বিদেশে এসেছি শপিং-এ যাব না, তা কি হয়! প্রথম দিনের ক্লাস শেষেই আমরা ছুটলাম শপিং-এর খোঁজে। হোটেলে ঢোকার মুখে রেন্ট-এ কারের কাউন্টার আছে। তাদের বললে হোটেলের গাড়ি ডেকে দেয়। কিন্তু সে তো খুব এক্সপেনসিভ! কাউন্টারের ছেলেটিকে বললাম, আমাদের কাছে তো লোকাল সিম নেই, তুমি একটা ক্যাব ডেকে দাও। সে খুশি মনে ডেকে দিেলা।
হার্টনু মল মানে এক পেল্লাই শপিং মলে নিয়ে গেল। সামনে বিশাল লন। তারপর আধুনিক সজ্জার মার্কেট। বুঝে গেলাম শহরের এলিটদের জন্য এ শপিং মল। ঢোকার মুখে পড়লাম বিপত্তিতে। মাস্ক ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। আমাদের দুজনের মাস্ক আছে, দুজনের নাই। দুজন ঢুকে গেল। বাকি দুজনের কী পরিণতি হবে জানার জন্য গার্ড ছেলেটি খবর পাঠাল। কিছুক্ষণ পর আরেকটা গার্ড এলো। এরা ইংরেজির বিন্দু বিসর্গ জানে না। তবে ইশারায় বুঝিয়ে দিলো মাস্ক কিনতে। মাস্কের দোকান পাচ্ছিলাম না। পাক্কা ১২ মিনিট ছেলেটি আমার পেছনে আঠার মতো লেগে ছিল। মাস্ক কেনার পর ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেল। এদের পেশাদারিত্বের প্রশংসা করতে হয়। একটুও খারাপ ব্যবহার না করে কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয় এদের থেকে শিখতে হয়।
আমাদের জোহরা আপার একটা সেল ফোন কিনতে হবে। কারণ তার সেল ফোনে ওয়াইফাই কাজ করছে না। আবার সেল ফোন ছাড়া প্রতিদিনের ক্লাসের কাজগুলো করা সম্ভব নয়। সেল ফোন কেনার সুযোগে মার্কেটটা ঘুরে দেখলাম। বাংলাদেশী ১ টাকায় ইন্দোনেশিয়ার ১৫১ রুপি। তাই লাখের নিচে কোনো কথা নেই। পরে সিএনএ চ্যানেলে দেখলাম সাত বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে গেল জুলাই মাসে। এই মুদ্রাস্ফীতির কারণে ইন্দোনেশিয়ার জাতির জনক সুকর্ণ বেকায়দায় পড়েছিলেন। ১৯৯৯ সালে জেনারেল সুহার্তের ৩১ বছরের লৌহকঠিন শাসনের অবসান ঘটে। অনেকেই সুহার্তকে গালমন্দ করেন। স্বৈরশাসক অভিধা দেন। কিন্তু বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার ভিত্তি কিন্তু তিনিই রচনা করে দিয়েছেন।
ক্রেতার মানসিক চাপ কমাতে শেষের তিনটি শূন্য ছোট করে লেখে। হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় পানির মতো দাম
১৯৪৫ সালের আগস্টে সুকর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণার পরপর ডাচ বাহিনী ব্রিটিশদের সহযোগিতায় ফিরে আসে। তারা আবার উপনিবেশের অধিকার দাবি করে। এই যোগজাকার্তাকে তারা ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী ঘোষণা করে জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ৪ বছর যুদ্ধের পর ডাচরা ইন্দোনেশিয়া রিপাবলিককে মেনে নিয়ে ফিরে যায়। ইন্দোনেশিয়া প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ পায়। তারপর থেকে নিষ্কণ্টক রাজ্যপাট করার কথা ছিল সুকর্ণের। কিন্তু তা হয়নি। ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীনতার দাবিতে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয়। সেকুলার স্টেট, কমিউনিস্ট স্টেট ও ইসলামিক স্টেট নিয়ে দ্বন্দ্ব ত্রিবিভক্ত হয়ে পড়ে ইন্দোনেশিয়া। তখনও ডাচ ও চৈনিকদের অর্থনৈতিক আধিপত্য রয়ে গেছে। দারুল ইসলাম নামের এক সংগঠন ইসলামি স্টেটের দাবিতে পূর্ব জাভা, দক্ষিণ সুলয়াসি, আচেহ প্রদেশে বিদ্রোহ শুরু করে। বান্দুং, মাকাস্সার, আমবনে স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসে স্থানীয় জাতীয়তাবাদীরা।
এদিকে ডাচ ও জাপানি কর্তৃক নিয়োগকৃত সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরোধ ছিল। দুই দল প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ পর্যন্ত ঘিরে ফেলে ট্যাঙ্ক নিয়ে। ১৯৫৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে সুকর্ণের প্রতিষ্ঠিত পিএনআই আর ইসলামি ভাবধারার মাসুয়ামি পার্টি সমান সমান আসন পায়। ৫৭টি করে। ৪৫টি আসন পায় ইসলামিক পার্টি নাধলাতুল উলাম পার্টি। আর কমিউনিস্ট পার্টি পিকেআই ১৯ টি। কোন দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় না। এতে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে ওঠে। বোঝা গেল পশ্চিমাধারার গণতন্ত্র এতো বৈচিত্র্যের দেশে সম্ভব নয়। সুকর্ণ গাইডেড ডেমোক্রেসি প্রবর্তন করেন। মোহাম্মদ হাট্টা এই গাইডেড ডেমোক্রেসি প্রত্যাখ্যান করে ১৯৫৬-র ডিসেম্বরে ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ১৯৫৭-এর মার্চে সুকর্ণ মার্শাল ল’ জারি করেন। সে বছরের ডিসেম্বরে তিনি ২৫৬টি ডাচ কোম্পানিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ঘোষণা করে ৪০ হাজার ডাচকে ইন্দোনেশিয়া থেকে বের করে দেন। পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকায় বিদেশীদের ব্যবসা করা নিষিদ্ধ করায় চাইনিজরা দলে দলে শহরে ভিড়তে থাকে। ১০ হাজার চৈনিক দেশে ফিরে যায়। এদিকে বিভিন্ন প্রদেশে আর্মির প্রধানরা সিআইএ-র মদতে ক্যু করে ক্ষমতা দখল করে বসে। সুকর্ণ শক্ত হাতে তাদের দমন করেন।
হায়াত রিজেন্সি যোগজাকার্তার লনে দাঁড়িয়ে লেখক
এদিকে দারুল ইসলাম গ্রুপ তাকে হত্যার জন্য একের পর এক প্রচেষ্টা চালায়। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৬০-এ জাতীয় পরিষদ বাতিল করে দেন। সেনাবাহিনী ও ইসলামি দলগুলোর চাপের মুখে সুকর্ণ পিকেআই (কমিউনিস্ট পার্টির)-র দিকে ঝুকে পড়েন। তত দিনে পিকেআই রাশিয়া ও চীনের পর পৃথিবীর তৃতীয় বৃহৎ কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তার পার্টি মেম্বারের সংখ্যা ৩০ লক্ষ! পিকেআই ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দল হয়ে ওঠে। কমিউনিস্ট চীনের সঙ্গে সুকর্ণের ঘনিষ্ঠতায় জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী দল এবং সেনাবাহিনী উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠে। ১৯৬৫ সালে পিকেআই’র প্রধান অদিত প্রস্তাব দেন সশস্ত্র শ্রমিক ও কৃষকদের নিয়ে ফিফথ আমর্ড ফোর্স গঠনের। এতে সেনাবাহিনী আরো তেঁতে ওঠে। এদিকে ১৯৬৪-৬৫ অর্থবছরে দেখা দেয় ভয়াবহ মূদ্রাস্ফীতি।
এর মধ্যে ১৯৬৫ সালের ১ অক্টোবর সেনাবাহিনীর টপ সিনিয়র ৬ জন জেনারেলকে কিডন্যাপ করে হত্যা করা হয়। এর কিছুদিন আগে সুকর্ণের চিকিৎসার জন্য কিছু চাইনিজ চিকিৎসক এসেছিলেন। চারদিকে গুজব ছড়িয়ে যায় কমিউনিস্ট সুকর্ণকে আটকিয়ে, জেনারেলদের হত্যা করে ক্ষমতায় যেতে চাচ্ছে। মিলিটারি স্ট্যাটেজিক রিজার্ভের প্রধান মেজর জেনারেল সুহার্ত এই ক্যু নিয়ন্ত্রণ করেন। আর্মিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন শক্ত হাতে। জনগণ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে কমিউনিস্ট বিরোধীতা তীব্র হয়ে উঠে। সেনাবাহিনী ও ইসলামী দলগুলো কমিউনিস্টদের ধরে হত্যা করতে শুরু করে। ৫ থেকে ১০ লাখ কমিউনিস্ট কর্মী নিহত হয় সেই দাঙ্গায়।
অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য সবাই সুকর্ণকে দায়ী করতে থাকে। ১৯৬৬ সালের ১১ মার্চে মেরদেকা প্যালেসে সভা চলাকালে ছাত্ররা প্রাসাদ ঘিরে ফেলে। সুকর্ণ পালিয়ে যান বোগর প্যালেসে। সেখানে সেনাবাহিনীর তিন জেনারেল গিয়ে সুকর্ণের পদত্যাগ পত্র সই করে নিয়ে আসে। শুরু হয় মার্শাল ল’। সুহার্ত ৩ দশকে বজ্রকঠিন হাতে দেশ শাসন করেছেন।
হার্টনু মল
প্রথমে তিনি কমিউনিস্টদের মাটির সঙ্গে গুঁড়িয়ে দেন। তারপর ইসলামী দলগুলোকে মাথাচাড়া দিতে দেননি। দারুল ইসলামের প্রভাব অনেকটা কমে আসে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে প্রচুর বিদেশী বিনিয়োগ আসতে থাকে। বিশেষ করে জাপানি। ইন্দোনেশিয়া তর তর করে এগিয়ে যেতে থাকে। তবে সুহার্ত ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ আছে। তারা বিলিয়ন ডলার ইন্দোনেশিয়া থেকে সরিয়ে নিয়েছে। এসব কারণেই সুকর্ণের ব্যাপারে খুব একটা কথা বলতে শোনা যায় না
ইন্দোনেশিয়ানদের মুখ থেকে। যোগজাকার্তা সুহার্তের জন্ম স্থান হলেও, তার ব্যাপারেও তারা নিশ্চুপ।মলে ইউন্ডো শপিং করে ফেরার পথে পড়লাম বিপদে। রাস্তায় কোন গাড়ি দাঁড়ায় না। সাঁ সাঁ করে ছুটছে। কীভাবে একটা গাড়ি ধরব সেটা জানারও উপায় নেই। কারণ পথচারী নেই। সবাই গাড়ি ব্যবহার করে। অগত্যা অনেকটা হেঁটে একটা ভুট্টা ভাজার দোকানে হাজির হলাম। স্বামী স্ত্রী মিলে ব্যবসা চালায়। তাদের বলতেই সানন্দে তারা এ্যাপসের মাধ্যমে গাড়ি ডেকে দিলো। তাদের বিনয় ও আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম। ফেরার সময় বুঝলাম যাওয়ার পথের গাড়িওলা আমাদের ঠকিয়েছে। অনেকটা পথ ঘুরে নিয়ে ভাড়া তুলেছিল ৪৫ হাজার রুপি। ফেরার সময় সেটা হলো মাত্র ২০ হাজার। (চলবে)
ইন্দোনেশিয়ায় এক সপ্তাহ: ৩য় পর্ব