ভ্রমণ

মেঘ পাহাড়ের বাংলাদেশে

আমাদের একটি মেঘের আলয় আছে। যেখানে মেঘেদের অবাধ আনাগোনা। এখানে আসলে মেঘদূত এসে আপনার সংবাদটি পৌঁছে দিবে প্রেয়সীর কাছে। কিংবা আপনি মেঘের মহাসমুদ্রে ভেসে বেড়াবেন যতক্ষণ ইচ্ছে। সারাদিন মেঘ ও রৌদ্রের লুকোচুরি খেলা চলতেই থাকে এখানে। ঘরের একটি জানালা দিয়ে মেঘ কুয়াশার রূপ নিয়ে ভাসতে ভাসতে এসে আপনাকে সিক্ত করে আরেকটি জানালা দিয়ে চলে যাওয়া এখানকার নিত্যদিনের ঘটনা। আছে অপরূপ দুটি পাহাড়ি নদী সাঙ্গু ও মাতামুহুরী। বাংলাদেশের সীমান্তে উৎপত্তি হয়ে ছোট-বড় পাহাড়, সমতল ভূমি পাড়ি নিয়ে বঙ্গোপসাগরে বিলীন হয়ে যাওয়া। বাংলাদেশের সবচাইতে উঁচু পাহাড় শ্রেণী, সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ, পাহাড়ি হ্রদ, ছোট-বড় অসংখ্য ঝরনাধারা, ১৫টি পাহাড়ি নৃ-গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন-সংস্কৃতি দেখার অপরূপ এক মেলবন্ধন এই বান্দরবান। 

বৈসাবি উৎসবে পাহাড় ভ্রমণে গেলে আনন্দ হয় অন্যরকম। ত্রিপুরা জাতিসত্তার বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই এবং চাকমাদের বিজু’র আদ্যাক্ষর মিলে হয়েছে বৈসাবি। বান্দরবান মারমা প্রধান জেলা। তাই এখানে ঘটা করে পালিত হয় সাংগ্রাই উৎসব। এই উৎসবের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ওয়াটার ফ্যাস্টিভ্যাল বা পানি উৎসব। যার উদ্দেশ্যে আমরা কয়েক বন্ধু বান্দরবান এসেছি। 

ঢাকা থেকে ছয় বন্ধু মিলে পাহাড় তীর্থের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি ১২ এপ্রিল, ২০০৭-এ। এই ভ্রমণটি ছিল আমাদের দুই পর্বের। প্রথম পর্বের বান্দরবানের ভ্রমণসঙ্গী সুজন, রিটন, জাহিদ, মাসুম এবং শামস। দ্বিতীয় পর্বের কেওক্রাডং অভিযানের আগেই কেউ কেউ ফিরে যাবে ঢাকায়। এরপর আরেকটি গ্রুপ এসে যোগ দেবে। আমি ও বন্ধু মাছুম শঙ্খ নদীর সেতু হয়ে থাকছি দুই পর্বেই। চৌদ্দগ্রাম ও চট্টগ্রামে যাত্রা বিরতি দিয়ে বাসটি আমাদের সকাল ৭টা নাগাদ বান্দরবানে পৌঁছে দিলো। ঢাকা থেকে বন্ধু দ্বীপায়নদা’র মাধ্যমে হোটেল রয়েল-এ বুকিং করা ছিল। রয়েলে পৌঁছে রিসেপশনে ঢুকেই পাহাড়ি ঐতিহ্যে সাজানো হোটেলের ইন্টেরিওর দেখে সকলের প্রথম অনুভূতি ছিল ‘বাহ্, দারুণ তো!’ বান্দরবান শহরের মাঝামাঝি অবস্থিত এই হোটেলে পৌঁছে হাত পা ঝেড়ে একটু বিশ্রাম নিই। হোটেলের বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও ভিতরে মারমা ঐতিহ্যে সাজানো রিশেপশন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কক্ষ সর্বোপরি মারমা হোটেল কর্মচারীদের আন্তরিকতাপূর্ণ সেবা আমাদের ভ্রমণজনিত ক্লান্তি অনেকটা দূর করে দেয়।

বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর বৌদ্ধ মন্দির কোনটি? বান্দরবান শহর থেকে ৮ কি.মি. দূরে জাদিতে অবস্থিত চকচকে সোনালি রঙের আলো বিচ্ছুরিত বৌদ্ধ মন্দিরটি সত্যি অতুলনীয়। জানি, চক চক করলে সোনা হয় না। তবে এই মন্দিরটি যেনো আক্ষরিক অর্থেই স্বর্ণ মন্দির। স্বর্ণ দিয়ে তৈরি করতে হয় না, কিছু বৈশিষ্ট্য সাধারণ বস্তুকেও মহামূল্যবান রত্মে পরিণত করতে পারে। জাদি স্বর্ণ মন্দিরটিও তাই। এটি কেবল উঁচু পাহাড়ের ওপর অবস্থিত বিশাল স্বর্ণ মন্দিরই নয়, এর ভেতরের কারুকার্য ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বৌদ্ধের মুখায়ব নিয়ে যে বেশ কয়েকটি সোনালী ধাতব ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে তা প্রতিটি পর্যটকের একবার হলেও দেখা প্রয়োজন। এখানে গৌতম বৌদ্ধ কখনো বাঙালি, কখনো নেপালী, কখনো ভারতীয়, কখনো থাই, কখনো ভিয়েতনামীসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের দেহ ও মুখায়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন! প্রতিটি ধর্মই এক একটা দেশে গিয়ে তার নিজস্ব একটি সাংস্কৃতিক রূপ পরিগ্রহ করে। কিছুটা হলেও পার্থক্য ঘটে ধর্মীয় আচার ও সংস্কৃতির। এখানে স্বয়ং ধর্ম প্রচারকই বিভিন্ন দেশের ব্যক্তির রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন! বিষয়টি বেশ চিত্তাকর্ষক বটে!  

তো এমনই এক আকষর্ণীয় মন্দিরের উদ্দেশ্যে আমরা ছয়জন পর্যটক তীব্র খরতাপ উপক্ষা করে পায়ে হেঁটেই রওয়ানা দেই। উদ্দেশ্য চলথি পথে পাহাড়িদের বসতি ও গ্রাম ইত্যাদি দেখা। পথিমধ্যে একটি পুরনো বৌদ্ধ ক্যায়াং (মন্দির) ঘুরে দেখি। এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবারও পথ চলতে থাকি। 

স্বর্ণ মন্দিরে পৌঁছে, পাহাড়ের পাদদেশে চায়ের দোকানি বললেন, এখন আপনারা উপরে উঠতে পারবেন ঠিকই কিন্তু মূল মন্দিরের ভেতর প্রবেশ করতে পারবেন না। কারণ এখন নিয়ম করা হয়েছে বিকাল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত দর্শনার্থীরা প্রবেশ করতে পারবেন। দোকানির কথা শুনে আমাদের হেঁটে আসার ক্লান্তিটা যেনো অনেকটাই বেড়ে গেলো। আমি নিজেকে কিছুটা দায়ী করলাম রয়েল হোটেল থেকে তথ্যটি না জেনে আসার জন্য। কী আর করা, দুধের সাধ কী আর ঘোলে মিটে? তারপরও আমরা পাহাড়গাত্রে উঠতে থাকি অন্তত একটু কাছে থেকে মন্দিরটি দেখবো বলে। কিছু ছবি টবি তুলে আসাতো যাবে। 

আমি পূর্বে এখানে এসেছি। কিছু সৌন্দর্য আছে বারবার দেখলেও তার আবেদন ফুরোয় না। ‘বুদ্ধজাদি’ যেনো এমন ধাতুতেই গড়া। ভালো কথা, আমরা চেষ্টা করলাম কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে ভেতরে ঢোকা যায় কিনা। সম্ভব হলো না। আমাদের বুঝতে হবে সবসময় অনুরোধে ঢেঁকি গেলানো যায় না। মন্দির কর্তৃপক্ষ বড় এক কথার মানুষ। বিকাল ছাড়া হবে না। অবশ্য নিয়ম নিয়মই। বেশি কথা বলেই বা কী হবে! একবার খুললে হয়তো খোলাই রেখে দিতে হবে। কারণ লোকজন একটু পরপর আসছেন। আমাদের এক বন্ধু সমস্ত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে লুকিয়ে কীভাবে যেনো মন্দির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে দেবালয়ে কিছুটা উত্তেজনার সৃষ্টি করে ফেলে। কিশোর মং দৌড়ে গিয়ে তাকে হাতেনাতে ধরে নিয়ে আসে। দেখে মনে হচ্ছিল পুলিশ আসামি ধরে নিয়ে আসছে। পার্থক্য একটাই আসামি বোকার মতো হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসছে। এই ‘পুলিশে’র ভূমিকাটা অবশ্য যথার্থই ছিল। নান্দনিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে গিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করার কোনো মানে হয় না। এটি ভ্রমণকারীদের কাজও নয়। সে যাক, বন্ধুটি ‘স্যরি-টরি’ বলে চলে আসে। অবশেষে আমরা স্বর্ণমন্দিরের পাহাড় থেকে নিচে নমে আসি। কিছুদূর হেঁটে রিকশাযোগে হোটেলে ফিরে আসি। 

সারারাত বাসযাত্রার পরও সবাই খুব উল্লসিত ও ভ্রমণের মেজাজে রয়েছে। দুপুরের খাবার সেরেই আবারো তীব্র রোদ উপেক্ষা করে সকলে বেড়িয়ে পড়তে চাচ্ছে শহরের অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থানে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। আমি একটু হাল ধরলাম। বলি, সবাই একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে বেরোবো হিল টপের উদ্দেশ্যে। সময় থাকলে মেঘলা বেড়িয়ে আসা যাবে। 

সব মিলিয়ে বাংলাদেশের একখণ্ড বৈচিত্রপূর্ণ অঞ্চল পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম। কিন্তু বৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। বান্দরবান শহর ও তার মানুষজনের দিকে লক্ষ্য করলে মনে হবে না আমরা কোনো পাহাড়ি শহরে এসেছি। বাংলাদেশের যে কোনো মফস্বল শহরের মতো ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, হোটেল, রেস্তোরাঁ, রিকশা, স্কুটার, কাঁচাবাজার, দোকান-পাট সব একই রকম। বিশেষ করে পাহাড়ি-বাঙালি অনুপাতের ভারসাম্য এখন বাঙালিদের দিকেই ঝুকে আছে। সর্বত্রই বাঙালিদের বিচরণ। কদাচিৎ দেখা মেলে পাহাড়িদের। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের অপরাজনীতি। 

বিকেলে আমরা হিলটপে বসে থাকি সন্ধ্যা নামা পর্যন্ত। হিলটপ থেকে শহরের বড়ো অংশই অবলোকন করা যায়। হিলটপে রয়েছে সার্কিট হাউজ ও জেলা পরিষদের ডাকবাংলো। অবশ্য পুরো শহর দেখার জন্য আরো উঁচু একটি পাহাড় রয়েছে, যেটি একসময় টাইগার হিল নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে এর নাম পাল্টিয়ে রাখা হয়েছে নীলাচল। হিলটপ থেকে নেমে শহরের মূল মন্দির বা ক্যায়াং ছাড়াও জাদির অনুকরণে ছোট আকারের আরো কিছু ভিন্নধর্মী সোনালী ও সাদা কংক্রিটের বৌদ্ধ মন্দির দেখা যায়। এগুলোও পাহাড়ের উপর। সন্ধ্যার পর বেশ খানিকক্ষণ শহরে উদ্দেশ্যহীন হেঁটে বেড়াই আমরা। শহরের বড় মন্দিরটিতে বৈসাবী উৎসবের বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালনের ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে দেখতে পাই । 

বন্ধুরা রাত যেনো আরো দীর্ঘ হয় তার ব্যবস্থা করতে লেগে গেলো। বাঙালির চিরাচরিত আড্ডা চলে গভীর রাত অবধি। এক বন্ধুর মনোজগতে চলছে টানাপোড়েন। ভীষণ ত্রাহি অবস্থা তার! মড়ার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে এসেছে এই পাহাড়ি শহরে তখন মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। ফলে বারবার ফোনের দোকানে যেতে হচ্ছে তাকে। ঊষর মরুতে দু’এক ফোটা বৃষ্টিতে কী আর স্বস্তি মেলে? ফোন দোকানগুলো থেকে আবার বিভিন্ন বেসরকারি ল্যান্ড ফোন থেকে মোবাইলে ফোন করা যায়। যদিও এগুলোতেও নেটওয়ার্কে ভীষণ সমস্যা। সমতলের ৬১টি জেলায় মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় চলে এলেও এই তিন পাহাড়ি জেলাগুলোতে তখনো আসেনি। 

আজ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। বাঙালিদেরও সবচেয়ে বড় উৎসব- বৈশাখী উৎসব। ঢাকাসহ সারাদেশ আজ উৎসবের সাজে নিজেকে রাঙাবে। মেতে উঠবে আনন্দ ও উল্লাসে। প্রতিবারই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক অনুষ্ঠান দেখা হয়। যদিও এখন তা আমাদের কাছে একঘেয়েমিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই একটু বৈচিত্র্য খুঁজতে আমাদের পাহাড়ে আসা। সকালে ঘুম থেকে উঠে জীপ খুঁজতে গিয়ে ভেবেচিন্তে একটা ভ্রমণ পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলি। অবশ্যই জিপের চালক আমিনুলের পরামর্শ অনুযায়ী ভ্রমণ রুট ও স্থানগুলো চূড়ান্ত করি। মিলনছড়ি, শৈলপ্রপাত, চিম্বুক, নতুন আকর্ষণ নীলগিরি, শহরের উচ্চতম স্থান নীলাচল, জনপ্রিয় স্পট মেঘলা, খানিকটা দূরে প্রান্তিক লেক সবই থাকে ভ্রমণসূচিতে। 

রাজবাড়ির পাশে রী স্বং স্বং রেস্তোরাঁয় নাস্তা সেরে সকলে জীপে চড়ে বসি। খুলনার ছেলে আমিনুল বেশ চটপটে ও বান্দরবানের ট্যুরিস্ট স্পট সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখে। এখানে তার পরিবার স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। আমাদের যাত্রা শুরু হলো চিম্বুক অভিমুখে। মিলনছড়ি ছাড়িয়ে আমরা যখন খাড়া পাহাড়ি পথে উঠতে থাকি তখন সবাই দারুণ রোমাঞ্চ ও প্রকৃতির সান্নিধ্যের ভালোলাগা বোধে আচ্ছন্ন হই। এই পাহাড়ি পথেই থানচি ও রুমাবাজার যেতে হয়। চিম্বুকের কাছে একটি স্থান ওয়াই জংশন নামে পরিচিত। ওয়াই জংশনের একদিকে চলে গেছে রুমা সড়ক, অপরদিকে থানচি। থানচি সড়কে একটু এগুলেই চিম্বুক। 

বান্দরবান শহর থেকে ২০ কি.মি. দূরে অবস্থিত চিম্বুকে যেতে যেতে বাংলাদেশের উচ্চতম পাহাড় সারিগুলো দেখা হয়ে যাবে। দূরে আরো দূরে যতোটুকু দৃষ্টি যাবে পাহাড় আর পাহাড়। চিম্বুক যেতে রাস্তার বাম দিয়ে অনেক উঁচু থেকে সর্পিল গতিতে ধেয়ে চলা সাঙ্গু নদীর সৌন্দর্য মুগ্ধ করে আমাদের। একইসাথে পাহাড়গুলোর বৃক্ষশূন্যতা কষ্ট দেয় সবাইকে। অবশেষে বাংলাদেশের অন্যতম উঁচু একটি পাহাড় চিম্বুকে পৌঁছে গেলাম। আমি প্রথম যখন বান্দরবান এসেছিলাম তখন চিম্বুক ছিল পাহাড়ি পথে সড়ক সংযুক্ত শেষ গন্তব্য। এরপর পায়ে হেঁটে যেতে হতো। এখন কেওক্রাডং পর্যন্ত জীপ নিয়ে যাওয়া যায়। চিম্বুকে সাদা মেঘেদের মেলা বসে। কখনো কখনো মেঘ আপনাকে কুয়াশার চাদরে মুড়ে দিয়ে যাবে। আজ দূর আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে আলস্য ভঙ্গিতে আছে মেঘেরা। পরিষ্কার আকাশে চিম্বুক থেকে বঙ্গোপসাগর দেখা যায়। আজ আকাশ তেমন পরিষ্কার নয়। আমরা চা পর্ব সেরে, ক্যামেরায় একের পর এক ছবি তুলে রওয়ানা হয়ে যাই নীলগিরির দিকে। চিম্বুক থেকে পাহাড়ি পথে আরো ২২কি.মি. যেতে হবে তবেই দেখা মিলবে নীলগিরির। 

নীলগিরির কথা আমরা জেনেছি পত্রিকায় পড়ে। এটি উদ্বোধন হয়েছে এক সাপ্তাহ হয়নি। নীলগিরির পথ একমদম অন্যরকম মনে হলো। এখানে পাহাড়ের উচ্চতা ও ঢাল ভিন্ন রকম সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীলগিরিতে তখন মাত্র দুটো কটেজ ছিল। এরপর অবশ্য আরো হয়েছে। নীলগিরির যে বৈশিষ্ট্য আমাদের একইসাথে চমৎকৃত ও আনন্দিত করে। এখানে সারা বছর ঠান্ডা থাকে। তীব্র রোদের মধ্যেও আমরা হিমেল বাতাসের পরশ পাচ্ছিলাম। সারা বছরই লেপ গায়ে দিয়ে ঘুমুতে হয়। বাহ্, তাহলে দার্জিলিং বা শিলংয়ের  মতো জায়গা বাংলাদেশেও আছে! আমরা খুবই উল্লসিত এমন একটি স্থানে এসে। তখন আরো ভবন তৈরির  কাজ চলছিল। আমরা ভাবছিলাম হয়তো একসময় নীলগিরি হয়ে উঠবে বাংলাদেশের আকর্ষণীয় শৈলনিবাস।

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য শহরের কাছে নীলাচল। আমাদের বাহনটি নামতে শুরু করলো বান্দরবান শহরের দিকে, নীলাচলের পথে। পাড়ি দিতে হবে প্রায় ৪০ কি.মি. পথ। পথে যেতে যেতে মাঝে মাঝেই পাহাড়ি তরুণ-তরুণীদের দলবদ্ধভাবে কোথাও যাওয়া দেখে আমিনুলকে বললাম, আশেপাশে কোনো গ্রামে মেলা হচ্ছে  নিশ্চয়? আমরা একটি পাহাড়ি গ্রাম দেখবো আমিনুলকে বলে রেখেছিলাম। আমিনুল আমাদের একটি জমজমাট মেলাতে নিয়ে আসে। মূল সড়ক থেকে প্রায় এক কি.মি. পথ পায়ে হেঁটে নিচে নেমে তবে মুরং গ্রাম- যেখানে মেলা বসেছে। মেলায় এসে আমরা সত্যি মুগ্ধ হয়ে যাই। সত্যিকার অর্থে পাহাড়িদের একটি মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে গ্রামটি। এখানে বারোয়ারী মেলার সকল পসরা নিয়ে পাহাড়ি দোকানিরা বসেছে। পাহাড়ি ছেলে মেয়েরা রঙিন জামাকাপড় পড়ে নিজেদের অপরূপ সাজে সাজিয়েছে। রয়েছে পাহাড়ি হস্তশিল্প, শিকার সামগ্রী, মাটির তৈজসপত্র, বাঁশের রকমারি সামগ্রী, নানা ধরনের খাবারসহ আরো কতো কী! আমাদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্বটি ছিল তরুণদের শক্তি পরীক্ষার প্রতিযোগিতা দেখা। আড়াআড়ি একটি বাঁশ দিয়ে দুই তরুণ শক্তি পরীক্ষায় নামবে। বাঁশ ঠেলে যে একজন অন্যজনকে কাবু করবে সেই জিতবে। খেলায় বয়োজ্যেষ্ঠ বিচাররক রয়েছেন। মজাটা অবশ্য এখানে নয়, অন্যখানে। 

এই খেলায় যে তরুণ জয়লাভ করবে তাকে পছন্দ করবে উপস্থিত অনেক তরুণী থেকে কোনো এক তরুণী। শক্তির এই পরীক্ষা প্রতীকী। আসলে জীবন সঙ্গীনী খোঁজার একটি জমজমাট আয়োজন। হুলস্থুলের মধ্যে আমাদের এক বন্ধু আবিষ্কার করলো এক তরুণকে দুজন তরুণী পছন্দ করে ফেলেছে। ফলে বেঁধেছে মহাবিপত্তি। তরুণটিকে নিয়ে কিঞ্চিৎ টানা হেঁচড়াও হয়ে গেলো। অবশেষে শরণ হতে হলো বিচারকের। আমরা সবাই রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায় থাকি কী হয় বিচারকের রায়? বিচারক অবশ্য বেশ কৌশলী রায় দিলেন। তিনি দুজন তরুণীর মধ্য থেকে ছেলের পছন্দের একজন তরুণীকে নির্বাচন করার রায় দিয়ে এই মহাসংকটের সমাধান করলেন! আমরাও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। ঘোরাঘুরি ভুলে গিয়ে আমরা সবাই দারুণ উপভোগ করছিলাম মেলা। এমন সময় ‘বেরসিক’ আমিনুল তাড়া দিলো চলেন, আরো অনেক স্পটে যেতে হবে। কী আর করা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফিরে আসতে হলো গাড়িতে।