ভ্রমণ

লোলেগাঁও ও গ্যাংটক ভ্রমণের দিনরাত্রি 

গাড়ি যতোই উপরের দিকে উঠতে থাকে ততোই বুকে ধড়কান শুরু হচ্ছে। বাঁয়ে পাহাড় এবং কিছুদূর পরপর ছোট-বড় ঝরনার জল পথে এসে পড়ছে। কিন্তু ডানদিকে? গভীর খাদ। ড্রাইভার দুর্বল চিত্তের লোকদের ডানে না তাকানোর পরামর্শ দিলেন। বিশ্বকবি সম্ভবত এরকম পরিস্থিতিতে ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন...’ লিখে মনের ভয় কাটাতে চেয়েছিলেন।

আরো উপরে উঠলে ঠাণ্ডা হাওয়ায় শীত অনুভূত হলো। সাথে হালকা সোয়েটার ছিল। ডান দিকে গভীর খাদ হলেও প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য চোখকে সম্মোহিত করে। খাদে গরু বিচরণ করছে বোঝা যায়। কিন্তু মনে হয় বিন্দু নড়াচড়া করছে। যেখানে ঝরনার জল প্রবলভাবে রাস্তা পেরিয়ে খাদে নামছে সেখানে নেমে ঝরনার জলে হাত-মুখ ধুয়ে নিলাম। জল কিন্তু বেশ ঠান্ডা।

আরো উপরে ওঠার সময় মাঝে মাঝে হালকা মেঘ আমাদের ভিজিয়ে দিয়ে লুকোচুরি খেলছে। মিনিট পনেরো পর চেক পোস্টে সম্মতিপত্র দেখিয়ে ছুটতে থাকি। রোডের পাশে আটপৌরে চায়ের দোকান দেখে নামি। দোকানদার মহিলা। দোকানে পুষ্ট মোটা পাহাড়ি কলা। প্রত্যেকে দুটো করে উদরস্তু করে পেট ভরে জলপান করি। মহিলা পোরসিলিনের মগে চা দেন। চা তো নয় যেনো দুধের মালাই। চায়ের সুগন্ধও কিন্তু অটুট। চা যে কি পরিমাণ সুস্বাদু হতে পারে এই অভিজ্ঞতা নতুন।

 নাথু লা পাস

গ্যাংটক থেকে নাথু লা পাসের দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। পৌঁছাতে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগে। প্রায় দুটোর দিকে আমরা সাঙ্গু হ্রদে পৌঁছাই। এটি সিকিমের পূর্ব দিকে অবস্থিত। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৩৭৫৩ মিটার। এর চতুষ্পার্শ্বে পর্বত। শীতে সব বরফে ঢাকা থকে। ডিম্বাকৃতির হ্রদটি প্রায় ৬৫ একর জায়গার উপর অবস্থিত। দৈর্ঘ্যে ৮৩৬ মিটার ও প্রস্থে ৪২৭ মিটার। বেশ গভীর। সর্বেচ্চ গভীরতা ১৫ মিটার। গড় গভীরতা প্রায় ৫ মিটার। আমরা এর টলটলে জল দেখতে পাই। খুব ঠাণ্ডা জল। শীতকালে পুরো হ্রদ বরফে পরিণত হয়। তখন পর্যটকেরা এর উপর আইস স্কেটিং খেলতে পারেন। এই হ্রদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য প্রতি ঋতুতে জলের রং পরিবর্তিত হয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এর জলকে পবিত্র জ্ঞানে পূজা করেন।  

স্থানীয়রা জানালো নাথু লা পাসে যাওয়া এখন বন্ধ। রাস্তার কাজ হচ্ছে। হতাশ হলেও, আমরা নাথু লার পথ দেখে আসি। বাবা হরভজন মন্দির দর্শন করি। ওখানে ভুটানিদের পোশাক ভাড়া পাওয়া যায়। ছেলে বউ চমরী গাই ও গাধার পিঠে বসে ভুটানি পোশাকে ছবি তোলে। 

নাথু লা পাস বা রোড হিমালয়ের ডঙ্কিয়া পর্বত শ্রেণির উপর চীনের স্বশাসিত অঞ্চল তিব্বতের যডং কাউন্টি থেকে ভারতীয় সিকিম রাজ্য পর্যন্ত বিস্তৃত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৪,৩৪০ মিটার। এই উচ্চতায় অক্সিজেনের স্তর হালকা। অনেকের শ্বাসকষ্ট হয়। শীতকালসহ বছরের প্রায় অর্ধেক সময় পুরোটা বরফের গভীর আস্তরণের নিচে চলে যায়। তখন পর্যটকদের ভ্রমণ নিষিদ্ধ। পথটি প্রায় ৫৪ কিলোমিটার দীর্ঘ। চীন-ভারত যুদ্ধের পর চীন প্রায় ৫০ বছর এটি বন্ধ করে রাখে। ২০০৬ সালে খুলে দেয়। এখন এই পথ চীন ও ভারতের পণ্য লেন-দেনে ব্যবহৃত হচ্ছে।

ওয়াংচুক দোরজে

সাঙ্গু লেকের পাড়ে, হরভজন মন্দির ঘিরে মাঝারি মানের হোটেল আছে। দুপুরের খাওয়া ওখানেই সারি শাক-সবজি দিয়ে। খিদে পেটে মোটামুটি চলে। এখানে দাম তো একটু বেশি হবেই। আসমানের কাছাকাছি যাওয়ার মাশুল গুণতে তো হবেই। বিকেল চারটার দিকে আমাদের অধঃপতন শুরু হয়। জীবনে উঠতে কষ্ট, নামতে নয়। এখানেও অনেকটা তাই। তবে রথি একটু বেসামাল হলে ভবলীলা সাঙ্গ হতে এক মিনিটও লাগবে না। ফেরার পথে মহিলার হাতের অপূর্ব চা পানের বাসনা ছিল। দোকান বন্ধ। দূরে পায়ে হেঁটে বাড়ি যেতে সময় লাগে। তাই হয়তো চলে গেছেন। আমরা রাত আটটা নাগাদ গ্যাংটক পৌঁছি। 

পরদিন রুমটেক মনাস্ট্রি বা মঠ। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বিখ্যাত মন্দির। লিডারেরা রুমটেক গমনের বাহন ঠিক করতে বের হলো। প্রায় বাতিল আমরা চারজন রাস্তায় টহল দিয়ে চায়ের দোকানে ঢুকি। আমরা গ্যাংটকে সূর্য ওঠার আগে বিছানা ছেড়ে জানালায় চোখ রাখতাম। যদি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়! সর্বনাশা মেঘ আর কুয়াশা প্রত্যহ জল ঢালে আমাদের প্রত্যাশায়। লিডার জানিয়েছিল দশটায় রুমটেক রওনা হবো। গাড়িতে ৪৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা লাগবে।    

সকালে পেটভরে খেয়ে আমরা রুমটেক রওনা হই। রুমটেক মনাস্ট্রি বা মঠ ধর্মচক্র কেন্দ্র নামেও পরিচিত। ভারতের সিকিম রাজ্যের প্রধান শহর গ্যাংটক থেকে এর দূরত্ব প্রায় ২৮ কিলোমিটার। নবম কর্মপা ওয়াংচুক দোরজে ১৭৩৪ সালে সিকিমির রাজা চতুর্থ চোগাইয়াল গাইরুমেড নামগিয়ালের সহযোগিতায় গ্যাংটকের কাছে একটি বৌদ্ধ মঠ প্রতিষ্ঠা করেন।

 রুমটেক মঠের বহির্দৃশ্য

১৯৫৬ সালের দিকে মঠটি প্রায় ধ্বংস হয়ে পড়লে সম্মাননীয় ১৬তম করমপা সিকিম ভ্রমণে এলে মঠের সংস্কারের আবেদন জানানো হয়। তিনি জানান যে যথাসময়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিন বছর পর তিনি মিপাম চৌকি লোড্রোকে নিয়ে সিকিমে আসেন। এই সময় সম্মাননীয় ১৪তম কুনযিগ শামার রিনপোচে চীন থেকে পালিয়ে তিব্বতে আসেন। ভুটান সরকার তাঁকে স্বাগত জানায়। পরে সিকিম সরকার তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। 

সিকিমের মহারাজা স্যার তসি নামগাইয়াল ১৬তম করমপাকে রুমটেক মঠ তৈরির জন্য বহু জায়গা দেখানো হয়। তিনি রুমটেক পছন্দ করেন, কারণ রুমটেক পাহাড় অভিমুখী সাতটি নদী প্রবহমান ছিল এবং রুমটেকের সামনে পরপর সাতটি পাহাড় অবস্থিত। এর পেছনে একটি পাহাড়ের সম্মুখভাগ বরফাচ্ছাদিত এবং এর পাদদেশ নদী দ্বারা আবৃত। পাহাড়টিকে শঙ্খের মতো দেখায়। 

পর্বত শিখরে গভীর অরণ্য সাফ করে একটি প্রাসাদ গড়ে তোলা প্রায় অসাধ্য কাজ। এর জন্য সহযোগিতা ও আত্মনিবেদনের আবশ্যকতা ছিল।  সিকিমের মহারাজা মঠের জন্য ৭৪ একর জমি দান করেছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু শ্রমিকদের জন্য বিনামূল্যে খাদ্য ও বসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সিকিমের সরকার রোড, ইলেক্ট্রিসিটি, জল ও অন্যান্য আবশ্যকীয় জিনিস ক্রয়ের জন্য অনুদান দিয়েছিলেন। ভারত সরকার ধ্যান কক্ষ নির্মাণ, আর শ্রমিকদের আবাসন ও চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ার জন্য অর্থ সাহায্য করেছিলেন। আবেদন না করা সত্বেও রাজ্যবাসী অকাতরে দান করেছিলেন।

মঠের কাজ সম্পন্ন করতে চার বছর সময় লেগেছিল। ঐতিহ্যবাহী তিব্বতীয় স্টাইলে মঠ নির্মিত হয়। এতে তিব্বত থেকে মূল্যবান পৌরাণিক নিদর্শন, পুঁথি ও মূর্তি সরিয়ে আনা হয়েছিল। ভগবান বুদ্ধ প্রদত্ত বাণীর ১০৮ সংকলন গ্রন্থও এই মঠে নিয়ে আসা হয়। ১৬তম করমপা ১৯৬৬ সাল থেকে এখানে বসবাস শুরু করেন।        

রুমটেকের ভিতরের দৃশ্য

সিকিমের অন্যান্য মঠে আমরা যাইনি। লোকমুখে জানলাম রুমটেক মঠ সকলের সেরা। সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে খুবই সমৃদ্ধ এবং সৌন্দর্যেও অতুলনীয়। অধ্যাত্ম সাধনার জন্য এখানে বহু ভিক্ষুর আগমন ঘটে। ১৬তম কারামাপার উদ্দেশ্য ছিল এখান থেকে সারা বিশ্বে বৌদ্ধ দর্শন প্রচারিত হবে। ৪৫২৪ মিটার অবিশ্বাস্য উচ্চতায় অবস্থিত মঠের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সুন্দর শহরবাসীর অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। মঠ থেকে শহর ও প্রকৃতির অপরূপ মেলবন্ধনের দৃশ্য মন বিমোহিত করে। এখানে প্রচুর পর্যটক ও আত্মানুসন্ধানীরা আসেন। এখানে এলে মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। মন ও আত্মা যেনো সতেজ হয়। শীতকালে সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা, গ্রীষ্মে বিকাল চারটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত খোলা থাকে। বর্তমানে গ্যাংটক থেকে কেবল বাসে গ্যাংটক থেকে রুমটেক আসা যাওয়ার ব্যবস্থা আছে।

রুমটেক থেকে ফিরে বিকেলে পাহাড়িদের হাতে বানানো টুকটাক জিনিসপাতি কেনা হলো। পরদিন দশটার দিকে আমরা পশ্চিমবঙ্গের উদ্দেশ্যে রওনা দেবো। আফসোস, স্বর্ণশিখরের দেখা পেলাম না। পরদিন সকালেও অবস্থার হেরফের নেই। রেডি হয়ে বের হওয়ার আগে জানালায় চোখ পড়তে দেখি মেঘের ফাঁকে ফাঁকে স্বর্ণালি আভার লুকোচুরি। মিনিট পনেরো পর স্পষ্ট দেখতে পাই। একবারে সকালে তো দেখিনি। তখন হয়তো আরো উজ্জ্বল ছিল। বিশ্বকবির জন্য কষ্ট হলো। স্বর্ণশিখরকে কুর্ণিশ জানিয়ে আমরা জলপাইগুড়ির দিকে রওনা দিলাম। (শেষ) 

পঞ্চম পর্ব : লোলেগাঁও ও গ্যাংটক ভ্রমণের দিনরাত্রি