এটাকে বাংলাদেশের ‘আত্মাহুতি’ বলবেন নাকি আফগানিস্তানের ‘ম্যাজিক’। কোনটা?
যদি বাংলাদেশের আত্মাহুতি বলেন তাহলে একেবারে মানানসই। তবে একটা ঝামেলা…আফগানিস্তানের থেকে কৃতিত্ব কেড়ে নেওয়া হবে। ওঁরা যা করেছে, যেভাবে লড়েছে তাতে লেটার মার্কস তাদেরই প্রাপ্য। বিজয়ের মালা তাদের গলাতেই মানায়। আর শারজাহর তিনশতম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচে বাংলাদেশ যা করলো, তাতে নিজেদের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না সমর্থকরা। গ্যালারিতে ‘বাংলাদেশ-বাংলাদেশ’ স্লোগান মুহূর্তেই রূপ নিল ‘ভুয়া-ভুয়া’ আর্তনাদে।
আফগানিস্তানের দেয়া ২৩৬ রানের লক্ষ্য তাড়ায় বাংলাদেশের স্কোর তখন ২ উইকেটে ১২০। সেখান থেকে ১৪৩ রানে যেতে অলআউট বাংলাদেশ! পাঠক ভুল পড়ছেন না। চিমটি কেটে বিশ্বাস করারও প্রয়োজন নেই। সত্যিই এমন কিছু হয়েছে ২২ গজে। যা স্রেফ বিব্রতকর।
বাংলাদেশ ২৩ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে আফগানিস্তানের কাছে প্রথম ওয়ানডে হেরেছে ৯২ রানের বড় ব্যবধানে। ধারাভাষ্যকার রমিজ রাজা তাই তো বলতে বাধ্য হলেন, ‘এভাবেও ম্যাচ হারা যায়?’ বাংলাদেশকে এমন ভরাডুবিতে ভাসিয়ে আনন্দে, উল্লাসে মেতেছেন আফগানিস্তানের নতুন সেনসেশন আল্লাহ মোহাম্মদ গজনফার।
বলা হয়, রশিদ খান ও মুজিব উর রহমানের পর বৈচিত্র্যময় স্পিনার তাদের পরম্পরা ধরে রাখবেন। কেন এই বিশ্বাস, ডানহাতি ১৮ বছর বয়সী স্পিনার দেখিয়ে দিলেন। ৬.৩ ওভারে ১ মেডেনে ২৬ রানে ৬ উইকেট পেয়েছেন গজনফার। বল হাতে তার লেগ স্পিন, দুসরা কিংবা ক্যারম বল কোনো কিছুই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা পড়তে পারেননি। ১৭ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাটিয়ে দেওয়া মুশফিকুর রহিম তার ক্যারম বলে যেভাবে পরাস্ত হয়েছেন তা দেখা চোখের জন্য কষ্টকর। কিংবা ওপেনিংয়ে তানজিদ হাসান তামিমের ভেতরে ঢোকানো বলে বোল্ড হওয়ার দৃশ্য, তাসকিন ও মোস্তাফিজকে চোখ ধাঁধিয়ে উইকেট উপচে ফেলা……সব কিছুই যেন সমর্থক হিসেবে বিশাল যন্ত্রনার। আর বিপরীত দলে থাকলে আনন্দের কারণ।
গজনফারের জ্বলে ওঠার দিনে রশিদ খান দমে যাননি। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে গুগলিতে বোল্ড করার বল মনে করিয়ে দেয়, সময়টা বুঝিয়ে ফুরিয়েই গেল! এদিন ব্যাটিং অর্ডারে পরিবর্তন এনেছেন বাংলাদেশের কোচ ফিল সিমন্স। নির্ভরযোগ্য মুশফিককে সাতে পাঠিয়ে মিরাজকে চারে তোলা হয়েছিল। মাহমুদউল্লাহ ছয়ে নেমেছিলেন। তাওহীদ ছিলেন পাঁচে। কোনো পরিকল্পনাই কাজে আসেনি।
ওপেনিংয়ে সৌম্য ৬ বাউন্ডারিতে ৪৫ বলে ৩৩ রান করার পর মিরাজ ও শান্ত হাল ধরেছিলেন। ৫৫ রানের জুটি গড়ে আশা দেখিয়েছিলেন, তারা সবশেষ এশিয়া কাপে যেভাবে বাংলাদেশকে উদ্ধার করেছিলেন এবারও তেমন কিছু করবেন। শান্ত রান পেয়ে ফিফটির পথে ছিলেন। কিন্তু সব ওলটপালটের শুরু তার আউটেই। দলের হয়ে সর্বোচ্চ ৪৭ রান করেছেন।
এরপর ৪০ মিনিটে, ৫০ বল, মাত্র ২৩ রান ও ৮ উইকেট পড়ার ঘটনা দেখল ক্রিকেট বিশ্ব। সব শেষ হয়ে গেল নিমিষেই। গজনফারের রূপকথার এক স্পেলে দুঃস্বপ্ন নেমে আসে বাংলাদেশের ব্যাটিং অর্ডারে।
আফগানিস্তানের ব্যাটিংয়েও এমন ধস নেমেছিল। কিন্তু তাদের একজন অভিজ্ঞ নবী ছিলেন, যিনি পথ দেখিয়েছেন। অভিজ্ঞতার শোধ মিটিয়ে দিয়েছেন। টস জিতে ব্যাটিং করতে নেমে বিপর্যয়ে পড়ে আফগানিস্তান। প্রথম ১০ ওভারে ৩৫ রান তুলতে ৪ উইকেট এবং ২০ ওভার যেতে না যেতেই স্কোরবোর্ডের অবস্থা এমন— ৭১/৫! ধীর গতির উইকেটে মোস্তাফিজুর রহমান নতুন বলে হয়ে উঠেছিলেন ভয়ংকর। নিজের প্রথম ওভারে রহমত শাহকে দারুণ স্লোয়ারে মুশফিকের হাতে তালুবন্দি করান। এরপর অভিষিক্ত সেদিকউল্লাহ অটলকে ও আজমতউল্লাহ ওমরজাইয়ের উইকেট নেন এক ওভারে।
চাপে থাকা আফগানিস্তানকে আরও চেপে ধরেন শুরুতেই ব্রেক থ্রু এনে দেওয়া তাসকিন। ওপেনার রহমানউল্লাহ গুরবাজকে সুইং ডেলিভারিতে পরাস্ত করার পর গুলবাদিন নাইবকে শর্ট বলে মিড উইকেটে তালুবন্দি করান। টপ ও মিডল অর্ডারে ধারাবাহিক আক্রমণে উইকেট পাওয়া বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল আফগানিস্তানকে দ্রুত গুটিয়ে দেওয়া।
কিন্তু অভিজ্ঞ মোহাম্মদ নবী নিজের কারিশমা দেখান সাতে নেমে। রিশাদকে প্রতি আক্রমণে গিয়ে দুটি ছক্কা উড়ান চোখের পলকে। সঙ্গে রানিং বিটুউন দ্য উইকেটে রানের চাকা সচল রাখেন। শুরুতে পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার পর ধারাবাহিক রান তুলতে থাকেন নবী। তাকে সঙ্গ দেন শাহীদি। ১২২ বলে ১০৪ রানের দারুণ জুটি গড়ে আফগানিস্তানকে ম্যাচে ফেরান এই দুই ব্যাটসম্যান। উইকেট জমিয়ে রেখে শেষ দিকে আক্রমণে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাদের।
এই জুটি ভাঙার পর আফগানিস্তানের ব্যাটিং আর জমেনি। মোস্তাফিজ বোলিংয়ে ফিরে শাহীদিকে বোল্ড করেন। আফগানিস্তানের অধিনায়ক ৯২ বলে ৫২ রান করে ফেরেন ৪১তম ওভারে।
আফগানিস্তানের সুপারস্টার রশিদ খান ভালো করতে পারেনি। শরিফুলের শর্ট বলে মিড উইকেটে ক্যাচ দেন। ওদিকে নবী এগিয়ে যাচ্ছিলেন সেঞ্চুরির দিকে। কিন্তু তাসকিনের এক ওভারে আবার পাল্টে যায় স্কোরবোর্ডের চেহারা। ৭৯ বলে ৮৪ রান করা নবী ডানহাতি পেসারের শর্ট বল তুলে মারতে গিয়ে ডিপ মিড উইকেটে ক্যাচ তোলেন। ৪ চার ও ৩ ছক্কায় সাজানো ইনিংসটি থেমে যায় সেখানেই। নতুন ব্যাটসম্যান গজনফারকে প্রথম বলে বোল্ড করে হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলেন। শুধু তা-ই নয়, পাঁচ উইকেট প্রায় পেয়ে গিয়েছিলেন। হ্যাটট্রিক বলটি ফজল হক আটকে দিলেও তাসকিনের স্পেলের শেষ বলে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে এলবিডব্লিউ হয়েছিলেন। কিন্ত রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান ফজল।
পরের ওভারে মোস্তাফিজের সুযোগ ছিল ফাইফারের। কিন্তু খরুচে বাঁহাতি পেসার ফাইফার তো পান-ই নি, উল্টো এক চার ও এক ছক্কা হজম করেছেন খারোতির ব্যাটে। শেষ দিকে তার ২৮ বলে ২৭ রানের ইনিংসে আফগানিস্তান লড়াকু পুঁজি পায়। যে পরিস্থিতি থেকে উঠে এসে ২৩৫ রানের পুঁজি পায় তাতে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছে।
ধীর গতির উইকেটের পুরো ব্যবহার করে তাসকিন ও মোস্তাফিজ ৪টি করে উইকেট পেয়েছেন। শরিফুলের পকেটে গেছে ১ উইকেট। দুই স্পিনার রিশাদ ও মিরাজ ছিলেন উইকেটশূন্য।
ব্যাটিংয়ে নবীর দায়িত্বশীল ইনিংসের পর বোলিংয়ে গজনফারের ঘূর্ণিতে টালমাতাল বাংলাদেশ। এমনিতেও দল খুব ভালো অবস্থায় ছিল না। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নাজেহাল হওয়ার পর শারজাহতে এমন বিব্রতকর পরাজয় নিশ্চিতভাবে মনোবলকে আরো নাড়িয়ে দিল।