হঠাৎ গেট ম্যান, কেয়ার টেকারের মধ্যে চাঞ্চল্য লক্ষ করা গেলো। রেস্ট হাউজে আগে-পিছে পাইলট কার নিয়ে একটি বুলেট প্রুফ জীপ ঢুকল। জীপ থেকে ২৮-৩০ বছরের এক যুবক নেমে গটগট করে সংরক্ষিত ঘরে ঢুকে গেলেন। ঢোকার আগে আমাদের এক পলক দেখেও নিলেন।
কেয়ার টেকার জানায় বড় বনকর্তা। সুঠাম দেহ। উচ্চতা প্রায় ৬ ফুট। গায়ের রঙ ফর্সা। ব্যাক ব্রাশ করা সুন্দর চুল।আটপৌরে পোশাকেই জীপ থেকে নামলেন। ভদ্রলোক ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে আমাদের কাছে বসে বলেন, ‘আমি বিষ্ণু কশ্যপ, উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের বন বিভগের অধিকর্তা। বাড়ি কর্ণাটক রাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রামে। ফাদার-মাদার বোথ কলেজ টিচার্স। রিসেন্টলি ম্যারেড।’
আমি আমার পরিচয় দিয়ে, ছেলেদের নাম, শিক্ষা ইত্যাদি তাঁকে জানালাম। সমস্যা হলো তিনি বাংলা এক-আধটু বোঝেন, বলতে পারেন না। হিন্দি, ইংরেজিতে চোস্ত। আমি হিন্দি সামান্য বুঝি। ছেলেরা ও হরিহর বাবুরা হিন্দি বোঝেন, বলতেও পারেন। আমি বিষ্ণুর সঙ্গে ইংরেজিতেই বলছিলাম। বললাম, ‘আপনি রিসেন্টলি ম্যারেড বলছেন, বৌমা কোথায়?’
বিষ্ণু বলেন, ‘কাকাবাবু, আপনাদের বৌমার সঙ্গে বাসর রাত যাপন করার সুযোগ পাইনি। নির্মলাকে নিয়ে ঘরে ঢোকার পর পরই টেলিগ্রাম। পোচার ও কাঠদস্যুরা কাজি রাঙা অভয়ারণ্যে আগুন ধরিয়ে তুলকালাম কাণ্ড করছে। আর্মি হেলিকপ্টার নিয়ে আমি সঙ্গে সঙ্গে রওনা দেই। আগুন নিভিয়ে, তিন পোচার ও চার কাঠদস্যু অ্যারেস্ট করে দুদিনের লড়াই শেষে ফিরলাম।’
হিমালয়ের ভাল্লুক
জিজ্ঞেস করলাম ‘আপনি কি আই.এফ. এস (ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিস)?’ ‘ইয়েস। ইট ইস ইকুইভেলেন্ট টু আই.এ.এস (ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস) অর আই.পি.এস (ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস)। ছোটকাল থেকে আমার অরণ্যের নেশা। আমি যে কোনো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারতাম। কিন্তু আমার ফার্স্ট ও একমাত্র পছন্দ বনরক্ষক হওয়া। সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে ফেলে আমার চলে আসায় আমার বাবা-মার সমর্থন আছে। আপনাদের বৌমাও আমার কর্তব্যবোধ বিষয়ে সচেতন।’
আমি বলি, ‘বিষ্ণু, আপনি সাধনায় জয়যুক্ত হবেন। আমি প্রাণভরে আপনাকে আশিষ জানাই।’ বিষ্ণু টুক করে আমায় প্রণাম করে হরিহর বাবুসহ সকলের সঙ্গে হাত মেলালেন। কেয়ার টেকারকে ডেকে সকলের জন্য কফি ও বিস্কুটের ব্যবস্থা করতে বললেন। এরপর তিনি ভাইদের সঙ্গে তাস খেলতে বসে গেলেন।
কথাপ্রসঙ্গে বিষ্ণু জোঁক ও হিমালয়ের ভল্লুকের উল্লেখ করেন। বর্ষার পর জোঁক থাকে না। এখনো বর্ষার আমেজ রয়েছে। জোঁক লাফিয়ে গায়ে ওঠে। টের পাওয়া যায় না। রক্ত পান করে টইটুম্বুর হলে ধরা পড়ে। লোলেগাঁর সানভিউ পয়েন্ট বিখ্যাত। মেঘ কুয়াশা না থাকলে চমৎকার সূর্যোদয় ও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। সান ভিউ পয়েন্ট রেস্ট হাউজ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। ভোরে দলবেঁধে যাওয়া ভালো। কদাচিৎ হিমালয়ান বিয়ারের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। দলবলে থাকলে আক্রমণ করতে সাহস পাবে না। বিষ্ণুর মন্তব্য, ডিউটি সেরে তিনি প্রায়ই লোলেগাঁও চলে আসেন। এর চেয়ে শান্ত ও সুখের জায়গা ভারতে নেই।
কফি খেতে খেতে সন্ধ্যা নামে। পাহাড়ে সন্ধ্যা যেমন আগে আসে, তেমন ভোরও ফোটে সমতলের অনেক আগে। বিষ্ণু বলেন, কাকা বাবু কাছে একটু হেঁটে আসতে পারেন। দূরে নয়। চার ছেলে, বউ বেরিয়েছিল। আমি, মলিনা, যদুনাথ বাবু ও সরসী বারান্দায় বসে গল্প করছিলাম। শ্যামলিমা ধীরে ধীরে অন্ধকারে আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু বিনিময়ে অপূর্ব এক দৃশ্য প্রাণে আরাম সঞ্চার করে। বহু দূরের পুরো কালিম্পংজুড়ে টুকরো টুকরো আলোর রোশনাই। বিষ্ণু জানালেন, কাকা বাবু, আমি খেয়ে শোবো। ভোর চারটায় বেরোতে হবে। জলদাপাড়া অরণ্যে কয়েকটি ক্রিমিন্যাল ঢুকেছে খবর পেলাম। ভোরে না গেলে ধরতে পারবো না। আপনারা কাল সান ভিউটা দেখে নেবেন। রাতে দেখা হবে। আমরা গভীর গম্ভীর প্রকৃতির মধ্যে বসে আস্তে আস্তে গল্প করে ছেলেদের ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম। ভিতরে ভিতরে আমি বিস্মিতবোধ করেছিলাম যে, ধ্যানগম্ভীর মৌন প্রকৃতির অনুশাসনে সরসীর কাংস্যবিনিন্দিত কণ্ঠও আজ উচ্চকিত হয়নি।
চার ছেলে ও বউ ফিরে এসে পাহাড়ি জনজাতির বসতি ও দোকানপাট সম্পর্কে জানালো। দরিদ্র জনগোষ্ঠী। জনসংখ্যা ৫ হাজারের বেশি নয়। দূরে দূরে কয়েকটি বাড়ি। ওদের জীবন ও জীবিকা অরণ্য নির্ভর। এখনো লোলেগোয় দোকানপাট, হোটেল, গেস্ট হাউজ গড়ে ওঠেনি। দর্শনীয় স্থান বলতে সান ভিউ পয়েন্ট।
রাতে বেগুন ভাজা, ডাল ও মুরগি বা মোরগের মাংস দিয়ে পরিতৃপ্তির সঙ্গে ভোজন সারা হলো। এখানকার জলের গুণে সম্ভবত রান্নার স্বাদ ভিন্ন হয়। অবশ্য পাচকের রান্নাকে সাধুবাদ না জানানো অন্যায় হবে। খেতে বসে ঠিক হয় ভোর পাঁচটায় সানভিউ পয়েন্টে যাবো। কাজেই চারটায় ওঠে প্রাতকৃত্য সারতে হবে। টয়লেট দুটো। সকলকে সময়ক্ষেপণ সম্পর্কে খেয়াল রাখতে বলা হলো।
সান ভিউ পয়েন্ট, লোলেগাঁও
ভোর চারটায় বিষ্ণু বেরিয়ে গেছেন। আমরা তখন উঠেছি। বাইরে আঁধার ফিকে হয়ে আসছে। সকলে রেডি হয়ে পাঁচটা বাজার আগেই বেরিয়ে পড়ি। যদুনাথ বাবুর স্বগতোক্তি “একটু চা হলে জমতো ভালো।” সরসী বা মলিনা করতে পারতো কিন্তু সময়মতো বেরনো যেতো না।
হালকা ঠাণ্ডা। পাতলা সোয়েটার। গস্তব্যস্থল উপরের দিকে। ইট পাতানো রাস্তায় আধ-ভেজা ঝরা পাতার পুরু স্তর। চলার পথের বাঁয়ে লাল মাটির কাটা পাহাড় এবং ডানে বিশাল পাইনসহ অন্যান্য বৃক্ষের অরণ্য ও গভীর খাদ। হাঁটতে হাঁটতে ঘেমে উঠি। সোয়েটার খুলে কাঁধে নেই। স্বাগত, সুব্রত, সম্রাটের হাতে লাঠি। ওরা সামনে। মিলি ও সুব্রতের ভাই শীলব্রত আমাদের গা ঘেঁষে হাঁটছে। ওদের মনে ভাল্লুকের ভয়। পেছনে কটি ছেলে ভালুক ভালুক চীৎকার দিয়ে দৌড়ে আসছিলো। মিলি আমাকে ও শীলব্রত তার মাকে এমন জোরে জড়িয়ে ধরেছে যে আমাদের হাঁটা বন্ধ। আমরা ছাড়া অন্যরা এগিয়ে গেছে। আমাদের গাইডরা খবর পেয়ে পিছিয়ে আসে। ভয় দেখানোর জন্য ছেলেগুলোকে ধমক দেয়। এরপর আমরা ধীরে ধীরে সানভিউ পয়েন্টে পোঁছাই।
কপাল মন্দ। কাঞ্চনজঙ্ঘা দূর অস্ত, সূর্য-ওঠাও দেখা হলো না। পাহাড় মেঘে মেঘে সয়লাব। আমরাও বিশ্বকবির দলে ভেবে কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত বোধ করে অবতরণ শুরু করি। লিডারদের বলি, চায়ের দোকান দেখতে। যদুনাথ বাবুর আর্জি বেশি। চায়ে চুমুক দিয়ে বিড়ি ফুঁকলে নিতম্বে সাড়া জাগে। ভোরে তার এই কর্ম করা হয়নি। লিডারেরা জানালো এক ঘণ্টা পরপর এখান থেকে একটি বাস লাভায় যায়। বাসে বিশ মিনিট পর একটা ভালো চায়ের দোকান আছে। যদুনাথ বাবুর জিজ্ঞাস্য ‘চা পানের পরের কর্ম কোথায় সারবো?’ নেতারা বলল ‘খোঁজ নিতে হবে।’ যদুনাথ বাবু চুপসে যান। আমি বলি, একটু দূরে পাইন গাছের নিচে একটি আটপৌরে দোকান দেখছি। চলুন।
আমরা দোকানের পাশের ও সামনের টুলে বসি। দোকানিকে চা-বিস্কুট দিতে বলি। খুব মানসম্পন্ন না হলেও এই চা বিদেশ বিভুঁইয়ে চলে। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পাই যে এখানে মাছ দুর্লভ। মাঝে মাঝে হরিণ ও শূকরের মাংস পাওয়া যায়। অবৈধ শিকারের মাংসের কথা বনদপ্তর জানতে পেলে জেল জরিমানা হয়ে থাকে। চা পান করে রেস্ট হাউজে ফিরি। কিন্তু যদুনাথ বাবু মিসিং। চা পেটে পড়ামাত্র তার নিম্ন নাভিদেশে ঝড় ওঠে। তিনি দৌড়ে কখন যে রেস্ট হাউজে ফিরেছেন তা তিনি নিজেও নাকি টের পাননি। ফিরেই কাজ সারেন। কাজ সারার পর দেখেন রেস্ট হাউজ ও টয়লেটের দরোজা হাট করে খোলা। আমরা তার অলিম্পিক দৌড় দেখতে পাইনি। তার অবস্থা দেখে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড়ের মলত্যাগের হাস্যরসের কৌতুক কাহিনি মনে পড়ে।
হাতে রক্ত পানরত জোঁক
রেস্ট হাউজে ফিরে পাউরুটি, মাখন, জেলি, কলা দিয়ে টিফিন করলাম। কেয়ার টেকার জানালেন যে এখানে খাঁটি সুস্বাদু মধু পাওয়া যায়। মূল্যও সমতলের তুলনায় অনেক কম। সরসীরা মধু চেখে বলেন বেশ ভালো। নেওয়া যায়। কিন্তু লিডারেরা বেঁকে বসেন। তাদের যুক্তি হলো আমাদের আরো অনেক দূরে যেতে হবে। লটবহর বাড়লে সমস্যা হবে। লিডারদের বক্তব্য যথার্থ। কিন্তু সহযাত্রীদের মুখ প্রসন্ন নয়। আমি লিডারদের কাছে আর্জি জানিয়ে বললাম , ‘হাফ কেজিতে কতো ভার হবে! আমরা পথে পথে রুটি, বিস্কুটের সঙ্গে খাবো। বাকিটা দুই পরিবার ভাগ করে নেব।’ লিডারেরা সম্মত হলে, মেঘ কাটে।
দুপুরে পটল ভাজা, চালকুমড়া-ডাল ও এঁচোড়ের চচ্চরি। কচি কাঁঠালের রান্না অনেক খেয়েছি। কিন্তু এই চচ্চরির অনন্য স্বাদ ভোলার নয়। পাহাড়ে খিদে বেশি পায়। খিদের সময় সব খাবারই যেন অমৃত। খেয়ে শুয়ে পড়ি। ছেলেরা বেড়িয়ে যায়। লোলেগাঁ জরিপেই তাদের আনন্দ। আমরা হবু বুড়োরা বিকালে জনপদের দিকে ঘুরতে বের হই। (চলবে)
পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব : লোলেগাঁও ও গ্যাংটক ভ্রমণের দিনরাত্রি