ভ্রমণ

রাঙ্গামাটির দূর পাহাড় সাজেকের বাঁকে (তৃতীয় পর্ব)

পরদিন ভোরের আভা কিছুটা কেটে যাওয়ার পর আমি ঘুম থেকে জেগে ওঠে বিছানা হতে কাঁচের দরজা দিয়ে সামনের দিগন্তপানে তাকালাম। আমাদের কটেজের বারান্দার খুব কাছাকাছি আর নিচের পাহাড়ের ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে বরফের মতো সাদা মেঘের পাল। রাত্রির অন্ধকার ভেদ করে ভোরের আবছা আলো জেগে উঠলেও সূর্য উদয় হয়নি। ধীরে ধীরে আমি বারান্দায় গিয়ে প্রকৃতির রূপ সৌন্দর্য অবলোকনের জন্য দৃষ্টি দিয়েছি। এদিকে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রস্থিত হয়ে রুবেল মিয়া, আল আমিন, মোয়াজ্জেম, নাইমুল আর জাকারিয়া ভাই রিসোর্ট হতে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি পেছন ফিরে জানতে চাইলাম কোথায় যাচ্ছেন আপনারা? সহকর্মী জাকারিয়া বলল, কিছুক্ষণ পর মিজোরামের পাহাড়ের বুক চিঁড়ে দিগন্তে সূর্য উদয় হবে। সূর্য উদয়ের মুহূর্তে সামনের পাহাড় শ্রেণীতে অভূতপূর্ব এক দৃশ্যের অবতারণা হয়, যা দেখতে হেলিপ্যাডের মাঠে যাচ্ছি। বললাম, তোমাদের সাথে আমিও যাব, নেবে আমাকে? কটেজ হতে আমরা মুগ্ধ মনে হেলিপ্যাডের মাঠে এসে কয়েকজন দাঁড়ালাম।

ভোরের সূর্যোদয়ের আগে নিচের পাহাড়ের গাছগাছালির ওপর মেঘের খেলা চলছে। অপেক্ষার প্রহর গুনছি কখন উঠবে আর দূর আকাশের নিচে থাকা পাহাড়ের চূড়া ভেদ করে রক্তিম আভা নিয়ে সূর্য মাথা উঁচু করে বেরিয়ে আসবে। সূর্য যখন পূর্ব দিগন্তের মিজোরামের পাহাড়ের ওপারের বুক চিঁড়ে জ্বলে উঠার প্রস্থিতই নিচ্ছে, তখন পাহাড়ের চূড়ার মেঘগুলো সাদা হতে ধীরে ধীরে হলুদ স্বচ্ছ বর্ণ ধারণ করছে। তারপর হলুদ রঙের মেঘগুলো কয়েক মুহূর্তে ঝলসানো সোনালী রং ধারণ করলো। অবশেষে, থালার মতো গোল জ্বলন্ত সূর্য নিজ অস্তিত্বের জানান দিতে পাহাড়ের চূড়ার ওপারের দিগন্ত পেরিয়ে দ্যুতি ছড়িয়ে বেরিয়ে এলো আকাশে। 

পড়ুন: রাঙ্গামাটির দূর পাহাড় সাজেকের বাঁকে (প্রথম পর্ব)

নাইমুল ভাই বলল, সূর্য কিন্তু এক জায়গাতেই স্থির আছে, আমাদের বসবাসের পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছে ওর চারপাশে। স্রষ্টার যে কত কারিশমা এটা নিয়ে আমরা কখনো ভাবি না। সাজেকের বাঁকে বাঁকে ঘুরে আমরা শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য অবলোকন করে যাচ্ছি। জাগতিক অন্য কাজের ভাবনায় না থেকে শুধু প্রকৃতির সাথে থাকলে মন—প্রাণ—দেহ পুলকিত হয়ে এক বিশুদ্ধ চিন্তা প্রবেশ করে মস্তিষ্কের অনুভবে। সত্যি, সাজেকের প্রভাত এবং প্রাতঃবেলায় সূর্যের উদয়—অস্ত দেখার সুখানুভূতি হয়ত দীর্ঘদিন স্মৃতির পাতায় থেকে যাবে। আসলে সাজেকের এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে অকবিও হয়ে উঠবেন কবি, অপ্রেমিকও হয়ে উঠবেন  প্রেমিক, একজন সচেতনও অবচেতনে হয়ে উঠবে অন্য রকম উন্মাদ। এমন প্রকৃতির সান্নিধ্য পেলে একজন বৃদ্ধও সবুজ আর মেঘের সুরা পান করে হয়ে উঠবে তেজদীপ্ত তরুণ। ফিরতি পথে মনোলোভা রিসোর্টে গিয়ে সহকর্মী সঞ্জয় বনিক আর তন্ময় ভাইয়ের সাথে মোলাকাত করে ব্যালকনিতে আড্ডা হলো, একসাথে ক্যামেরাবন্দী হলাম।  

  মনোলোভা রিসোর্টে আড্ডা পরবর্তী কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে

তারপর সকালের নাস্তা সেরে রুমে ফিরে এলাম। রুমে ফিরে এসে বিশেষ কারণে আমার মন খারাপ হয়ে আছে। দু’ঘণ্টা পর সহকর্মীরা বলল, ওরা সবাই ঐতিহ্যবাহী লুসাই গ্রামে যাচ্ছেন। ঐতিহ্যবাহী স্থানে ভ্রমণের সব সঙ্গীরা একসাথে হয়ে আড্ডা হবে। আসলে আমার ছোট্ট মেয়ে সামিহা ভ্রমণের ঠিক আগে প্রচণ্ডরকম জ্বরের কারণে ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিল, যার কারণে তিন রাত আমার ঘুমে বিভ্রাট ঘটেছে। রেশ ভ্রমণে এসেও তা কাটেনি। তাছাড়া আমার সহধর্মিণী বন্যা আর দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া আদুরে ছেলে ওয়াসীর খুব ইচ্ছে ছিল বড় পাহাড় দেখার। সামিহার অসুস্থতা আর বয়স কম হওয়ায় ওদের নিয়ে আসতে না পারার কারণেই আমার মন খারাপ হয়ে আছে। শরীরের ক্লান্তি আর মনের অবসাদ কাটাতে আমি ঐতিহ্যবাহী লুসাই গ্রামে না গিয়ে ঘুমের সমুদ্রে ডুবে গেলাম। 

ঘণ্টা তিনেক পর রুবেল মিয়া আর জাকারিয়া ভাই গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে লুসাই গ্রাম হতে ফিরে রুমে প্রবেশ করেই দাপাদাপি করছে। দু’জনের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। উঠে দেখি ফ্যান ঘুরছে না আর আমার পুরো শরীর ঘামে ভিজে ক্যাঁতক্যাঁতে হয়ে আছে। আমি বিছানা হতে উঠে বসে জানতে চাইলাম কেমন লেগেছে ওখানে? জাকারিয়া ভাই নাক সিটকে বলল, ভেবেছিলাম লুসাই গ্রামে লুসাই উপজাতিদের বসবাস। বাস্তবে ঐ গ্রামে মানুষ তো নয়ই বরং গরু ছাগল ভেড়া বা অন্য কোনও প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুরোটাই কৃত্রিমভাবে সজ্জিত একটা জাদুঘর, প্রকৃতির তেমন ছোঁয়া নেই। পাশের রুম থেকে মোয়াজ্জেম এসে বলল, না ভাই। ওখানে ছোট বাচ্চা মহিলা আর আমরা সবাই মিলে খুব আনন্দ করেছি। 

ঐতিহ্যবাহী লুসাই গ্রামে ভ্রমণকারী দলের সবাই আনন্দ উল্লাসে মগ্ন

খানিক বাদে ঈশান কোণে দেখা দিলো একটুকরো ঘন কালো মেঘ। দেখতে দেখতে কালো মেঘ সারা আকাশ ছেয়ে ফেলল। মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল উজ্জ্বল সূর্য। অকস্মাৎ একটা প্রচণ্ড বজ্রপাতের শব্দ হল, থরথর করে কেঁপে উঠছে কটেজ। গোটা আকাশ একটা বিধ্বংসী বর্ষণ ধারায় ভেঙে পড়ল। শুরু হয়ে গেল প্রচণ্ড ঝড়—বৃষ্টি। বাতাসের দাপটে পাহাড়ের গাছের ডাল নুইয়ে পড়ছে আবার জেগে উঠছে, কান ফাটানো শব্দে বিজলি আলোকিত করে দিচ্ছে চারদিক। ঝড়ে হাওয়া আমাদের কটেজের চালা উড়িয়ে নিয়ে যায় কিনা, অথবা হাওয়া দরজার ফাঁক দিয়ে চট করে ঢুকে রুমের জিনিসপত্র এলোমেলো করে দেয় কি না, সে ভাবনায় আমরা মগ্ন। ঝড়-বৃষ্টির তাণ্ডব দেখে প্রথমে গম্ভীর হয়ে গেল আমাদের মুখ। অন্যদিকে, প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাচ্ছি।

সাজেকে কখনও রোদ্দুর আবার হঠাৎ-ই আকাশ মেঘে ঢেকে গিয়ে বজ্রপাতের চমকানি শুরু হয়। আবার খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গুমোট আবহাওয়া শুরু হয়ে তাপপ্রবাহের সৃষ্টি হয়। এখানে প্রকৃতি কখন যে কী রূপ ধারণ করে তা বোঝা মুশকিল। প্রকৃতির আচরণে মনে হয় এটা বিধাতার একটা বিজ্ঞপ্তি। সৃষ্টিকর্তা বোধহয় প্রকৃতির মাধ্যমে নিজের শক্তি আর রূপের রহস্য জানান দিয়ে থাকে। যাইহোক, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড় কিছুটা থেমে গেলেও বৃষ্টি পড়ছে অঝোর ধারায়। 

সহকর্মী মোয়াজ্জেম নাইমুল রুবেল মিয়া গামছা পরে নিজেদের কুতকুতে নগ্ন শরীরে ব্যালকনির বেঞ্চিতে বসে গায়ে মাখাচ্ছে ঝরো হাওয়ার ঝাঁপটা। আর বৃষ্টির বড় বড় শূদ্র দানাগুলো ওদের মাথার চুল হতে পায়ের তালু পর্যন্ত ভিজিয়ে দিচ্ছে। ভেজা কাকের মতো ভিজে ওরা যখন আনন্দ-উল্লাসে মেতে চিৎকার করে উঠছে, তখন আমারও সাধ জাগল সবার সাথে অনাবিল আনন্দের মিছিলে যোগ দিতে। নিজের ব্যাগে গামছা খুঁজে না পাওয়ার কারণে আমার পাহাড়ি বৃষ্টিতে ভেজার অসীম ইচ্ছেটা অপূর্ণই থেকে গেল।

যেমন আকস্মিকভাবে বর্ষণধারা শুরু হয়েছিল তেমনি আকস্মিকভাবেই তা একসময় ক্ষান্ত হল। আবার মেঘমুক্ত আকাশে সূর্য হেসে উঠলো। আবহাওয়া পরিষ্কার হওয়া মাত্র বিকেলবেলা আমাদের রিসোর্টের প্রায় সবাই চলে গেছে প্রকৃতির রূপ সৌন্দর্য অবলোকন করতে। ঝড়-বৃষ্টি থেমে গেলেও আমার মেজাজের খিটখিটানি পুরো থেমে যায়নি। আমার মন বেশি খারাপ থাকলে নিজের ওপর খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারি না। বাহিরে যাওয়ার জন্য প্রথমে জিনস প্যান্টের সাথে মিলিয়ে টি—শার্ট পরলাম, ভালো লাগলো না তাই খুলে শার্ট পরলাম। তবুও যখন ভালো লাগছিল না তখন আমি প্যান্ট—শার্ট দুটোই খুলে ফেললাম। অবশেষে গেভারটিন প্যান্টের সাথে হলুদ পাঞ্জাবি আর তলায় চটি জুতো পরে ঘরের জানালাগুলো বন্ধ করে তুষার কান্তির সাথে রওনা হলাম স্টোন গার্ডেনের দিকে।

আমি যখন রক গার্ডেনে প্রবেশ করলাম। পড়ন্ত বিকেলে লালচে কুসুম সূর্যের আলো মাথার ওপর ঝলমল করছে। বন্য পাখির দল এক পাহাড় হতে অন্য পাহাড়ের বাঁকে উড়ে যাচ্ছে। প্রবেশ করে প্রথমেই পশ্চিমের দিগন্তের শূন্য পানে তাকিয়ে দেখতে পেলাম বিশাল এক কালো পাথর খণ্ড, যা সহস্র বছর ধরে হয়ত কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাথরের পর নিচের খাদের শূন্যতার ওপর আর নীল আকাশের নীচে ভাসমান সাদা মেঘের সমুদ্র জেগে উঠেছে। মেঘের তরঙ্গমালা কিছুক্ষণ পর পর তার আকার পরিবর্তন করে একেক রূপ ধারণ করে যেন ভ্রমণপিপাসুদের সাথে লুকোচুরি আর এক আশ্চর্য লীলায় মত্ত হয়ে ভাসছে। আমরা যেন মেঘের ওপর কোনও স্বপ্নপুরিতে চলে এসেছি। উপর থেকে নিচের পাহাড়ের পাদদেশের চারদিকে চোখ পড়ছে শুধু সবুজ আর সবুজের সমারোহ।

পড়ুন: রাঙ্গামাটির দূর পাহাড় সাজেকের বাঁকে (দ্বিতীয় পর্ব)

তারপর, আমি সামনে এগিয়ে এসে স্থির হয়ে মাঠের মাঝে কিছুক্ষণের জন্য চুপচাপ দাঁড়ালাম পড়ন্ত বিকালের প্রকৃতি আর ভ্রমণকারীদের কলরবে মুখরিত পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করার জন্য। কেউ মাঠের ঘাসের ওপর বসে নিজ পরিবার আর বাচ্চা নিয়ে আড্ডায় মশগুল। ভ্রমণপিপাসী পর্যটকের ছোট ছোট দলগুলোর কেউ রক গার্ডেনে বিশাল পাথর খণ্ডে দাঁড়িয়ে বসে এককভাবে আবার কেউবা যৌথভাবে ছবি তোলায় ব্যস্ত। 

  সাজেক ভ্রমণে আমাদের মধ্যে সব কনিষ্ঠ দল যারা বিচ্ছু বাহিনী হিসেবে পরিচিত পেয়েছে

মাঠের উত্তর কোণে চোখ পড়তেই প্রাণবন্ত যুবক—যুবতীর দলকে দেখা গেল। ওরা বিভিন্ন রং-ঢঙে গ্রুপ করে ক্যামেরাবন্দী হওয়া, খোশগল্প আর মাস্তিতে মশগুল রক গার্ডেনের আঙিনায়। তরুণ—তরুণীরা নিজের দেহ—সৌষ্ঠব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার জন্য নতুন পোশাকের বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে এসেছে। এদের মধ্যে কয়েকজন সুন্দরী মেয়ে রেশমী কালো চুলের গোছা পিঠ পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়ে স্কিন টাইট জিনসের সাথে কেউ জামা, কেউবা শাড়ি পরে ছবি তোলায় ব্যস্ত। মনে হচ্ছে ফ্যাশন ডিজাইনের পাতা থেকে বুঝি ওরা এখনই নেমে এসেছে পাহাড়ের বাঁকে। মেয়েগুলোর রূপ ও চলাফেরার ঢং যে কোনো অবিবাহিত পুরুষের পৌরুষকে প্রথম দর্শনেই নাড়া দেওয়ার মতো আকর্ষণীয়। আমিও অজানা কারণে আর একটু কাছে গিয়ে দেখছি, মেয়েগুলোর পাশে থাকা অবিবাহিত ছেলেদের দিকে তাকিয়ে খুশী, যেন ওদের সর্বাঙ্গে চাঁদের আলোর মতো টলমল করে উপচে পড়ছে। নিজ চোখে যখন দেখছি তরুণ-তরুণীদের বাঁধভাঙা আনন্দ আর হই-হট্টগোলের স্রোতধারা। সত্যিই তো ক্ষণিকের জন্য হলেও এমন প্রাকৃতিক পরিবেশে আর ভরা যৌবনে যদি পাশে সুন্দরী যুবতী থাকে কার না ভালে লাগে! এদের বড় একটি অংশ আমাদের সাথে ভ্রমণের সব কনিষ্ঠ তরুণ—তরুণীর দল। একজন মজার ছলে বলল, ‘আমাদের এই বিচ্ছু বাহিনীর দল সাজেক ভ্রমণে সবচেয়ে বেশি আনন্দ করছে। ওদের দেখে আমার নিজের মনেও সাধ জাগ্রত হচ্ছে পেছনের জীবনে পশ্চাৎপদ করতে’। সত্যিই, কুঁড়িতে পা দেওয়ার পর যে তারুণ্য ভর করে জীবনে, ত্রিশের পরে তা যেন অনেকটাই ফিকে হয়ে আসে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব বেড়ে গিয়ে ধূসর হতে থাকে নিজের রঙিন শখ—আহ্লাদগুলো। আর মন ও শরীরে ধীরে ধীরে বার্ধক্য বাসা বাঁধতে শুরু করে। চলবে...