষ ঘাসটাও রোল করে ফেলা হয়। একদম শুকনো খটখটে হয়। ফলে পেসাররা কোনো বাড়তি সহায়তা পান না। এ ধরনের পিচ সহজে ভাঙে না, তাই স্পিনাররাও সাহায্য পান না। ব্যাটসম্যানদের জন্য এ ধরনের পিচ স্বর্গস্বরূপ। ফ্ল্যাট পিচে স্বাভাবিকভাবে প্রচুর রান ওঠে।

বোলারদের হতাশ করে পাকিস্তানে ব্যাটারদের রাজত্ব।

এই পিচেই মুলতানে খেলতে নেমেছিল ইংল্যান্ড ও পাকিস্তান। ফলাফল যা হবার তাই হয়েছে। পাকিস্তানি পেসারদের নাভিশ্বাস উঠিয়ে ছেড়েছেন জো রুট ও হ্যারি ব্রুক। রেকর্ডের মালায় লেখা হয়েছে মুলতানের আদ্যোপান্ত। সেই সঙ্গে পাকিস্তানের পিচ নিয়েও উঠে গেছে প্রশ্ন। পাকিস্তানে ক্রিকেট ফেরার পর বিগত বছরগুলোয় টেস্ট ম্যাচের হিসেবেও উঠে এসেছে এই প্রশ্নের সঙ্গে।

পরিসংখ্যান বলে, ২০১৯ সালে পাকিস্তানে টেস্ট ক্রিকেট ফেরার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিটি উইকেটের জন্য একজন বোলারকে খরচ করতে হয়েছে ৪০ রান! প্রতিটি উইকেটের জন্য একজন বোলারকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান খরচ করেছেন শ্রীলঙ্কায়, উইকেট প্রতি ৩৪.২৫ রান করে। ২০২২ সালে অস্ট্রেলিয়ার পাকিস্তান সফরে একজন বোলার উইকেট প্রতি খরচ করেছিলেন ৪২.৭৩ রান। সেটাই ছিল যে কোনো দেশের পিচে বোলারদের জন্য সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতা।

উইকেটের খোঁজে অক্লান্ত বোলিং, পিচে রান উৎসব।

জানিয়ে রাখা ভালো যে, অস্ট্রেলিয়ান ফাস্ট বোলারদের আটকে রাখার জন্য পাকিস্তান ফ্ল্যাট পিচ তৈরি করতে বলেছিল। যাতে অজি পেসাররা কোনো সহায়তা না পায়। বোলারদের জন্য পিচে সেই যে জুজু ভর করলো, সেটা এখন পর্যন্ত ভোগাচ্ছে। স্বয়ং পাকিস্তানি বোলাররা নিজেরাই পিচের আচরণে অতিষ্ঠ। পাকিস্তানের পিচে বোলারদের দুঃস্বপ্নের আরেকটা পরিসংখ্যান দেখা যাক।

২০২২ সালের মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের মাটিতে অনুষ্ঠিত টেস্ট ম্যাচগুলোর ৪২ ইনিংসের মধ্যে ১৪ ইনিংসেই ৪০০ বা ততোধিক রান এসেছে। যা এই সময়ের মধ্যে যে কোনো দেশের মাটিতে সর্বোচ্চ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২ ইনিংসে ৪০০ বা ততোধিক রান এসেছে ইংল্যান্ডের মাটিতে। তাও ৭৬ টেস্টে। সে হিসেবে ইংল্যান্ডে প্রতিটি ৪০০ বা ততোধিক রানের ইনিংস এসেছে ৬.৩ ইনিংসে! যেটা পাকিস্তানের মাটিতে এসেছে ৩ ইনিংসে।

পাকিস্তানি বোলারদের তুলোধুনো করে রুটের ডাবল সেঞ্চুরি।

একই সময়ে পাকিস্তানের মাটিতে ইনিংসে ৫০০ বা ততোধিক রান হয়েছে সাতবার। যা যেকোনো দেশের মাটিতে সর্বোচ্চ।  আবার এই সময়ে ৬০০ বা ততোধিক রানের পাঁচটি ইনিংসের মধ্যে তিনটিই হয়েছে পাকিস্তানের মাটিতে। অন্য দেশটি হলো শ্রীলঙ্কা যেখানে ইনিংসে ৬০০ রানের বেশি হয়েছে।

২০২২ সালের মার্চের পর থেকে এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের তিন ভেন্যু রাওয়ালপিন্ডি, করাচি এবং মুলতানে একেকজন বোলার গড়ে ৪০ করে রান দিয়েছেন। এই সময়ে দুইয়ের বেশি টেস্ট ম্যাচ হয়েছে বিশ্বের ২৭টি ভেন্যুতে। যেখানে পাকিস্তানের তিন ভেন্যু বাদে একমাত্র ইংল্যান্ডের ট্রেন্ট ব্রিজেই কেবল বোলারদের গড় চল্লিশের বেশি।

রান উৎসবে যোগ দিয়ে হ্যারি ব্রুকের ট্রিপল সেঞ্চুরি।

মুলতানে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চতুর্থ দিনে পাকিস্তানের টপ-অর্ডার ধ্বসে যাওয়ার পরও বোলারদের গড় কমেনি।  ২০২২ সালের মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত পাকিস্তানে টেস্টে চতুর্থ দিনে বোলারদের গড় ৪০.৬৫, যা আগে ছিল ৩৯.৪৮। দিনের হিসেবে একমাত্র শ্রীলঙ্কায় এর আগে একদিনে বোলারদের গড় হয়েছিল চল্লিশের বেশি (৪২.০২)।

পাকিস্তানের মাটিতে স্পিনার আর পেসার, সবারই বাজে অবস্থা। স্পিনারদের অবস্থা বেশিই বাজে। প্রতিটি উইকেটের জন্য তাদেরকে খরচ করতে হয়েছে ৪৪.৭৫ রান। ২০২২ সালের পর থেকে স্পিনারদের এমন বাজে অবস্থা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। স্ট্রাইক রেটের হিসেব করলে এই সময়ের মধ্যে স্পিনাররা আরব আমিরাতের মাটিতেই একমাত্র টেস্টে এমন নাজেহাল হয়েছিলেন।

স্কোরবোর্ড স্বাক্ষ্য দিচ্ছে, পাকিস্তানের পিচ বোলারদের জন্য এক শ্মশান।

ঘরের মাটিতে পাকিস্তান সবশেষ টেস্ট জিতেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে রাওয়ালপিন্ডিতে। তিন বছর আগের সেই ম্যাচে বোলারদের গড় ছিল ২৭.৮৩। একই ভেন্যুতে এক বছর পর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টেস্টে পাঁচ দিনে সব মিলিয়ে ১৩ উইকেট পড়েছিল, প্রতি উইকেটের বিনিময়ে বোলাররা রান খরচ করেছিলেন ৮৯ এর আশেপাশে। ওই ম্যাচ ড্র করার পর ঘরের মাটিতে পরের ১১ ম্যাচের একটিও জিততে পারেনি পাকিস্তান। ড্র করেছিল ৪ ম্যাচ।

মুলতান টেস্টে ইংল্যান্ড দেখিয়ে দিলো টেস্ট ক্রিকেট এগোচ্ছে। দলগুলো ফলাফলের জন্যেই খেলছে। একই সঙ্গে তারা দেখিয়ে দিলো, টেস্ট ক্রিকেটের এই উন্নতির সঙ্গে পাকিস্তানের পিচেরও উন্নতির প্রয়োজন। নয়তো পাকিস্তান টেস্ট বোলারদের শ্মশান থেকে মহাশ্মশানে পরিণত হতে খুব বেশি দেরী নেই।