চারপাশে পর্বতে ঘেরা ভ্যালিতে সমতল মাঠে আমাদের ক্যাম্প করা হয়েছে। ক্যাম্পের পাশ দিয়েই বরফ জমা নদী গেছে। সরু ড্রেইনের মতো বরফের মধ্যে দিয়েই কলকল শব্দে পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছে। এতোই বরফ পড়েছে যে প্রায় চার-পাঁচ ফুট স্তর হয়ে আছে। সন্ধ্যার আগে আমরা তাবু থেকে বেরিয়ে কিছু সময় হাঁটাহাঁটি করলাম। কিন্তু বেশি সময় আর বাইরে থাকা গেল না। তুষারপাত শুরু হয়ে গেছে। আমরা কিচেন তাবুতে চলে এলাম। রাতের খাবারও তৈরি হয়ে গেছে। ডাল ভাত সবজি ও পাপড় দিয়ে রাতের খাবার খেলাম। খাবার শেষে সবাই একসঙ্গে বসে অভিযানের পরবর্তী পরিকল্পনা করে নিলাম।
আগামীকালের জন্য পরিকল্পনা হলো ক্যাম্প এখানেই থাকবে। দুইটা দলে ভাগ হয়ে দোগার পর্বতের রাস্তা খুঁজে বের করে সেই রাস্তা ওপেন করা। তারপর আবহাওয়ার অবস্থা দেখে পরশু দিন বেসক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া এবং বেসক্যাম্প স্থাপন করা। বাইরে প্রচণ্ড তুষারপাত হচ্ছে। পরিকল্পনা শেষ করে সবাই নিজ নিজ তাবুতে চলে এলাম। তাবুতে আসতে আসতে বুঝতে পারলাম কি পরিমাণ তুষারপাত হচ্ছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে প্রায় এক দেড় ফুট তুষার জমে গেছে। তাবুর উপরে তুষারে ঢেকে গেছে। তাবু ঝাঁকিয়ে সেই তুষার ফেলতে হলো। বেশি তুষার তাবুর উপরে জমলে তাবু ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই যখন তুষারপাত হয় তখন কিছু সময় পরপর তাবুর উপরে জমে থাকা তুষার ফেলে দিতে হয়।
আজ আর দাঁত ব্রাশ করা হলো না। তাবুর ভিতরে ঢুকেই স্লিপিং ব্যাগের ভিতরে শুয়ে পড়লাম। তাবুর উপরে তুষার পড়ার শব্দ হচ্ছে। বাতাসও আছে। যদি সারারাত এভাবে তুষারপাত হয় তাহলে আমরা তাবুসহ তুষারে চাপা পড়ে যাব। ভুলে গিয়েছিলাম আজ ডায়েরি লেখা হয়নি। আমি অভিযানের সময় প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা ডায়েরিতে লিখে রাখি। স্লিপিং ব্যাগ থেকে বেরিয়ে রুকস্যাক থেকে ডায়েরি আর কলম বের করে হেডটর্চের আলোতে আজকের অভিজ্ঞতা লিখে ফেললাম। এখন যদি না লিখে রাখতাম তাহলে অনেক কথা ভুলে যেতাম। লেখা শেষ করে আবার শুয়ে পড়লাম। আজ বরফের উপরে শুয়ে আছি। উপরেও বরফ পড়ছে। রাত যত গভীর হচ্ছে তাপমাত্রা নেমে যাচ্ছে। সন্ধ্যার পরপর কিলুর হাত ঘড়িতে দেখেছিলাম মাইনাস পনেরো। এখন হয়তো মাইনাস বিশের কাছাকাছি হবে।
রাতে বেশ কয়েকবার ঘুম ভেঙেছে। এই উচ্চতায় খুব বেশি ভালো ঘুম হয় না। এটা অস্বাভাবিক না। রাত তিনটার দিকে তাবুর জিপার খুলে বাইরে দেখলাম। না, এখন আর তুষারপাত হচ্ছে না। আকাশও পরিষ্কার। তবে বাতাস আছে কিছুটা। প্রস্রাব করতে তাবু থেকে বেরিয়ে এলাম। তাবু থেকে বের হতে একটু কষ্টই হলো। এর কারণ বাইরে জমে থাকা বরফ। চারপাশে তাকিয়ে দেখি বরফ ছাড়া আর কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। কিচেন তাবুর উপরে বরফে সাদা হয়ে আছে। আমাদের চারটি তাবু তেমনভাবে বোঝা যাচ্ছে না। পুরো তাবু বরফে ঢেকে আছে। আবার তাবুর বেশির ভাগ অংশই বরফের নিচে। এখন আর ইচ্ছে করল না তাবুর উপর থেকে বরফ সরাতে। তাই আবার তাবুর ভিতরে ঢুকে শুয়ে পড়লাম।
ঘুম ভেঙেছে ভোর রাতেই। স্লিপিং ব্যাগের ভিতরে শুয়েই সানভি ভাই আর আমি গল্প করছি। কিচেন স্টাফের একজন এসে তাবুর বাইরে থেকে ডাকছে। তাবুর জিপার খুলে দেখি চায়ের কেটলি আর মগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার মগ আর সানভি ভাইয়ের মগে চা রেখে দিলাম। মুহিত ভাই আর বিপ্লব ভাই আমাদের পাশের তাবুতে। তাদের সাথে কথা হচ্ছে তাবুর ভিতর থেকেই। তাবুর ভিতরে বসেই চা খেলাম। চা শেষ করে তাবু থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। পুতা হিমচুলী পর্বত চূড়ার আড়াল থেকে ধীরে ধীরে সূর্য উঠে এলো। সূর্যের আলোয় চারপাশের বরফ চিক্চিক্ করছে। খালি চোখে তাকানো যাচ্ছে না। তাই সবাই সানগ্লাস পড়েই বাইরে বেরিয়েছি। সূর্যের তাপে তাপমাত্রা এখন অনেকটা বেড়েছে। ক্যাম্প সাইট থেকে কিছুটা দূরে একটা বড় পাথরের বোল্ডার। সেই পাথরের আড়ালে চলে এলাম প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে।
এই খোলা জায়গাটাই আমরা টয়লেট হিসেবে ব্যবহার করছি। এখানে আসার সময় বরফের উপরে কিছু একটা হেঁটে যাওয়ার পায়ের চিহ্ন দেখতে পেলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো বড় আকারের ইঁদুরের পায়ের ছাপ হবে। তবে ইঁদুরের পায়ের ছাপ যে এতো বড় হবে না বুঝতে বেশি সময় লাগলো না। তাহলে কি হতে পারে? এই বরফের ভূমিতে কোন প্রাণী থাকতে পারে? মাথার ভিতরে ঘুরতে লাগলো। ক্যাম্পে এসে তামটিয় শেরপাকে জিজ্ঞেস করলাম। সকালে যারাই পাথরের ঐ পাশে গিয়েছে তারা সবাই খেয়াল করেছে পায়ের ছাপ। তামটিং জানালো এটা তুষার চিতা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ এই উচ্চতায় সাধারণত এতো বড় পায়ের ছাপ স্নো লেপার্ড ছাড়া অন্য কিছুর হওয়ার কথা না।
সকালের নাস্তা শেষ করে প্রস্তুতি নেওয়া হলো বেসক্যাম্পের পথ খুঁজতে যাওয়ার। তিনটা দলে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। নিমা, কিলু আর তামটিং চলে গেল পূর্ব দিকে সোজা পুতা হিমচুলী বরাবর। তারা চেষ্টা করছে হিমচুলীর পাশ দিয়ে কোনো রাস্তা তৈরি করা যায় কি না। যদি করা যায় তাহলে সেই পথ হবে টেকনিক্যাল। তাই তারা সাথে করে পর্যাপ্ত পরিমাণে দড়ি এবং স্নো বার নিয়ে গেছে। রাস্তা যদি তৈরি করা সম্ভব হয় তাহলে দড়ি লাগিয়ে আসবে। আংডু আর ভক্তপুন চলে গেল সোজা দক্ষিণে নদী পাড় হয়ে পাহাড়ের শরীর বরাবর।
আর মুহিত ভাই, বিপ্লব ভাই, সানভি ভাই আর আমি দুই দলের মাঝ বরাবর নদীর পাড় ধরে এগুতে লাগলাম। এতো বেশি তুষার পড়েছে যে হাঁটুর উপর অব্দি পর্যন্ত বরফে ঢুকে যাচ্ছে। যে কারণে সামনে এগিয়ে যেতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তাই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি। এমন বরফে ঢাকা জায়গা দিয়ে এগিয়ে যাওয়া ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। কোথায় কোথায় বরফের ফাটল আছে বোঝার সুযোগ নেই। যে কোনো মুহূর্তে বরফের ফাটলে ঢুকে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। আর ফাটলে একবার ঢুকে গেলেই শেষ! আর বেঁচে ফেরার সুযোগ নেই। অন্য দিকে পর্বতের শরীর ঘেঁষে যাওয়া বা উপরের দিকে ওঠাও ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ বরফের পরিমাণ বেশি থাকলে তুষার ধ্বস হওয়ার আশঙ্কাও বেশি। কখন যে বিকট শব্দে তুষার ধ্বস এসে তুলার মতো উড়িয়ে নিয়ে বরফ চাপা দিয়ে দেবে বুঝে ওঠার সুযোগ থাকবে না। তবু আমরা সেই ঝুঁকি নিয়েই রাস্তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।
পড়ুন ১২তম পর্ব : দোগারি পর্বতে বাংলাদেশের প্রথম অভিযান