ভ্রমণ

জার্মানি: মন কাড়লো ক্যাসেল

শিহাব শাহরিয়ার: কোথাও যাবার কথা উঠলেই মন নেচে ওঠে- দেশে হোক অথবা ভিনদেশে। লেখক ও সাংবাদিক নাজমুন নেসা পিয়ারি যখন বার্লিন থেকে আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে বললেন, জার্মানিতে ভ্রমণে যেতে, সত্যি সত্যি মনটা নেচে উঠল। সরকারি আদেশ, ভিসা ও টিকিট করে কবি শামীম রেজাকে সঙ্গে নিয়ে জার্মানির উদ্দেশ্যে একদিন উড়াল দিলাম দূর আকাশ দিয়ে। আরো কয়েকবার আকাশ পথে গিয়ে নেমেছিলাম ব্রিটেন, আমেরিকা, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া কিংবা আরো কিছু দেশে। কিন্তু মূল ইউরোপে হিটলারের দেশে এই প্রথম যাত্রা। তারিখটা ২০ আগস্ট ২০১৬। রাতের আঁধারে বিমানবন্দর থেকে শুরু হলো যাত্রা। বিমানের অধিকাংশ যাত্রী মধ্যপ্রাচ্যগামী বাংলাদেশি শ্রমিক। আমার পাশের সিটেই লক্ষ্মীপুরের বশির। বয়স ২৬ হবে। নোয়াখালির আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। না পারে শুদ্ধ বাংলা, না ইংরেজি, না আরবি। নিজে থেকেই বলল, কুয়েত যাইতাছি, দেশে কোনো কাজ নাই, গরিব সংসার, কি আর করবো? পাশের সিটে ফোনে ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছে একটি মেয়ে। মেয়েটির মুখ দেখে মনে হলো, দেশে স্বজনদের রেখে জীবনের প্রয়োজনে অচেনা, অজানা দূরের দেশে যাচ্ছে, যেখানে শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করতে হবে। তবে? তবে যেটি শুনি, বাঙালি নারী শ্রমিকরা নাকি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়! সেই আশঙ্কা জেগে উঠল আমার মনে। জানি না এই মায়াবি মেয়েটি কেমন থাকবে তার কর্মক্ষেত্রে, বিদেশ-বিভূঁইয়ে? মধ্য আকাশে এখন চাঁদ আছে কিনা জানি না। তবে আমাদের বিমান তার পাখা বরফের জলে ভিজিয়ে ভিজিয়ে যে আকাশ পথ পাড়ি দিচ্ছে টের পেলাম। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ ঘণ্টা আকাশ পথে থাকতে হবে। বিমানের এক আলো-আঁধারির ভেতরে এই দীর্ঘ সময় কাটানো কষ্টকরই বটে। শামীম ভ্রমণ ডায়েরি লেখা শুরু করেছে, আমি ভাবনার রাজ্যে ঘুরছি। এও কম সুখের না! এই যে ব্রহ্মপুত্র পাড়ের এক শ্যামলা-সন্তান স্বদেশের আকাশসীমা অতিক্রম করে ইউরোপের অন্যতম একটি উন্নত দেশে যাচ্ছি, এক্ষেত্রে যারা যায়, তারা যায়ই কিন্তু আমার বিষয়টি ভিন্ন। আমার ছোটবেলার স্বপ্ন যে ঘুরে বেড়াবো জগত, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের এ আরেক সোপান। আবারও আরব সাগর পাড়ি দিচ্ছি, আহা আনন্দ-জাগানিয়া! ভাবতে ভাবতেই আমাদের বিমান ধীরে ধীরে নেমে পড়ল আবুধাবির জমিনে। আট ঘণ্টা আটকে গেলাম বন্দরের কঠিন বেড়াজালে। নানা দেশের নানা বর্ণের মানুষের সঙ্গে আমি আর শামীম কিছুক্ষণ বসে বসে গল্প করছি, ঘুমাচ্ছি, পায়চারি করছি, লেখালেখি করছি- করতে করতেই অবশেষে পরবর্তী বিমানে ওঠার ডাক পেলাম।  

বার্লিন প্রাচীরের পুরনো ছবি

 

তখন সকালে রোদ ফুটেছে ধরায়। মরুভূমির রোদে ঝাঁজ বেশি কি? আঁচ করার সুযোগ নেই। আবারো উঠলাম মধ্য আকাশে। এবারে বাঙালি শ্রমিকদের গলার আওয়াজ নেই, যারা সহযাত্রী তারা আরবীয়, ইউরোপীয়, ভারতীয় অথবা অন্য ভাষা-বর্ণের মানুষ। জানালায় দেখতে পাচ্ছি মরুর খাঁ খাঁ শূন্যতা। ভাবছি ইরাকের কথা, সিরিয়ার কথা, ফিলিস্তিনের কথা। দেশগুলো কিভাবে ধ্বংস করে দিচ্ছে পশ্চিমা কু-চক্রীরা। আহা এখানে ডুকরে কাঁদছে মানবতা! ১৯৭১ সালে আমরাও বুঝেছি মানবতার পতন হলে, মানুষ কিভাবে মৃত্যু-উপত্যকায় ভেসে বেড়ায়। সাম্রাজ্যবাদীদের নির্মম আগ্রাসন আর আরবীয় কর্তাদের একগুয়েমি অহংকারে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশগুলো ক্রমশ আলোর আড়ালে চলে যাচ্ছে। কবে যে থামবে এইসব হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ কেউ জানে না! মাথার উপরের একটি বাতি জ্বালিয়ে শামীম ডায়েরি লিখেই চলেছে। আমি এই ফাঁকে মনে মনে অগ্রিম পাড়ি জমালাম জার্মানি: ‘দেশটি ইউরোপের অন্যতম প্রধান শিল্পোন্নত দেশ। ১৬টি রাজ্য নিয়ে গঠিত একটি সংযুক্ত ইউনিয়ন।  উত্তর সীমান্তে উত্তর সাগর, ডেনমার্ক ও বাল্টিক সাগর, পূর্বে পোল্যান্ড ও চেক প্রজাতন্ত্র, দক্ষিণে অস্ট্রিয়া ও সুইজারল্যান্ড এবং পশ্চিম সীমান্তে ফ্রান্স, লুক্সেমবুর্গ, বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডস। জার্মানির ইতিহাস জটিল এবং এর সংস্কৃতি সমৃদ্ধ, তবে ১৮৭১ সালের আগে এটি কোনো একক রাষ্ট্র ছিল না। ১৮১৫ থেকে ১৮৬৭ পর্যন্ত জার্মানি একটি কনফেডারেসি এবং ১৮০৬ সালের আগে এটি অনেকগুলো স্বতন্ত্র ও আলাদা রাজ্যের সমষ্টি ছিল। আয়তনের দিক থেকে জার্মানি ইউরোপের সপ্তম বৃহত্তম রাষ্ট্র। দেশটি পশ্চিমা সংস্কৃতিতে বহু অবদান রেখেছে। জার্মানিতে বহু অসাধারণ লেখক, শিল্পী, স্থপতি, সঙ্গীতজ্ঞ এবং দার্শনিক জন্মগ্রহণ করেছেন। এদের মধ্যে সম্ভবত ইয়োহান সেবাস্টিয়ান বাখ ও লুডভিগ ফান বেটোফেন বিশ্বে বেশি পরিচিত। ফ্রেডরিখ নিৎসে, ইয়োহান ভোলফগাং ফন গ্যটে এবং টমাস মান জার্মান সাহিত্যের দিকপাল। ইতিহাস বলছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পশ্চিমা শক্তিগুলোর মধ্যকার মিত্রতা ১৯৪০-এর দশকের শেষে ভেঙে গেলে সোভিয়েত অঞ্চলটি জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র তথা পূর্ব জার্মানিতে পরিণত হয়। পশ্চিম-নিয়ন্ত্রিত বাকি তিন অঞ্চল একত্রিত হয়ে পশ্চিম জার্মানি গঠন করে। কিন্তু লাখ লাখ পূর্ব জার্মানবাসী অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক পশ্চিম জার্মানিতে অভিবাসী হওয়া শুরু করলে ১৯৬১ সালে পূর্ব জার্মানি সরকার বার্লিনে একটি প্রাচীর তুলে দেয় এবং দেশের সীমান্ত জোরদার করে। ১৯৮৯ সালে পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিনের বাসিন্দারা ঐতিহাসিক সেই বার্লিন প্রাচীর ভেঙে ফেলে। এই ঘটনাটিকে পূর্ব ইউরোপে সাম্যবাদের পতন ও জার্মানির পুনঃএকত্রিকরণের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর দুই জার্মানি একত্রিত হয়ে জার্মান ফেডারেল প্রজাতন্ত্র গঠন করে। এই হলো মোটা দাগে দেশটির ইতিহাস। পৃথিবীতে জার্মানি ১৫তম জনবহুল দেশ। এই জনবহুল দেশটিকে জার্মান ভাষায় ‘ডাস লা-ড্যার ডিখটার উন্ড ডনকার’ বলা হয়। যার অর্থ  ‘কবি ও চিন্তাবিদদের দেশ’। ফলে বাংলা ভাষার সামান্য লেখক হিসেবে জার্মানের লেখক, সংগীতজ্ঞ ও সংস্কৃতির মানুষদের প্রতি আমার কিছুটা দুর্বলতা আছে বৈকি। যদিও জার্মান বংশোদ্ভূত নন, তবু কার্ল মার্ক্সের জীবনী পড়ে তার ভক্ত হয়েছি। একটি উদাহরণের রেখা টেনেই আবার ভাবি হিটলারের মতো নির্মম মানুষটিও এই জার্মানির। তবু যাচ্ছি, গিয়ে দেখবো বার্লিন প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ। এজন্য মনে মনে ধন্যবাদ লেখক নাজমুন নেসা পিয়ারিকে। কারণ তিনি আমাদের জন্য এই ভ্রমণের ব্যবস্থা করে অপেক্ষা করছেন বার্লিন বিমানবন্দরে। তখন বিকাল গড়াচ্ছে জার্মানির আকাশে। আমরা ধীরে ধীরে নেমে যখন ইমিগ্রেশন পার হয়ে বের হলাম, দেখি পিয়ারি আপা সঙ্গে একজনকে নিয়ে অপেক্ষা করছেন। সঙ্গীর নাম রহমান সাইদুর- বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। আমাদের মতই বয়স। তার গাড়িতেই আমরা উঠলাম। দীর্ঘ ভ্রমণজনিত ক্লান্তির পরেও যখন একই বাংলা ভাষার মানুষের মাধ্যমে ভিন্ন দেশে প্রবেশ করা যায় তখন আনন্দটাই অন্য রকম হয়, আমাদেরও তাই-ই হলো। গাড়ির জানালা দিয়ে দেখছি উন্নত দেশের নানা নমুনা। আমাদের প্রথমেই নিয়ে গেল সাইদুর সাহেব যেখানে কাজ করেন সেখানে। সেটি একটি বার প্লাস জুস শপ। আমাদের দামি হার্ডড্রিংকস অফার করা হলো, কিন্তু শামীম রেজা ও শিহাব শাহরিয়ার সাধু-পুরুষ, দু’জনের একজনও মদ্য পান করি না। অগত্যা মধুসূদন, আমরা ফলের জুসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলাম। এরপর বেরিয়ে গেলাম পিয়ারি আপার বাসার উদ্দেশ্যে। তিনি থাকেন বার্লিনের একটি অভিজাত এলাকায়। এই বাসায় আমাদের আগে এসে থেকেছেন কবি আসাদ চৌধুরীসহ বাংলাদেশের অনেক লেখক-শিল্পী। আমরাও প্রথম রাত এখানেই কাটালাম। পরদিন সকাল বেলা নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়লাম বার্লিনের পথে পথে। ইংল্যান্ড ও আমেরিকা দেখার অভিজ্ঞতায় টের পেলাম, এশিয়া বাদে পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর ধরন-ধারণ প্রায় একই রকম। আমার প্রথম দেখার বাসনাই ছিল বার্লিন প্রাচীর। বাসে উঠে কয়েক মিনিটের মধ্যেই গিয়ে পৌঁছলাম প্রাচীরের কাছে। একটি পুরনো দেয়াল, কোথাও ভাঙা, কোথাও নানা জনে নানা রকম লেখা লিখে রেখেছে। পর্যটকরা ঘুরে ঘুরে দেখছে, ছবি তুলছে। আমরাও দেয়ালের পাশে গিয়ে কয়েকটি ছবি তুললাম। মনে আনতে চেষ্টা করলাম, এই একটি প্রাচীর যা পূর্ব ও পশ্চিমে ভাগ করে দিয়েছিল দেশটিকে। এই প্রাচীর ঘিরে যে রাজনৈতিক ইতিহাস সেটি সবারই জানা। যার কিছুটা পূর্বে বর্ণিত হয়েছে। শুধু বলতে পারি, মানুষই প্রাচীর গড়ে, মানুষই প্রাচীর ভাঙে। এ যেন জীবন মঞ্চের ক্ষণিকের খেলা। বহু দিনের দেখার সাধ পূরণ হলো, চললাম বার্লিনের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে। সেখানে দেখলাম শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া রাইন নদী। ভালো লাগল জার্মানির বর্তমান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মারকেলের বাসভবন ও এর পাশে সংসদ ভবন এলাকা। আমরা ট্যুরিস্ট বাসে ঘুরে ঘুরে এসব জায়গা দেখছি। কখনো নেমে কফি খাচ্ছি, কখনো কোথাও নেমে দেখছি দর্শনীয় স্থাপনাগুলো। কোথাও কোথাও ট্যুরিস্টদের ঠাসা অবস্থা। কারণ সে সময় সারা ইউরোপের প্রকৃতিতে ফুটে আছে গ্রীষ্মের রোদ। নিজের চোখে দেখলাম শীতের দেশের মানুষেরা গ্রীষ্মে নিজেদের কিভাবে মেলে ধরে।

ক্যাসেলের চূড়া, যেখানে রয়েছে হারকিউলিস

পরদিন প্রাগের উদ্দেশ্যে বার্লিন থেকে বেরিয়ে গেলাম। অত্যন্ত চমৎকার একটি সকাল। হালকা ঠাণ্ডা, দূরপাল্লার এসি বাস। বার্লিন থেকে বাসে উঠে যখন যাচ্ছি, তখন মনটা সত্যি ভরে গেল এক অজানা আনন্দে। মূল শহর থেকে বেরিয়ে বাস গিয়ে পড়ল হাইওয়েতে। রাস্তা আর বাইরের প্রকৃতি সাজিয়ে উন্নত করে গড়ে তোলা জার্মানভূমি দেখে অভিভূত হচ্ছি। পাহাড় আর সমতলের নানামাত্রিক ভূমি অতিক্রম করে পাড়ি দিচ্ছি মাইলের পর মাইল। দেখছি বিশেষ করে পাহাড়ি উপত্যকায় অবারিত শস্যখেত আর সাজানো বাড়ি-ঘর ও শিল্প কারখানাগুলো দারুণ লাগছে। মিষ্টি রোদ ভেদ করে আমরা যাচ্ছি পূর্ব দিকে- আমাদের সামনে চেক রিপাবলিক আর পাশেই পোল্যান্ড। প্রাগের সীমান্ত পর্যন্ত পুরো জার্মানি অপূর্ব সুন্দর লাগল আমার। মনে হলো এতো সাজানো গোছানো মনোরম অঞ্চলের আমিও একজন বাসিন্দা হতে পারি। সীমান্ত অতিক্রম করে প্রাহা (ওখানে প্রাগকে প্রাহা বলে) পৌঁছলাম কিন্তু মনেই হলো না যে অন্য একটি দেশে ঢুকলাম। প্রাগের গল্প অন্য সময় বলবো। প্রাগ থেকে যখন বার্লিনে ফিরলাম, তখন অনেক রাত। পিয়ারি আপার বাসায় ঢুকবো, এমন সময় তিনি বললেন, এখানে একটি ক্যাসিনো আছে, বাঙালিরাও এখানে আসে, যাবেন নাকি আপনারা? শামীম আর আমি খুবই আগ্রহ দেখালাম। আপা আমাদের নিয়ে ঢুকলেন। ওখানে পরিচয় হলো এক বাঙালি ভদ্রলোকের সঙ্গে যিনি নিয়মিত আসেন। তিনি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন সব কিছু, নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে রাতে ঘুমাতে গেলাম। একদিন গেলাম বার্লিন থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরের এক শহরে। রহমান সাইদুর বললেন, সেখানে আইনস্টাইনের গ্রামের বাড়ি রয়েছে। তিনি গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলেন নদী ও পাহাড়ঘেরা শহরের প্রান্তে অবস্থিত সেই বাড়ি দেখাতে। বাড়িটি এখন জাদুঘর। খুবই নির্জন এলাকা। দুর্ভাগ্য আমরা যখন গিয়ে পৌঁছলাম, তখন বিকেল হয়ে গেছে এবং গিয়ে শুনলাম সেদিন জাদুঘরটির বন্ধের দিন। কি আর করা! তারপর রহমান গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলেন একটি জমিদার বাড়িতে। বিশাল দালানের লম্বা একটি বাড়ি। এখন সেখানে কেউ থাকে না। সামনে নিচে অত্যন্ত সুন্দর ফুলের বাগান, ফোয়ারা, ভাস্কর্য সবুজ ঘাসে শোভিত একটি প্রান্তর। রহমান জানালেন, এখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা প্রতিদিন ভিড় করে। এখানে নাকি বাংলাদেশের কোনো চলচ্চিত্র পরিচালক বাংলা ছবির শুটিংও করেছেন। সত্যি বেশ লাগল সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তে। রাতে ফিরে এলাম বার্লিনে। শামীম বার বার বলেছিলো, হাইড্রেলবার্গে যাওয়ার জন্য। আমার ইচ্ছে পূর্বেকার পশ্চিম জার্মানির রাজধানী বনে যাবার। কিন্তু সম্ভব হলো না। আসলে অনেকগুলো বড় বড় শহর ও দর্শনীয় স্থান রয়েছে, স্বল্প সময়ে এতো জায়গায় যাওয়া সম্ভব নয়। আমরা বরং বার্লিন থেকে প্যারিস, প্যারিস থেকে জুরিখ, জুরিখ থেকে পুনরায় জার্মানি এবং শামীম যাবে ইতালি। যাই হোক বার্লিন থেকে প্যারিস হয়ে জুরিখ গেলাম। জুরিখ থেকে এক গভীর রাতে রওনা করলাম জার্মানির বাণিজ্যিক শহর ফ্রাঙ্কফুর্ট হয়ে ক্যাসেলের উদ্দেশ্যে। ক্যাসেল থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে ঘনিষ্ট আত্মীয় তুলি ও তার বর মুক্তা। ওরা বহুদিন ওই শহরে থাকে। ওরাই জুরিখ থেকে বাসের টিকিট কেটে দিয়ে ক্যাসেলে আমাকে নিয়ে গেছে। ক্যাসেলে না গেলে যেতাম ইতালি হয়ে পর্তুগাল অথবা অস্ট্রিয়ায়। তবে ক্যাসেল থেকে সীমান্ত পার হয়ে ঘুরে এসেছি নেদারল্যান্ডসের একটি শহর।  

বার্লিন প্রাচীরের সামনে লেখক (ডানে)

তো সেই রাতের গল্প বলি। রাত এগারোটায় জুরিখ প্রবাসী কুমিল্লার মিজানুর রহমান আমাকে বাসে উঠিয়ে দিলেন। চমৎকার বাস আর চালকগুলোও অসাধারণ। লক্ষ্য করলাম, চালকরা বেশ স্মার্ট এবং অধিকাংশের বয়স পঞ্চাশ থেকে সত্তর। গাড়ি চালায় খুবই সাবধানে ও সুন্দর করে। কিছু কাজু বাদাম, বিস্কিট আর পানির বোতল নিয়ে বাসে উঠেছি। বাস চলছে, আমি অন্যান্য অচেনা যাত্রীর সঙ্গে কখনো ঘুমাচ্ছি, কখনো জেগে জেগে রাতের বিস্তীর্ণ জার্মানি দেখছি। যেতে যেতে ভোরে ফ্রাঙ্কফুর্টে এসে বাস থামল। এখানে বাস বদল করে অন্য বাসে যেতে হবে ক্যাসেলে। সেই বাস আসবে বেলা নয়টার দিকে। কোনো যাত্রী ছাউনি নেই। পাশেই ছোট্ট একটি পার্কের মতো, সেখানে কাঠের বেঞ্চ পাতা। গিয়ে সেখানে বসলাম। অচেনা জায়গা। ঘুরে বেড়াবার চেষ্টা করলাম না। একটু একটু ঠাণ্ডা লাগছে। ব্লেজার গায়ে দিয়ে নিলাম। কি আর করা- বেঞ্চে বসে বসে কাজু খাচ্ছি আর ডায়েরি বের করে শামীমের মতো লিখতে শুরু করেছি। কিছুক্ষণ পর এক ফিলিস্তিনি ভদ্র মহিলা এসে পাশে বসলেন। সঙ্গে তার ষোড়শী কন্যা। তিনিই প্রথম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কোন দেশের, কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছি? উত্তর দিয়ে আমি জানতে চাইলে তিনি জানালেন, তিনি একটি সেমিনারে এসেছেন এই ফ্রাঙ্কফুর্টে। এয়ারপোর্ট থেকে বাসে এখানে এসেছেন, আরেকটি বাস আসবে ঘণ্টা দুয়েক পরে। তিনি আমার মতোই অপেক্ষমান যাত্রী। আমার হাতে ডায়েরি ও কলম দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমি লেখক কিনা? মনে মনে বেশ পুলকিত বোধ করলাম। বললাম, জি। তিনি বেশ প্রশংসা করলেন এবং বললেন তিনি লেখকদের খুব পছন্দ করেন ও বই পড়তে ভালোবাসেন। এক ফাঁকে বললেন, বাংলাদেশ মুসলিম কান্ট্রি এবং বাংলাদেশ খুব সুন্দর দেশ বলে তিনি জেনেছেন। এরপর তার বাসের সময় হলো, তিনি উঠে দাঁড়ালেন, আমি তাকে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানালাম। তিনি হাত নাড়িয়ে মেয়েসহ চোখের আড়াল হলেন কিছুক্ষণ পর আমার বাস এলো, আমি চললাম ক্যাসেলের দিকে। যে বাসে উঠলাম, সেই বাসে যাত্রী খুবই কম। ক্যাসেল জার্মানির জিরো পয়েন্টে অবস্থিত। ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে বেরিয়ে বাস যখন হাইওয়েতে পড়ল, দেখলাম রাস্তার দুপাশে পাহাড়ি উপত্যকা আর বিস্তীর্ণ সমতলে নানা প্রকার শস্যভূমি। দেখে অন্যরকম অনুভূতি আমার ভেতর খেলা করছে। ভাবছি আমার দেশকে এভাবে কবে সাজাতে পারবো আমরা। মাইলের পর মাইল একই রকম দৃশ্য। বাইরে গ্রীষ্মের রোদ বিস্তীর্ণ ভূমি আলোকিত করে রেখেছে। বাস কতগুলো স্টপেজ নিলো। শেষের দিকে যাত্রী থাকলাম মাত্র চারজন। বেলা একটার দিকে বাস প্রবেশ করল ক্যাসেল শহরে। শহরে ঢুকতে মনটা ভরে গেল এক অজানা আনন্দে। পাহাড়ের পাদদেশে নান্দনিকভাবে একটি চমৎকার শহর গড়ে তুলেছে জার্মানরা। কি যে সুন্দর, আহা! ছোট্ট শহর। লোকজনও কম। ছিমছাম। স্টপেজে থামবার আগে দেখলাম, ট্রেন, ট্রাম, বাস, প্রাইভেট কার ও সাইকেল চলছে। কিন্তু ভিড় নেই। আমরা যেন এরকমটাই চাই। বাস থামল, আমি নামতেই দৌড়ে এলো মুক্তা (আমার ভায়রা ভাই)। লাগেজটা গাড়িতে উঠিয়ে ও আমাকে নিয়ে চলল ওর বাসার দিকে। মুক্তা জানাল, এই শহরে ওরা প্রায় পনেরো বছর বাস করছে। গ্রীষ্মে খুবই মজা, তবে শীতের সময় মাইনাস ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায় তাপমাত্রা। আরো জানাল, তাতে তাদের কোনো অসুবিধা হয় না, আবহাওয়ার সাথে তারা নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। ওরা দুই ভাই এখানে ব্যবসা করে। এই অঞ্চলে বেশ কিছু বাঙালি বাস করে এবং সবার মধ্যে সৌহার্দ ও আন্তরিকতা রয়েছে। বলল, এখানে বেশ আছি। এই ভালো থাকার প্রমাণ পেলাম তখনই, যখন ওর গাড়িটি থামল ওরই বাড়ির সামনে। তিনতলা একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি সে বানিয়েছে, দেখতে দারুণ। আমার শ্যালিকা তুলি এসে নিয়ে গিয়ে ঘর দেখিয়ে বলল, ভাইয়া এখানেই আপনি থাকবেন, যে ক’দিন থাকতে পারেন। মনটা আনন্দে ভরে গেল আবারও। কারণ বিদেশ বিভূঁইয়ে এরকম বাঙালি আপ্যায়ন, আহা কি যে শান্তি। একটু বিশ্রাম নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম ক্যাসেল দর্শনে। সঙ্গে এক কন্যা ও পুত্র সন্তানসহ তুলি ও মুক্তা। ওরা সারা শহরই প্রায় ঘুরিয়ে দেখাল, সারা শহর পরিচ্ছন্ন ও নিটোল। এরপর খাওয়াতে নিয়ে গেল। একটা জিনিস খেয়াল করলাম, যেটি বার্লিনেও করেছি, জার্মানির অধিকাংশ রেস্টুরেন্ট ও স্ট্রিট ফুডের দোকান তার্কিশরা পরিচালনা করে। তুর্কি খাবার-দাবার অন্য রকম। প্রবাসী বাঙালিরা তুর্কিদের খাবারই বেশি খান। ইতোমধ্যে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে। লোকজন আরো কমে যাচ্ছে। একটু বেশিই নির্জন লাগল শহরটিকে। যদিও আমি নির্জনতার পক্ষে।

গ্রীম ব্রাদারের ভাস্কর্য

পরদিন হাসান ভাই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলেন ক্যাসেলের পাশের তিনটি শহরে। তার আগে হাসান ভাইয়ের কথা বলি। হাসান ভাই ঢাকার মানুষ, ক্যাসেলে থাকেন প্রায় আঠারো বছর। ওখানে বাঙালিদের অভিভাবকের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। তার আরেকটি পরিচয় হলো আমার আবাস স্থল ঢাকার মিরপুরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক আবু তালেব সাহেবের ভাগ্নে তিনি। অত্যন্ত আলাপি ও ভোজনরসিক মানুষ। তুলিদের বাসায় ওর হাতের চমৎকার রান্না করা বাঙালি খাবার খেয়ে পড়ন্ত বিকেলে আমরা ছুটলাম হানাও শহরের দিকে। এই শহরটি বহু পুরোনো শহর। খেয়াল করলাম জার্মানির এই দিককার শহরগুলো মানুষের অতি দ্রুত ছোটাছুটি নেই। সব কিছুতেই শান্ত ভাব। হাসান ভাই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বেশ প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী কিছু স্থাপনা ও বাড়ি-ঘর দেখালেন। তারপর নিয়ে চললেন আরেক শহর ফ্লোডাতে। এখানেও পুরনো ঐতিহ্যের অনেক কিছু খেয়াল করলাম। এরপরের শহরের নাম হাসেইন। হাসেইন একটু শান্ত শহর এবং জার্মানির সবচেয়ে পুরনো শহর। আমরা যখন এই শহরে ঢুকলাম, তখন সন্ধ্যার লগ্ন। হাসান ভাই গাড়ি পার্কিং করে আমাকে বললেন, শিহাব ভাই আপনি একটু এখানে দাঁড়ান, আমি এক বাংলাদেশি বন্ধুর খোঁজে যাচ্ছি। বললাম, আচ্ছা। জায়গাটি পার্কের মতো। আমি এলোমেলো হাঁটছি। হাসান ভাই আসতে একটু দেরি করছেন। এমন সময় দেখলাম একটি বড় বেদিতে দুটি বিশাল ভাস্কর্য। আমি এগিয়ে গেলাম। ভাস্কর্যের বেদিতে দুটি কিশোরী বসে আড্ডা দিচ্ছে। কাছে গিয়ে বুঝলাম এরা যমজ। আমার দৃষ্টি সেখান থেকে ছাপিয়ে চলে গেলো ভাস্কর্যের দিকে। আশ্চর্য এ আমি কি দেখছি! এ যে গ্রীম ব্রাদার? ১৮৪৬ সালে এই ভাই প্রথম ফোকলোর শব্দের উদ্ভাবন করেন। ১৯৯৫ সালে বাংলা একাডেমিতে জুনিয়র ফোকলোর ফেলোশীপ করতে গিয়ে বিশিষ্ট ফোকলোরবিদ শামসুজ্জামান খানের কাছ থেকে এই গ্রীম ব্রাদারের কথা জানতে পারি। কাকতালীয় ও দশম আশ্চর্যের বিষয় যে, এভাবে এদের ভাস্কর্যের মুখোমুখি হবো ভাবিনি! হাসান ভাই এলেন এবং দেখে কিছুটা আঁচ করতে পারলেন। বললেন আপনি নিশ্চয়ই কিছু আবিষ্কারের আনন্দে আছেন। তিনি গ্রীম ব্রাদার ও প্রথম লোককাহিনীর দুই চরিত্রের ভাস্কর্যটিও দেখালেন। দেখালেন পাশেই অবস্থিত একটি মিউজিয়াম। তারপর পরিচয় করিয়ে দিলেন তার বাঙালি বন্ধুর সঙ্গে। খুবই রসিক তিনি এবং এখনো ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলেন। মগবাজার, মিরপুরসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বড় হয়েছেন, এই সব কথা বললেন। নিয়ে গেলেন তার বাসায়। বাসা থেকে নেমে, হাসান ভাইয়ের গাড়ি রেখে, সেই ভদ্রলোকের গাড়িতে আমাকে নিয়ে চললেন ফ্রাঙ্কফুর্টে। সন্ধ্যার আলো-ছায়ায় গাড়ি ছুটে চলেছে ফ্রাঙ্কফুর্টের দিকে। ফ্রাঙ্কফুর্ট জার্মানির বাণিজ্যিক ও খুবই ব্যস্ততম শহর। আমি প্রথমেই গেলাম যেখানে প্রতি বছর বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলা হয়। বিশাল বিল্ডিং ও এলাকা। গেলাম পুরনো পার্লামেন্ট ভবন দেখতে, এর পাশেই জার্মানদের আনন্দময় জায়গায় যেখানে জার্মানরা বিশ্বকাপ ফুটবল জিতে আনন্দ-মঞ্চ বানিয়ে ছিলো। এর পাশে রেস্টুরেন্ট, আড্ডা চলছে নানা বয়সের মানুষের। ইতোমধ্যে নেমে গেছে রাত। আমরা ফিরে গেলাম ক্যাসেলে। পরদিন তুলি ও মুক্তার ওদের কন্যা-পুত্রসহ পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পরিচ্ছন্ন ও উন্নত সড়ক মাড়িয়ে আমাকে নিয়ে গেল ক্যাসেলের একটি চূড়ায়, যেখানে হারকিউলিস রয়েছে মিউজিয়ামে। কিন্তু সেটি দেখা হলো না, কারণ সংস্কার কাজের জন্য মিউজিয়াটি বন্ধ রয়েছে। মিউজিয়ামের পাশে দাঁড়াতেই মুক্তা জানালো, শিহাব ভাই নিচের দিকে তাকান, পুরো ক্যাসেল শহর দেখা যাচ্ছে। তাকালাম, দেখলাম সুন্দরী ক্যাসেলকে। পরদিন সকালে ক্যাসেলকে বিদায় জানিয়ে ছুটে চললাম বার্লিনের দিকে, কারণ বার্লিন হয়ে আমাকে ফিরতে হবে বাংলাদশে।  রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ জুলাই ২০১৭/তারা