ভ্রমণ

দোগারি পর্বতে বাংলাদেশের প্রথম অভিযান

রাতে মিল্লাত ভাই অসমিতাকে বললেন, ‘অসমিতা তুমি পেঁয়াজ মরিচ আর সালাদ কেটে দিয়ে চলে যাও। আজ আমরা খিচুরি রান্না করে খাব। অনেকদিন শাকিল হিমালয়ে কি খেয়েছে, না খেয়েছে কে জানে! আজ একটু নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াই। কি বলো শাকিল?’ 

আমি সায় দিয়ে বললাম, ‘ভাই সে তো আমার জন্য ভীষণ আনন্দের বিষয়। ট্রেইলে যা খেয়েছি সেগুলো এখন আর মনে করতে চাই না। শুধু বেঁচে থাকার জন্য তখন খেতে হয়েছে। আজ অনেক দিন পরে আপনার হাতের রান্না করা খিচুরি হলে তো আমার জন্য অমৃত হবে।’

ভাই খিচুরি রান্না করলেন, আমি তাকে জিনিসপত্র এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করলাম। রাতে খেতে খেতে অনেক গল্প হলো আমাদের। তিনি বললেন, ‘শাকিল ১৯ সেপ্টেম্বর সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলা আছে দশরথ স্টেডিয়ামে। বাংলাদেশ আর নেপাল এবার ফাইনালে উঠেছে। খেলা দেখবে না? আমি দারুণ উৎসাহ নিয়ে বললাম, ‘অবশ্যই দেখবো। এই ঐতিহাসিক খেলা তো দেখতেই হবে। আমার জন্য কিন্তু টিকেট রাইখেন।’ 

১৯ সেপ্টেম্বর বিকেল পাঁচটায় নেপালের রাজধানী কাঠমাণ্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে ষষ্ঠ সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলা। মিল্লাত ভাই অফিসে যাওয়র সময় বলে গেছেন তিনি আমাকে সাথে নিয়ে যাবেন। আমি অপেক্ষায় বসে আছি। কিন্তু মনটা অস্থির হয়ে আছে কখন স্টেডিয়ামে যাব সেজন্য। বিকেল তিনটার দিকে মিল্লাত ভাই অফিস থেকে বাসায় এলেন আমাকে নেওয়ার জন্য। তার গাড়িতেই আমরা স্টেডিয়ামে চলে এলাম সোয়া চারটার মধ্যে। রাস্তায় এবং স্টেডিয়ামের চারপাশে হাজার হাজার মানুষ। সবাই এসেছে খেলা দেখতে। প্রায় সবার হাতেই নেপালের পতাকা এবং গায়ে নেপালের ফুটবল দলের জার্সি। গাড়ি থেকে নেমে দেখি স্টেডিয়ামের বাইরে ডেপুটি চীফ অফ মিশন ইশরাত জাহান ম্যাম, মাসুদ আলম স্যার, হুমায়ুন কবির স্যারসহ বাংলাদেশ অ্যাম্বাসির সব কর্মকর্তা পরিবারসহ এসেছেন। আয়োজক কমিটির এক কর্মকর্তা এসে আমাদের স্টেডিয়ামের ভিতরে গ্যালারিতে নিয়ে গেলেন। বাংলাদেশ টিমের জন্য যে ডগ-আউট ছিল আমাদেই ঠিক তার পেছনেই বসতে দিয়ে জানালেন গ্যালারির এই অংশটা বাংলাদেশ অ্যাম্বাসির কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দ। 

স্টেডিয়ামের চারপাশের গ্যালারি কানায় কানায় পরিপূর্ণ। কোথাও একটুও ফাঁকা নেই। গ্যালারি লালে লাল হয়ে আছে নেপালের জার্সি পড়া দর্শকে আর পতাকায়। আমরা হাতে গোনা কয়েকজন বাংলাদেশী দর্শক এসেছি সাবিনা, রূপনা, কৃষ্ণাদের হয়ে দেশের পতাকা হাতে। তারা মাঠে লড়বে দেশের জন্য, আমরাও গ্যালারিতে লড়বো বাংলাদেশ বাংলাদেশ চিৎকারে। দক্ষিণ এশিয়ার সেরা হতেই আজ মাঠে লড়বে বাংলার বাঘিনীরা। মাসুদ স্যারের হাতে একটা বড় লাল সবুজ পতাকা আর আমার হাতে একটি বড় পতাকা। আর পুরো গ্যালারিতে চোখে পড়লো মাত্র একটি বড় পতাকা। প্রায় সতের হাজার দর্শক মাঠে বসে খেলা দেখতে এসেছে। সেখানে শ’খানেকও আমরা নেই। তবু তাদের সাথে বাংলাদেশ বাংলাদেশ চিৎকার করছি। লাল সবুজের বাঘিনীদের উৎসাহ দিচ্ছি। 

মাঠে দুই দলের খেলোয়াড়রা ওয়ার্ম আপ করছে। ঠিক চারটা পঞ্চাশ মিনিটে জাতীয় সংগীত গাইতে দুই দলের খেলোয়াড়রা ও রেফারিরা লাইন করে দাঁড়িয়ে গেল। সাথে সাথে গ্যালারির সকল দর্শকও সিট থেকে উঠে দাঁড়ালো। প্রথমেই ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ উচ্চস্বরে বেজে উঠলো। সাথে সাথে আমরাও গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করলাম। কতোটা অহঙ্কার আর গর্ব হচ্ছিল ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। চোখের জল কোনোভাবেই আটকে রাখতে পারলাম না। জাতীয় সংগীত শেষে তাকিয়ে দেখি শুধু আমিই না, মিল্লাত ভাই, মাসুদ স্যারসহ অনেকেই চোখ মুছছেন। নেপালের জাতীয় সংগীত ‘সায়াউ থুঙ্গা ফুল কা হামি এউটাই মালা নেপালী, সর্বভুম ভাইয়ি ফাইলিকা মেছি মহাকালী’ শেষে খেলোয়াড়রা একে-অপরের সাথে হ্যান্ডসেক করে নিলো। পাঁচটায় খেলা শুরু হলো। 

খেলার শুরু থেকেই বাংলার মেয়েরা আক্রমণ করেই যাচ্ছে। খেলা দেখেই মনের ভেতরে একটা আনন্দ হতে লাগলো। আবার ভয়ও হচ্ছে এই বুঝি বাংলার জালে বল ঢুকে গেল। তবে মনে হচ্ছে আজ আমরাই জিতব। দর্শকদের চিৎকারে যেন পুরো স্টেডিয়াম কেঁপে উঠছে। শামসুন্নাহারের পা থেকে যখন প্রথম গোলটা হলো তখন আমাদের আনন্দ পুরো গ্যালারিকে নীরব করে দিলো। পরে কৃষ্ণা রানী সরকার দ্বিতীয় গোলটি করে ২-০ গোলে বাংলাদেশকে এগিয়ে রাখে। নেপালের অনিতা বাসনেত একটি গোল করে ব্যবধান কমান। পরে কৃষ্ণা রানী সরকার তার দ্বিতীয় গোল করেন। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের শিরোপা জিতল বাংলাদেশের মেয়েরা। স্টেডিয়ামে রঙিন বাতি আর আতশবাজির রঙিন আলো রাঙিয়ে দিলো। আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। মেয়েরা আনন্দে মাঠের ভিতরে দৌড়াচ্ছে। বাংলাদেশ দলের ডিফেন্ডার আঁখি খাতুন মাঠ থেকে দৌড়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো পতাকা নেওয়ার জন্য। মাসুদ স্যার তার পতাকাটি তাকে দিয়ে দিলেন। আঁখি পতাকাটি নিয়ে মাঠে গিয়ে সবাইকে নিয়ে বিজয় উদযাপন করছে। 

পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের সময় আমরা গ্যালারি থেকে নেমে মাঠে এলাম। রাষ্ট্রদূত সালাউদ্দিন নোমান চৌধুরী স্যার উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠান শেষে সবাই যখন মাঠ থেকে বের হচ্ছি তখন সালাউদ্দিন স্যার আমাকে দেখে কাঁধে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আরে শাকিল, আপনি এখানে? অভিযান শেষ করে কবে ফিরলেন? আমি বললাম, ‘স্যার, পরশু ফিরেছি। অভিযান এখনো শেষ হয়নি। একটা পর্বতশিখর অভিযানের জন্য এসেছি, শেষ করেই আবার অভিযানে চলে যাবো।’ তিনি আবার বললেন, আগামীকাল সন্ধ্যায় আমার বাসায় বিজয়ী মেয়েদের নিয়ে ডিনার পার্টি করবো। আপনি অবশ্যই আসবেন।’ 

ষষ্ঠ সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের সেরা খেলোয়াড় এবং সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার জিতেছেন বাংলাদেশের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন, পাঁচ ম্যাচে আট গোল করে বাংলাদেশ দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। বাংলাদেশের গোলরক্ষক রূপনা চাকমা টুর্নামেন্টের সেরা গোলরক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন। দক্ষিণ এশীয় নারী ফুটবল অঙ্গনে সর্বাত্মক জয়ের রেকর্ড নিয়ে, নতুন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ। সাফ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপে, বাংলাদেশের কাছে নেপালের এটি প্রথম পরাজয়। ষষ্ঠ সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ ফাইনালসহ পাঁচটি ম্যাচ জিতেছে এবং মাত্র একটি ম্যাচে হেরেছে। ছয় ম্যাচ মিলে বাংলাদেশ মোট ২৩টি গোল করেছে। রাষ্ট্রদূত সালাউদ্দিন নোমান চৌধুরী স্যার নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েদেরকে টিম বাসে তুলে দিলেন। আমরা সবাই বাসের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। টিম বাস বেরিয়ে যাওয়ার পরে মিল্লাত ভাইর গাড়িতে করে বাসায় ফিরে এলাম। 

আজ বিশ তারিখ। সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। সারাদিন বৃষ্টির কারণে কোথাও বেরুনো হলো না। বিকেলে মিল্লাত ভাই বললেন, ‘শাকিল রেডি হও চারটে নাগাদ স্যারের বাসার প্রোগ্রামে যাবো।’ আমি ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে আমার তো কোনো ফর্মাল শার্ট-প্যান্ট নাই, জিন্স প্যান্ট আর টি-শার্ট পড়ে যেতে পারবো তো?’ তিনি বললেন, ‘যেতে পারো অসুবিধা নেই। তবে ফর্মাল হলে বেশি ভালো হতো। আমার রুমে আসো দেখি, আমার প্যান্ট শার্ট তোমার গায়ে লাগে কিনা।’

মিল্লাত ভাই ওয়ারড্রব থেকে একটা শার্ট ও একটা প্যান্ট বের করে দিলেন পড়ে দেখার জন্য। কী দারুণ বিষয়, একদম পারফেক্ট বলতে যা বুঝায় ঠিক তাই! একটা ব্লেজার বের করে দিয়ে পরে দেখতে বললেন। এটাও দারুণ গায়ে লেগে গেল। আমার তো ট্রেকিং বুট ছাড়া আর কোনো জুতা নেই এখানে। ফর্মাল প্যান্ট, শার্ট, ব্লেজার ও টাইয়ের সাথে তো ট্রেকিং বুট মানানসই হবে না। এখন উপায়? ভাই বললেন, ‘এগুলো যেহেতু ফিট হয়েছে আশাকরি জুতাও হবে। চলো নিচে, এটাও পরীক্ষা হয়ে যাক।’ প্যান্ট, শার্ট, ব্লেজার ও টাই পরেই নিচ তলায় এলাম জুতা পায়ে লাগে কিনা দেখতে। চকলেট কালারের এক জোড়া জুতা বের করে দিলেন। কপাল কী ভালো! জুতাও ফিট। আমাকে সাহেববাবু বানিয়ে ভাই বললেন, ‘তোমাকে তো চেনাই যাচ্ছে না। দারুণ মানিয়েছে। সোজা হয়ে দাঁড়াও দেখি, একটা ছবি তুলি।’ 

আমি এর আগে কখনো এই ধরনের পোশাক পড়িনি। তাই নিজের কাছেই অস্বস্তি লাগছে, লজ্জা করছে। কে জানে কেমন দেখা যাচ্ছে! ভাই যেহেতু বলেছে দেখতে ভালো লাগছে তাহলে নিশ্চই ভালোই লাগছে হয়তো। এগুলো পড়েই যাবো আজ। সাড়ে চারটার দিকে আমরা বাসা থেকে বের হলাম। বাংলাদেশ হাউজ বা অ্যাম্বাসেডর হাউজ কাছেই। তাই হেঁটেই রওনা হলাম। সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে। এখন বৃষ্টি নেই তবে রাস্তা ভিজে আছে। মেঘ করে আছে। যে কোনো মুহূর্তে আবার বৃষ্টি শুরু হতে পারে। 

পড়ুন প্রথম পর্ব : দোগারি পর্বতে বাংলাদেশের প্রথম অভিযান