ভ্রমণ

দোগারি পর্বতে বাংলাদেশের প্রথম অভিযান

কালীগন্দাকী নদীর তীরে এসে দাঁড়ালাম। আজ পাঁচ সেপ্টেম্বর, ২০২২। ঘড়িতে সময় সকাল ১০টা বেজে ১৫ মিনিট। এটি বেশ প্রশস্ত পাথুরে খরস্রোতা নদী। দেখে মনে হচ্ছে নদীর মধ্যে বিভিন্ন স্থানে পাথুরে চর জেগে আছে। নেপালের যে ক’টা বড় নদী আছে তার মধ্যে কালীগন্দাকী অন্যতম প্রধান। 

উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত এই গন্দাকী ‘নারায়ণী’ এবং ‘গন্দাক’ নামেও পরিচিত। এই নদী নেপালের হিমালয়ের মধ্যে দিয়ে সবচেয়ে গভীর গিরিখাতের নদী হিসেবে পরিচিত। বলা হয়ে থাকে, যদি কেউ নদীর গভীরতা থেকে উভয় পাশের সর্বোচ্চ শিখরগুলির উচ্চতা নির্ধারণ করে গিরিখাতের গভীরতা নির্ধারণ করা হয় তাহলে এই গিরিখাতটি বিশ্বের গভীরতম গিরিখাত। পৃথিবীতে ১৪টি আট হাজার মিটার বা ২৬ হাজার ফুটের অধিক উচ্চতার পর্বতশৃঙ্গ রয়েছে। এই ১৪টি পর্বতের মধ্যে তিনটি পর্বত ধাউলাগিরি, মানাসলু এবং অন্নপূর্ণা-১ এই নদীর অববাহিকায় মেঘ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ধাউলগিরি পর্বতশৃঙ্গটি গন্দাকী নদীর অববাহিকার সর্বোচ্চ স্থান। নেপালের মুস্তাং অঞ্চলের তিব্বত সীমান্তে ৬ হাজার ২৬৮ মিটার বা ২০ হাজার ৫৬৪ ফুট উচ্চতার নুবিন হিমালের (Nhubine Himal) হিমবাহ থেকে কালি গন্দাকী নদীর উৎপত্তি।  

নদীর ওপারেই কাগবেনি গ্রাম। দূর থেকে গ্রামটিকে দেখে মনে হচ্ছে ছোট্ট একটি সাজানো-গোছানো শহর। একদম নদীর পাড়ে গ্রামটি যুগের পর যুগ টিকে আছে তার সন্তানদের নিয়ে। হিমালয়ের সব থেকে পুরনো গ্রামগুলোর মধ্যে কাগবেনি অন্যতম। এই গ্রামের উচ্চতা দুই হাজার আটশ দশ মিটার। আমি এবং গাইড অর্জুন রায় গ্রামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। পুরনো একটি কাঠের পুল নদীর দুপাশ একত্র করেছে। এতোই পুরনো যে শেওলা জমে আছে গাছের গুড়িতে। মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে। পুলটি পেরিয়ে কাগবেনি গ্রামে প্রবেশ করলাম। গ্রামে ঢোকার শুরুতেই সবুজ গাছের ছায়ার অভ্যর্থনা। হাতের বামে রাস্তার পাশেই হলুদ রঙের ছোট মন্দির। মন্দিরের বাইরে লোহার ফ্রেমে অনেকগুলো ছোট-বড় কাসার ঘণ্টা ঝুলছে। সরু গলি পথ। পথের দু’পাশেই বাড়িঘর, রেস্টুরেন্ট, দোকান। পাথর বিছানো পথ ধরে গ্রামের ভিতরে ঢুকছি। 

এশিয়া ট্রেকার্স হোম নামক একটি হোটেলে ঢুকলাম। হোটেলের সামনে সামান্য ফাঁকা জায়গা সবুজ ঘাসের চাদরে মোড়ানো। চারপাশে বিভিন্ন রঙের ফুল ফুটে আছে গাছে। কাঁচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই হোটেলের মালকিন এসে হাসি মুখে দুই হাত জোড় করে ‘নমস্তে’ বলে অভ্যর্থনা জানালো। আমরাও হাত জোড় করে ‘নমস্তে’ বলে উত্তর দিলাম। রিসিপশনে রুকস্যাক রেখে প্রথমেই কিচেনে গিয়ে বসলাম। মালকিন আমাদের গরম চা করে দিলেন। গাইড আর মালকিন গল্প করছে। আমি চায়ে চুমুক দিতে দিতে মোবাইল ফোন বের করে ফ্লাইট মুড অফ করলাম। ট্রেকিং এর সময় পাহাড়ের ভিতরে যেহেতু নেটওয়ার্ক ছিল না আর মোবাইল ফোনের চার্জ যেন দ্রুত শেষ না হয় সেজন্য সব সময় ফোনের ফ্লাইট মুড অন করে  রাখি। ফ্লাইট মুড অফ করার সাথে সাথেই নেটওয়ার্ক পেয়ে গেলাম। হোয়াটস অ্যাপ আর ফেসবুক মেসেঞ্জারে বিভিন্নজনের মেসেজের নোটিফিকেশন একাধারে আসতে শুরু করলো। যেহেতু দীর্ঘদিন পর নেটওয়ার্কে এসেছি অনেকেই আমার অবস্থান জানতে চেয়ে মেসেজ করে রেখেছেন। বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং এন্ড ট্রেকিং ক্লাবের প্রেসিডেন্ট এমএ মুহিত ভাইয়ের একটি মেসেজ চোখে পড়লো। মেসেজে লেখা ‘শাকিল নেটওয়ার্কে এলে একবার কল দিবেন, জরুরি কথা আছে’। 

মুহিত ভাইকে কল দেওয়ার আগে ইনাম আল হক স্যারকে কল দিলাম। স্যারকে কল দিয়েই আমার বর্তমান অবস্থান জানালাম। তিনি আমাকে অভিনন্দন ও শুভকামনা জানালেন শুরুতেই। তারপর তিনি আরো বললেন, ‘শাকিল বিএমটিসি থেকে একটা অভিযানের প্ল্যান করা হচ্ছে। আগে কোনো অভিযান হয়নি এমন একটি পর্বত চূড়ায়। আপনি যেহেতু দীর্ঘদিন হিমালয়ে আছেন, আপনি অভিযানের জন্য অ্যাক্লামাটাইজ আছেন। আপনি টিমে থাকলে ভালো হবে আশাকরি। আপনি কি অভিযানে যোগ দিতে পারবেন? মুহিতও আপনার সাথে কথা বলবেন হয়তো।’ 

আমি কোনো চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই বললাম, নিশ্চই স্যার। যদি সুযোগ পাই অবশ্যই অভিযানে যোগ দেবো। স্যার আবার বললেন, ‘আপনি কি সময় মতো আপনার অভিযান থেকে আসতে পারবেন? আমি বললাম, আসতে পারবো স্যার। আমাকে শুধু কয়টা দিন আগে জানালেই হবে। আমি সময় মতো কাঠমান্ডুতে চলে আসবো। স্যার আমাকে আবার শুভকামনা জানিয়ে আজকের মতো ফোন রেখে দিলেন। 

ইনাম আল হক স্যারের সাথে কথা শেষ করেই মুহিত ভাইকে কল করলাম। তিনি প্রথমে আমার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিলেন। তারপর বললেন, ‘শাকিল আগামী মাসের শুরুতেই একটা অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছি। বাংলাদেশ ও নেপালের কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে নেপাল-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ এক্সপিডিশান করতে চাচ্ছি। নেপাল থেকে চারজন শেরপা পর্বতারোহী থাকবে এবং বাংলাদেশ থেকে চারজন থাকবো। আপনার গ্রেট হিমালয় অভিযান থেকে এসে আমাদের সাথে যোগ দিতে পারবেন? যদি সেটা পারেন তাহলে আমরা বাংলাদেশ থেকে তিনজন আসবো আর কাঠমান্ডু থেকে আপনি যোগ দেবেন।’

আমি ভাইকে বললাম, আমি সুযোগ পেলে অবশ্যই অভিযানে যোগ দিতে চাই। আমাকে কবে কাঠমান্ডুতে চলে আসতে হবে সেটা সপ্তাহখানেক আগে জানালেই হবে। আমি সময় মতো চলে আসবো। তিনি বললেন, ‘৩ সেপ্টেম্বর কাঠমান্ডুতে আসার ইচ্ছে আছে। তবে এখনো নিশ্চিত না। স্পন্সর আর বিমানের টিকেটের উপর নির্ভর করবে। তারিখ ঠিক হলে জানাবো। আপনি প্রস্তুতি নিয়ে রাইখেন।’ 

কাগবেনি থেকে গাইড অর্জুন রায় কাঠমান্ডুতে ফিরে গেল। আমি একা রয়ে গেলাম। এখানেই একদিন বিশ্রাম করবো বলে। এই কাগবেনি থেকে মুক্তিনাথ ও থ্রংলা পাস অতিক্রম করে মানাং হয়ে অন্নপূর্ণা সার্কিট সম্পূর্ণ করে কাঠমান্ডুতে ফিরে যাব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। কাঠমান্ডুতে গিয়ে মুহিত ভাইদের সাথে অভিযানে যোগ দেব। যেই ভাবা সেই কাজ। অন্নপূর্ণা সার্কিট শেষ করে ধারাপানি থেকে জিপে করে বেসিশহর চলে আসি। বেসিশহর এক রাত থেকে কাঠমান্ডু ফিরে আসি। কাগবেনি থেকে অন্নপূর্ণা সার্কিট হয়ে কাঠমান্ডু ফিরে আসার গল্প ‘দ্য গ্রেট হিমালয় ট্রেইল’ অভিযান নিয়ে লেখা বইটিতে বিস্তারিত পাবেন পাঠকগণ। 

১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২। অভিযানের প্রথম অংশ শেষ করে ৫২ দিন পরে কাঠমান্ডুতে এলাম। কাঠমান্ডুর বালাজো নতুন বাস টার্মিনালের সামনে এসে বাস থেকে নামলাম বিকেল তিনটার দিকে। অসমিতা দিদিকে ফোন দিয়ে বললাম, দিদি আমি বালাজো আছি। তুমি কি বাসায় আছ? দিদি বললেন, হ্যাঁ আছি। তোমার জন্য কি খাবার তৈরি করে রাখবো? আমি বললাম, করতে পারো। আমি থামেল হয়ে আধা ঘণ্টার মধ্যেই চলে আসব। রাস্তার পাশে অনেক মটরসাইকেল দাঁড়িয়ে আছে। চালকরা যাত্রিদের ডাকছে। মটরসাইকেলগুলো ভাড়ায় যাত্রীদের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেয়। এটা বেশ ভালো সার্ভিস। অল্প টাকায় যাতায়াত করা যায় কম সময়ে। 

বালাজো থেকে সোজা প্রথমে চলে এলাম থামেলের আমরিত মার্গ ছায়া সেন্টারের পাশে মাকালু ই-টেডার্স এর শো-রুমে। মাকালু ই-টেডার্স এর স্বত্বাধিকারী বিনোদ মানি রায়ের সাথে দেখা করতে। শো-রুমেই বিনোদকে পেয়ে গেলাম। দূর থেকে আমাকে দেখেই শো-রুম থেকে বেরিয়ে এসে অভিনন্দন জানিয়ে বুকে টেনে নিলেন। বললেন, ‘শাকিল জি, কেমন আছ? অভিযান কেমন হলো? আমি বললাম, ‘দাই (ভাই) আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছ? তিনি বললেন, ‘ আমিও ভালো আছি। চলো ভিতরে আগে বসি।’ আমরা শো-রুমের ভিতরে গিয়ে বসলাম। শো-রুমের কর্মী মেলিনা আমাদের চা বানিয়ে দিলো। চা খেতে খেতে অভিযানে অভিজ্ঞতা শোনালম। ‘দাই বাস থেকে নেই সোজা তোমার সাথে দেখা করতে চলে এলাম। এখন বাসাই যাই কাল আবার আসবো।’ বলেই বেরিয়ে এলাম। আবার মটরসাইকেল নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। 

তুলনামূলক ট্রাফিক জ্যাম আজ কমই পেলাম। অল্প সময়ের মধ্যেই চলে এলাম। মহারাজগঞ্জ চক্রপথ মোড় থেকে বামে বাঁশবাড়ি রোডে ঢুকলাম। হোটেল সাম্বালা থেকে একটু সামনে এগিয়ে অস্ট্রেলিয়ান দূতাবাস। দূতাবাসের উল্টাপাশের গলি দিয়ে বাংলামুখি টেম্পলের সামনে এসে মটরসাইকেল থেকে নেমে গেলাম। ভাড়া এসেছে মাত্র ১২০ টাকা। কাগেশ্বর মার্গ এর ৮১ নাম্বার বাসার গেটের কলিংবেল চাপতেই অসমিতা দিদি গেট খুলে দিয়ে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছ? 

আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছ? কুশল বিনিময় করতে করতে বাসার ভিতরে ঢুকলাম। আমাকে বললো, তুমি উপর থেকে ফ্রেশ হয়ে আসো, আমি তোমার খাবার রেডি করে টেবিলে দিচ্ছি। সিঁড়ি বেয়ে আমি উপরে উঠে এলাম। তিন তলা বাসার দ্বিতীয় তলায় থাকেন মিল্লাত ভাই আর আমি থাকি তৃতীয় তলায়। কাঠমান্ডুতে এই বাসাতেই আস্তানা গেড়েছি। পুরো বাসাতে মিল্লাত ভাই একাই থাকেন। তিনি বাংলাদেশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারী হিসেবে কর্মরত আছেন।

টেবিলে খাবার দিয়েছে অসমিতা দিদি। অনেকদিন পর পদ্মার ইলিশ দিয়ে ভাত খাচ্ছি। ভাবছেন কাঠমান্ডুতে বসে পদ্মার ইলিশ কিভাবে পেলাম? মিল্লাত ভাইয়ে স্ত্রী ভাবি ও বাচ্চা এসে ঘুরে গেছেন কয়েকদিন আগেই। তখন আমি ডোলপাতে ট্রেকিং করছিলাম। ঢাকা থেকে আসার সময় ভাবি ইলিশ মাছ এনেছিলেন। খাবার খেতে খেতে অসমিতা দিদিকে বললাম, ‘ইজি, খালাক সিমবোদু।’ দিদি কথার অর্থ না বুঝতে পেরে হেসে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এর অর্থ কি?’ এর অর্থ দিদি খাবার অনেক সুস্বাদু হয়েছে। এক গাল মুচকি হেসে আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘চা দেবো?’ আমি বললাম, ‘না, বাইরে গিয়ে খাবো। 

খাবার শেষ করে বাসার পাশেই মিডসিটি ক্যাফেতে এলাম। এই ক্যাফেতে সাঙচিতা নামের আমার এক বন্ধু আছে। সে বেশ মিশুক এবং মুখে যেন তার হাসি লেগেই থাকে সবসময়। আমাকে দেখেই কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘ কেমন আছে? অভিযান কেমন হলো? আমি বললাম, ‘ভালো আছি। অভিযান ভালো হয়েছে তবে শেষ হয়নি, একটা বিরতিতে এসেছি।’ সে নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমাকে কি মাসালা দুধ চা দেবো?’ আমি যে আগে মাসালা দুধ চা নিয়মিত খেতাম সেটা সে মনে রেখেছে। আমি বললাম, ‘তোমার দেখি মনে আছে, স্মরণশক্তি অনেক ভালো। দাও, দুধ চা দাও।’ (আগামী পর্বে সমাপ্য)