বাংলাদেশের বৃহত্তম পার্বত্য জেলা রাঙামাটি নৈসর্গিক সৌন্দর্যের স্বপ্নভূমি। প্রকৃতির সবুজ পাহাড় যেমন এ জেলাকে করেছে সমৃদ্ধ, তেমনি অসংখ্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনযাত্রার ধরন তাতে এনে দিয়েছে অসামান্য বৈচিত্র্য।
রাঙামাটি জেলার ১০ উপজেলার প্রতিটিতে রয়েছে পর্যটন প্রেমীদের জন্য দর্শনীয় স্থান। পাহাড়ের সুউচ্চ চূড়ায় মেঘ স্পর্শ করা থেকে শুরু করে কাপ্তাই হ্রদের জলে পা ভেজানো, সূর্যাস্ত উপভোগ করাসহ ভ্রমণ পিপাসা মেটানোর সমস্ত উপাদান সমৃদ্ধ এই জেলা। তাই পার্বত্য রাঙামাটিকে বলা হয় পর্যটনের তীর্থভূমি/তীর্থস্থান। ১০টি ভাষাভাষীর ১১টি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সাংস্কৃতিক, নৃতাত্ত্বিক কৃষ্টির সংস্পর্শে আসতে হলে বছরের যেকোনো সময়ে ঘুরে আসতে পারেন রাঙামাটি।
রাঙামাটির দর্শনীয় স্থান
রাঙামাটিতে দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে নয়নাভিরাম ঝুলন্ত সেতু, শুভলং ঝর্না, কাপ্তাই হ্রদ, রাজবন বিহার, পুলিশ পলওয়েল পার্ক, উপজাতীয় জাদুঘর, আরণ্যক, ফুরমোন পাহাড়, সাজেক ভ্যালী, বার্গী পিকিনিক স্পট, বরগাঙ, কাপ্তাই নেভী ক্যাম্প পিকনিক স্পর্ট, প্যনোরামো জুম রেস্তোরাঁ, গিরিনন্দিনী পিকনিক স্পর্ট। কাপ্তাইয়ে আছে বাংলাদেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও কর্ণফুলী পেপার মিলস। তবে এ দুটি স্থানে ভ্রমণ করতে হলে কর্তৃপক্ষের অনুমতির প্রয়োজন আছে। রাঙামাটির এসব স্পট ভালোভাবে ঘুরে দেখতে গেলে কমপক্ষে ২-৩ দিন সময় হাতে নিয়ে আসতে হবে।
নয়নাভিরাম বহুরঙা এই ঝুলন্ত সেতুটি দুইটি বিচ্ছিন্ন পাহাড়ের মধ্যে গড়ে দিয়েছে হৃদ্দিক সম্পর্ক। সেতুটি পারাপারের সময় সৃষ্ট কাঁপুনি আপনাকে এনে দেবে ভিন্ন দ্যোতনা। রাজবনবিহারের মনমুগ্ধকর নির্মাণশৈলী দেখে আপনি অবাক হবেন বৈকি! এখানে এসে ধ্যানমগ্ন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দেখা পাবেন। গেরুয়া রঙের কাপড় পরিহিত নির্জনতা প্রিয় এইসব ভিক্ষুদের জীবনাচার সত্যিই অনুসরণযোগ্য।
এদিকে, পর্বত প্রেমীরা ফুরমোন পাহাড় চাইলে ঘুরে আসতে পারবেন। এ পাহাড় থেকে পুরো রাঙামাটি শহর দেখা যায়।এমনিক মেঘ না থাকলে চট্টগ্রাম শহরও দৃষ্টিগোচর হয়। পর্বত প্রেমী পর্যটকরা যেতে পারেন সুভলং অভিমুখে। পাহাড় হ্রদের নিবিড় নৈকট্যে আপনার মনেও সৃষ্টি করতে পারে ভিন্ন এক অনুভূতি।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের উত্তর-পূর্ব কূল ঘেঁষে রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ভ্যালী। পাশেই ভারতের মিজোরাম। বর্ষাকালে সাজেক আচ্ছাদিত থাকে মেঘের চাদঁরে। তাই সাজেককে মেঘের বাড়িও বলা চলে। সাজেক রাঙামাটি জেলায় অর্ন্তগত হলেও সড়ক পথে যোগাযোগ করতে হয় খাগড়াছড়ি দিয়ে। খাগড়াছড়ি জেলা শহর থেকে সাজেকের দূরত্ব প্রায় ৬৯ কিলোমিটার। খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক যেতে সময় লাগে ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা। আঁকাবাঁকা স্বপ্নীল পাহাড়ী পথ পেরিয়ে যেতে হয় সাজেকে। পথিমধ্যে চোখ আটকে যাবে পাহাড়ী নদী কাচালং-মাচালং ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার দৃশ্য দেখে। সাজেকে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় এনজিও সংস্থা ও ব্যক্তি মালিকাধীন পরিচালিত রিসোর্ট রয়েছে । পরিবার পরিজন নিয়ে নিরাপদে সাজেকে রাত্রিযাপন করা যায় এসব রিসোর্টে। এ ছাড়াও, স্থানীয়দের ঘরবাড়ি ও নিজস্ব থাবু নিয়ে সাজেকে রাত্রিযাপন করা যায়। খাবারের সুব্যবস্থাও রয়েছে রিসোর্টগুলোতে। তবে সাজেক গেলে রিসোর্টে আগে থেকে রুম বুকিং করে নেওয়া ভালো।
কীভাবে আসবেন
রাঙামাটি আসতে হলে ঢাকার সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল থেকে সরাসরি বাস ছেড়ে যায় রাঙামাটির উদ্দেশ্যে। ঢাকার এসব স্থান থেকে ইউনিক, রিলাক্স, শ্যামলী, ডলফিন, সেন্টমার্টিন, হানিফ পরিবহনের এসি/নন এসি বাস পাওয়া যায়। ঢাকা থেকে রাঙামাটির বাস ভাড়া জনপ্রতি ৭৫০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত আছে। এদিকে, চট্টগ্রামের অক্সিজেন থেকেও রাঙামাটির সরাসরি বাস সার্ভিস রয়েছে। এর মধ্যে লোকাল বাস ছাড়াও পাহাড়ীকা বাস ও রিলাক্স পরিবহনের বাস ছেড়ে যায় প্রতি ৩০ মিনিট পর।
পাহাড়ীকা বাসের ভাড়া ১৪০ টাকা। বাসে সময় লাগে আড়াই ঘণ্টা এবং লোকাল বাসে ৩-সাড়ে ৩ ঘণ্টা। সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পাওয়া যায় বাস। এ ছাড়া, নিজস্ব গাড়ি অথবা ভাড়া করা মাইক্রো, কার, নিয়েও আপনি আসতে পারেন রাঙামাটি। নিজস্ব গাড়ি নিয়ে আসলে সময় এবং অর্থ দুই’ই সাশ্রয় হবে। খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের গাড়ি ভাড়া চাঁদের গাড়ি আসা যাওয়ায় ৬,০০০ টাক থেকে ৭,০০০ টাকা এবং মাইক্রো-কারে ৮,০০০-১০,০০০টাকায়। এ ছাড়াও, যারা মোটরসাইকেলে ভ্রমণ করেন, তারা মোটরসাইকেলে করে সাজেকে যেতে পারেন। তবে পাহাড়ী উচুঁ-নিচু পথে অভিজ্ঞতা না থাকলে মোটরসাইকেল না চালানো উত্তম।
চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড় ও কদমতলী বাস স্ট্যান্ড থেকেও খাগড়াছড়ির উদ্দেশে বাস ছেড়ে আসে। এদিকে এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম কাপ্তাই লেক যদি ভ্রমণ করতে চান, তাহলে প্রত্যেকটা পর্যটক ছোট-বড় অনেক বোট এবং স্পিড বোট ভাড়ায় পাওয়া যায়। প্রতিটি বোট ভাড়া সর্বনিম্ন ১,৫০০/- থেকে শুরু করে ৫,০০০ টাকা পর্যন্ত ।
এদিকে একটি বিষয় উল্লেখ করে রাখা ভালো, রাঙামাটি শহর হচ্ছে বাংলাদেশের একমাত্র রিকশাবিহীন শহর। এখানকার স্থানীয় মানুষের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হলো অটোরিকশা। পাহাড়ী এলাকা হওয়ায় টুরিস্টদের সিএজি আটোরিকশা ভাড়াটা একটু বেশি গুণতে হয়। সে ক্ষেত্রে গাড়িতে উঠার আগে ভাড়া দরদাম করে নেওয়া ভালো। যাতে করে বিড়ম্বনায় পড়তে না হয়।
কোথায় থাকবেন
রাঙামাটি ভ্রমরণ আসা পর্যটকদের জন্য বেশকিছু ভালো মানের হোটেল-মোটেল-রেস্ট হাউজ ও রিসোর্ট রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে-শহরের ফিসারী ঘাট সংলগ্নে হোটেল হিল অ্যাম্বাসেডর, পৌরসভা কার্যালয় এলাকায় সাংহাই ইন্টারন্যাশনাল, বনরুপায় নীডস হিল ভিউ, রিজার্ভ বাজার এলাকায় মতি মহল ও গ্রিণ ক্যাসেল ও পর্যটন কমপ্লেক্স।
রাঙামাটির হোটেল হিল অ্যাম্বাসেডরের ম্যানেজার সোহেল বলেন, আমাদের এই হোটেলটি নতুন চালু হয়েছে। এটিতে সর্বনিম্ন ১৮৪০ থেকে ৩৮৪০ টাকা পর্যন্ত। এখানে ২৭টি রুম রয়েছে। এখানকার প্রতিটি রুম শীততাপ নিয়ন্ত্রিত।
শহরের বনরুপায় অবস্থিত হোটেল নীডস হিল ভিউর ম্যানেজার মো. রাসেল বলেন, আমাদের এখানে সর্বমোট ৩০টি রুম আছে। ১৫ টি রুম এসি, বাকি ১৫টি নন এসি রুম। সর্বনিম্ম নন এসি রুম ভাড়া ৮০০ টাকা আর এসি রুম সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকা।
শহরের পৌরসভা এলাকায় অবস্থিত সাংহাই ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফুল আলম শরীফ বলেন, এখানে সর্বমোট ২৬টি রুম আছে। এখানে এসি রুম হচ্ছে ১৮টি আর বাকি ৮টি হচ্ছে নন এসি রুম। এখানে রুমের ভাড়া সর্বনিম্ন ৮০০ টাকা থেকে ৪,৫০০ টাকা পর্যন্ত।
এদিকে, শহরের রিজার্ভ বাজারে রয়েছে হোটেল নাদিশা, আনিকা। আবার কমদামী কিছু হোটেলও আছে। যেমন মধুমিতা, সৈকত, শাপলা, ডিগনিটি, সমতা, উল্লেখযোগ্য। এগুলো ভাড়া সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা পর্যন্ত। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের রেস্ট হাউস, গেস্ট হাউস এবং বাংলোগুলো নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ এবং অনুমতি সাপেক্ষে ভাড়া দেওয়া হয়।
রাঙমাটি পর্যটন মোটেলের ব্যবস্থাপক সৃজন বিকাশ বড়ূয়া বলেন, এখানে মোট ৮৮টি রুম আছে। তিনি বলেন, মোটেলে সর্বনিম্ন ১৬০০ টাকা তেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৩২০০ টাকা পর্যন্ত রুম ভাড়া রয়েছে। এর পাশাপাশি এখানে কটেজ আছে ৪টি, যেখানে প্রায় ১৬ জন থাকতে পারবেন।
প্রতি বছরই হাজারো মানুষ নগর জীবনের কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে ইট পাথরের শহর ছেড়ে ভিড় জমায় এই রাঙামাটিতে। প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করতে সমতলের মানুষ উদগ্রীব হয়ে থাকেন, কখন আবার ঘুরে আসবে অরণ্যের শহর রাঙামাটিতে।