ভ্রমণ

নয়াদিল্লি: কিছুটা কাছের হলো

ছোটবেলা দুটো বাক্য শুনতাম—‘দিল্লি বহু দূর’ এবং ‘দিল্লিকা লাড্ডু: খাইলেও পস্তাবেন, না খাইলেও পস্তাবেন’। সেই দূরের দিল্লিতে যেতে আমার বহু সময় অপেক্ষা করতে হলো। ভারতের কলকাতা, বোলপুর, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, মেঘালয়, গোয়াহাটি, আগরতলা, ইম্ফল, কোচবিহার, জয়গাওসহ বেশ কিছু জায়গায় ভ্রমণ করেছি ১৯৯২ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত। কিন্তু দিল্লি যাওয়া হয়নি, অবশেষে যাবার সময় এলো ২ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে। বাংলাদেশের অধিকাংশ লেখক জানেন, সার্ক সাহিত্য সম্মেলনের কথা। প্রতি বছর এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। একবার ঢাকাতেও হয়েছে, শাহবাগের বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের অডিটরিয়ামে, আমিও যুক্ত ও অংশগ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু ভারতে অনুষ্ঠিত কোনো সম্মেলনে যাবার সুযোগ হয়নি। অনেকেই জানেন, দিল্লিসহ ভারতের কয়েকটি শহরে এই সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। 

সার্ক সাহিত্য সম্মেলনের প্রধান উদ্যোক্তা খ্যাতনামা ভারতীয় কথাসাহিত্যিক অজিত কৌর। তিনি ১৯৮৬ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার এবং ২০০৬ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কার লাভ করেন। অজিত কৌর তার নিজ ভাষা পাঞ্জাবি ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন, পরে তার রচনা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এখন তার বয়স নব্বই বছর। তিনি একাধারে লেখক এবং  সমাজ সংস্কারক। তিনি ১৯৭৭ সালে দিল্লিতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আকাদেমি অব ফাইন আর্টস এন্ড লিটারেচার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি এবং তার কন্যা অর্পণা কৌর দু’জনেই তাদের নিজস্ব স্থাবর সম্পত্তি (বাড়ি এবং জমি) বিক্রি করে সেই টাকায় গড়ে তুলেছেন একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। যেখানে শিল্প-সাহিত্য ও চারুকলা চর্চার জন্য নিবেদিতপ্রাণ সকলে অবাধ বিচরণ করতে পারেন। এটি একটি পাঁচ তলাবিশিষ্ট সুরম্য অট্টালিকা যা নয়াদিল্লির সিরি ফোর্ট এলাকায় অবস্থিত। নিচ তলায় আর্টগ্যালারি, একটি লাইব্রেরি এবং একটি বিশাল মিলনায়তন রয়েছে যেখানে প্রায় প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় সার্ক সাহিত্য সম্মেলন। 

অজিত কৌর মনে করেন, ‘মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য দু’বেলা দুটো রুটির প্রয়োজন কিন্তু মানুষের চিন্তার ক্ষুধা মেটানোর খাবারের বড় অভাব। যারা সৃজনশীল লেখালেখি বা চারুকলায় কাজ করতে চান তাদের সুযোগ করে দিতেই তার এই প্রয়াস। বাংলদেশের সাহিত্য তিনি পড়েন, কবি শামসুর রাহমানের কথা উল্লেখ করেছেন যার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। তার লেখাও বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার গল্প-উপন্যাসে তিনি পারিপার্শ্বিক সমাজজীবনের চিত্রকল্প ফুটিয়ে তোলেন। তিনি যা দেখেন তা নিয়েই সাহিত্য রচনা করেন, তিনি যা চাক্ষুষ করেননি তা কখনো কাল্পনিকভাবে লেখায় আনেন না। তার এই ৯০ বছরের জীবনে তিনি যেমন দেখেছেন অনেক, তেমন লিখেছেনও হাত উজাড় করে। তার আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ ‘ওয়েভিং ওয়াটার’ ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি মনে করেন, নবীন লেখকদের কোন একটি লেখা লিখেই প্রকাশ করার জন্য উদ্বেল হলে চলবে না, বরং মানসম্পন্ন লেখা লিখতে হবে।

অজিত কৌর সার্ক সাহিত্য সম্মেলন আয়োজক কমিটির বর্তমান সভাপতি। এই সম্মেলনের সার্বিক সহযোগিতায় ছিল ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সার্কের আওতাধীন নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং স্বাগতিক ভারতের কবি সাহিত্যিকরা অংশগ্রহণ করেন। রাষ্ট্রসমূহ থেকে আগত কবি সাহিত্যিকদের কারোর কারোর (সকলের নয়) বিমানভাড়া থেকে শুরু করে সকলের জন্য আবাসন, আপ্যায়নসহ অন্যান্য ব্যয় বহন করা হয় আয়োজকদের পক্ষ থেকে।

বরেণ্য এই লেখক আমাকে ই-মেইলে আমন্ত্রণ জানালেন। এর আগে আমার নাম প্রস্তাব করেন কবি বিমল গুহ। তিনি আগেও কয়েকবার এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন এবং অজিত কৌরের বেশ পরিচিত ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি। আমন্ত্রণ অনুযায়ী ভিসা করে ২ ডিসেম্বর কবি বিমল গুহ ও আমি একই ফ্লাইটে রওনা করলাম, আমাদের সঙ্গে আরো ছিলেন কবি সেঁজুতি বড়ুয়া। সকাল দশটায় এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে উড়াল দিলাম দিল্লির উদ্দেশে। দুই ঘণ্টা পর দিল্লি বিমান বন্দরে নামবো, আমার পাশে বিমলদা। বিমান যাচ্ছে মেঘের উপর দিয়ে, বহুবার আকাশ পথে উঠেছি কিন্তু এই পথে নয়। এই পথে যেতে যেতে একটা চমৎকার দৃশ্য দেখলাম অর্থাৎ চোখের ভেতর সৌন্দর্য ঢুকে গেল, সে এক অপূর্ব সুন্দর, উইন্ডো দিয়ে দেখছি হিমালয়! আমার জানা ছিল না, বিমল দা বললেন, শিহাব দেখো ঐ যে হিমালয়। 

আমি দার্জিলিং গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে খুব ভোরে হিমালয়ের সৌন্দর্য কিছুটা দেখেছি কিন্তু এখন বিমান থেকে যে হিমালয়কে যেভাবে দেখছি, তা অভাবনীয়! অনেকক্ষণ সময় ধরে বিমান গেল সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের পাশ দিয়ে। সাদা বরফের গায়ে সোনালি রোদের কিরণ এক অদ্ভুত দ্যোতনা তৈরি করেছে। চোখ আর মনটা ভরে গেল। এই দেখতে দেখতেই কাছাকাছি চলে এলাম দিল্লি বিমান বন্দরে। বেশ বড় বিমান বন্দর। ধীরে ধীরে বিমান ল্যান্ড করলো, প্রথমবারের মতো নামলাম দিল্লিতে। নেমে ইমেগ্রেশন শেষ করে একটা সিম নিয়ে বের হলাম, বাইরে অনেক রোদ ও ধুলা। বিমলদা, সেঁজুতি ও আমি একটা ট্যাক্সি নিলাম, নেয়ার সময় এসি ট্যাক্সির জন্য ১২ শ’ রুপি নিলো। কিন্তু দেয়ার সময় নন এসি একটা গাড়ি দিলো। ড্রাইভারকে বললাম, এটা কেন? সে তর্ক করা শুরু করলো এবং বলল, সিরিয়ালের গাড়ি সুতরাং এটাতেই যেতে হবে। কি আর করা? যাত্রা শুরু করলাম, বাইরে প্রচুর গরম এবং ধোঁয়ার মতো ধুলা, রাস্তাগুলো প্রশস্ত হলেও ধুলা ও গরমের কারণে বেশ অস্বস্তি বোধ করছি আমরা। বলে রাখি, আমরা এই তিনজন ছাড়াও এবার এই সাহিত্য সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে আরো যারা অংশগ্রহণ করছেন, তারা হচ্ছেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, নাট্যকার ও অনুবাদক আবদুস সেলিম, স্বস্ত্রীক অধ্যাপক ফখরুল আলম, কবি ইউসুফ মোহাম্মদ, কবি কামরুল হাসান, কবি শাহেদ কায়েস, কবি আশরাফ জুয়েল ও কবি সৌম্য সালেক। 

বাংলাদেশের এই ১১জন ছাড়াও সার্কের অন্যান্য দেশের আগত লেখকদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে উত্তর প্রদেশের নইদায় ইন্সটিটিউট অব বায়লোজিক্যালসে। শুনেছি এই সম্মেলন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হলে, বিভিন্ন দেশের লেখকদেরকে এখানেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। দিল্লি এয়ারপোর্ট থেকে যেতে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লাগলো। ড্রাইভার অনেক ঘুরিয়ে-পেচিয়ে অবশেষে আমাদের নামিয়ে দিলো। খুবই সুন্দর, নিরিবিলি ও পরিপাটি এই ইন্সটিটিউট। রিসিপশনিস্ট লোকটি ভালো ইংরেজি জানে না, কোনোরকম বুঝিয়ে থাকার রুম পেয়ে সেখানে উঠে গেলাম। রুমটি বড় এবং সুন্দর। আমার রুমমেট হিসেবে নিলাম কবি সৌম্য সালেককে। দু’তলা ও তিনতলা মিলিয়ে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কার লেখকরা উঠেছেন। রাতের খাবার ওদের ডাইনিং রুমে ব্যবস্থা করেছে এবং খাবার বাইরে থেকে রান্না করে আনা হয়েছে। রাতে একটু ঠান্ডা পড়েছে। খাওয়ার পর একটু হাঁটাহাঁটি করে ঘুমিয়ে পড়লাম। 

সকালে উঠে নাস্তা সেরে একটি বড় বাসে উঠলাম সবাই। সবাই মানে সব দেশের লেখক। এখান থেকে যেতে হবে নয়াদিল্লির সিরি ফোর্ট এলাকায়। গাড়ির চালক জানালো, যেতে ৪০-৪৫ মিনিট লাগবে। সকালের রোদ কড়া হয়ে উঠছে। বাস চলছে বড় রাস্তা ধরে। দেখছি দিল্লির হাইওয়েগুলো আট লেন, বারো লেন পর্যন্ত। আমরা প্রায় ১ ঘণ্টা সময় পর নয়াদিল্লির একটি নিরিবিলি জায়গায় খ্যাতিমান লেখক অজিত কৌরের প্রতিষ্ঠিত ‘আকাদেমি অব ফাইন আর্টস এন্ড লিটারেচার’ সুরম্য ভবনের সামনে নামলাম। নেমেই ঢুকলাম নিচতলার কক্ষে, ইতোমধ্যে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। আমি এবং সৌম্য সালেক ছাড়া বাংলাদেশের যে ক’জন লেখক গেছেনে, তারা কেউ কেউ আগে দুইবার থেকে দশবারও অংশগ্রহণ করেছেন এই বাৎসরিক সাহিত্য অনুষ্ঠানে। (চলবে)