এবার ফাউন্ডেশন অব সার্ক সাহিত্য সম্মেলন আয়োজিত ৬৪তম উৎসব এটি। ৩-৬ ডিসেম্বর ২০২৩, চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। প্রথম দিন আমি শুনবো ও দেখবো। দ্বিতীয় দিন আমার কবিতা পড়ার কথা। কোনো মঞ্চও নেই, একটি কক্ষের মধ্যে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের লেখক বাদে বাকি ৫টি দেশের প্রায় ৭০ জন লেখকের অংশগ্রহণের অনুষ্ঠানটি চলছে, তবে বেশ সুন্দর। ৯০ বছর বয়সী অজিত কৌর অমায়িক, মানবিক, বিনয়ী, বোদ্ধা মানুষ ও অভিজ্ঞ লেখক, অনেক নাম শুনেছি, ই-মেইলে কথা বলেছি, ভিতরে আগ্রহ প্রবল ছিল, কখন তাঁর সঙ্গে সরাসরি পরিচয় ঘটবে, এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণই বলবো; এলো সেই সময়। শুরু হওয়া অনুষ্ঠানের মঞ্চে আছেন তিনি। উদ্বোধনী পর্ব শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ছুটে গেলাম, পরিচয় দিতেই তিনি স্নেহের সাথে কাছে ডাকলেন এবং স্বাগত জানালেন।
পরের সেশনে প্রবন্ধ পাঠ, কবিতা পাঠ, একক বক্তৃতা হলো। দুপুরের চমৎকার খাবার দেয়া হলো বেজমেন্টে। এক ঘণ্টা পর আবার অধিবেশনগুলো শুরু হলো এবং বিকাল পাঁচটায় শেষ হলো। অর্থাৎ সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা, মধ্যাহ্ন বিরতিসহ। পাঁচটার পর চা-কফি ও নাস্তার ব্যবস্থা আছে এবং এই সময়টা বিভিন্ন দেশের লেখকদের সঙ্গে পরস্পর আলোচনা-আড্ডা, নিজ নিজ দেশের সাহিত্যের বর্তমান সাহিত্য ও অন্য দেশের বর্তমান সাহিত্যচর্চা নিয়ে মতবিনিময় হলো। তারপর সকলকে নিয়ে বাস ছাড়লো নইদার উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যার ঘন ছায়া আর নিয়নবাতির সাদা-কমলা আলোর ভিতর হাইওয়ে ধরে চলে এলাম ইনস্টিটিউট অব বায়লোজিক্যালসে। এসে রাতের খাবার খেয়ে সৌম্য আর আমি বেশ রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে এবং ঢাকায় স্ত্রী ও কানাডায় বড় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন ৪ ডিসেম্বর। একইভাবে নাস্তা সেরে গাড়িতে করে পৌঁছে গেলাম আকাদেমি অব ফাইন আর্টস এন্ড লিটারেচারের সম্মেলেন কেন্দ্রে। বলেছি আজ দ্বিতীয় দিনে আমার কবিতা পাঠ। একটিই কবিতা পড়ার কথা—সময় নির্দিষ্ট করা আছে। ঢাকা থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে গেছি আমার ‘কত দূর বাংলাদেশ’ কবিতাটি পড়বো—ইংরেজি ও বাংলা দু’ ভাষাতেই। পড়লামও। এখানে একটু বলে রাখি, জনাব অজিত কৌর ই-মেইলে আমাকে জানিয়েছিলেন, আমি এবারের থিম সুফিবাদ ও ভক্তিবাদের কোনো লিখিত প্রবন্ধ বা বক্তৃতা করবো কি না? আমি জানিয়ে দিয়েছি কবিতা পড়বো, কারণ হিসেবে আমি ভেবে নিয়েছি যে, আমি প্রথমবারের মতো যাচ্ছি, সাহিত্য উৎসবের চরিত্রটাও বুঝবার দরকার আছে, দুর্বলতার পরিচয় দেয়া যাবে না। সুতরাং কবিতাটিই পড়লাম। এখানে বলে রাখি, কবিতার সেশনটি শেষ হওয়ার পরপরই সৌম্য আর আমি দিল্লি দেখতে বেরিয়ে যাবো। পূর্বকথা অনুযায়ী দু’জন বেরিয়ে গেলাম।
আমরা একটি অটো নিয়ে ছুটলাম ইন্ডিয়া গেটের দিকে। যায় যায় বিকেলের ছায়া মাড়িয়ে ছুটছি নয়াদিল্লির সড়ক ধরে। যথেষ্ট গাছ-পালা দেখছি রাস্তার দু’ পাশে, ইউরোপ-আমেরিকার মতো না হলেও মোটামুটি পরিচ্ছন্নই মনে হচ্ছে শহরটিকে। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টায় পৌঁছালাম গন্তব্যে। অটো ছেড়ে দিয়ে এক রকম দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম সুউচ্চ টেরাকোটা রঙের গেটের কাছে, কারণ সূর্য ডুবে যাচ্ছিলো। একদম কাছে যাওয়া গেলো না, অনেক দর্শনার্থীতে ঠাসা। আমরা কিছু ছবি তুললাম, স্মৃতির আয়নায় রাখার জন্য। এরপর উল্টা দিকে পার্লামেন্ট ভবনের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম, কিছু দূর যাওয়ার পর নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মীরা বললেন, আজ আর ওদিকে যাওয়া যাবে না। কিছুই করার নেই, তাই ফিরতে হলো, তবে আকাদেমি অব ফাইন আর্টস এন্ড লিটারেচারে নয়, কারণ সেখানে আজকের দিনের অধিবেশন ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে এবং বাসও চলে গেছে; সুতরাং সিদ্ধান্ত নিলাম মেট্রোতে যাবো, সে উদ্দ্যেশে কাছের একটি স্টেশনে গেলাম। বলে রাখি, এর আগে ভারতের কলকাতার মেট্রোতে উঠেছি ২০১৪ সালে, এবার প্রথম দিল্লির মেট্রোতে উঠছি। তখন কাজ ফেরত মানুষের প্রচুর ভিড় দেখলাম, ঘটনাও ঘটলো তাই-ই, প্রচণ্ড ভিড়ে ঠাসা ট্রেন, এর মধ্যেই অনেক কষ্ট করে নইদায় গিয়ে নামলাম।
পরদিন ৪ ডিসেম্বর, আমি আর সৌম্য উৎসবে না গিয়ে সরাসরি দিল্লি দেখতে বেরিয়ে গেলাম। নাস্তা সেরে নইদা মেট্রো স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে চলে গেলাম মুঘলদের তৈরি অসাধারণ স্থাপত্য লালকেল্লা দেখতে। টিকিট কেটে লালকেল্লায় ঢুকলাম। প্রচুর দর্শক। বিশাল আয়তনের লালকেল্লা। ঘুরে ঘুরে দেখছি আর অভিভূত হচ্ছি। মনে মনে ভাবছি, শত শত বছর আগে কি করে সম্ভব হয়েছে এ রকম স্থাপত্যশৈলি নির্মাণ করা। রুচি ও সৌন্দর্য ভাবনায় প্রখর এই কেল্লার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন এবং বসবাস স্থাপন করা? দিল্লি সরকার এখনো এই ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন রেখে দর্শনার্থীদের জন্য প্রদর্শন করছেন। খোলামেলা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রেখেছেন। ঢুকলাম দুটো জাদুঘরে, যেখানে প্রামাণ্যচিত্রসহ প্রদর্শিত হচ্ছে মুঘলদের ব্যবহৃত নানান মাত্রিক নিদর্শন। এখানে পাঁচটা মিউজিয়াম, আছে রং মহলসহ নানান নান্দনিক সৌন্দর্যের লীলাচূর্ণ। দেখে সত্যি মুগ্ধ হলাম। একই গেট দিয়ে বেরিয়ে মূল সড়কের উল্টা পাশেই পুরোনো দিল্লির বিখ্যাত চাঁদনি চক।
একটা রিকশা নিয়ে চাঁদনি চক ঘুরতে থাকলাম। লম্বালম্বি সড়ক আর দু’ পাশে দোকান-পাট। খাবারের দোকানসহ বিভিন্ন দ্রব্য ও পণ্য বিক্রির দোকান। লোকজন কেনাকাটা ও খাওয়া-দাওয়া করছে। যেতে যেতে আমাদের পুরনো ঢাকার কিছু বৈশিষ্ট্য ও গন্ধ বা ফ্লেবার পাচ্ছি। পার্থক্য পাচ্ছি নয়াদিল্লির সাথেও। আমরা শেষ মাথায় গিয়ে খাবার খেলাম, যা সুস্বাদু খাবার তালিকায় স্মরণীয় খাবার হিসেবে আমার কাছে থাকলো। রিকশায় উঠে চালককে বল্লাম দিল্লি জামে মসজিদের দিকে আমাদের নিয়ে যাও। কিন্তু রিকশাওয়ালা একটু প্রতারণাই করলো আমাদের সঙ্গে। কারণ চাঁদনি চকের একদম পাশেই দিল্লি মসজিদটি। আমরা চিনি না বলে এই প্রতারণা সহ্য করতে হলো। রিকশা থেকে নেমে মসজিদের এক পাশের গেটে গেলাম এবং জুতা খুলে সিঁড়ি বেয়ে মসজিদের মূল লেবেলে উঠলাম। দুপুরের কড়া রোদ, ছোট-বড়, নারী-পুরুষসহ বহু দর্শনার্থী, অনেকেই নামাজ আদায় করছেন। অজুর জন্য মসজিদে ঢোকার আগেই ফোয়ারা ও পানির নহর বয়ে যাওয়া চৌবাচ্চার মতো অজুস্থল। বিশাল জায়গাজুড়ে মসজিদ প্রাঙ্গণ। সৌম্য নামাজ আদায় করলো। তারপর আমরা বেরিয়ে এলাম। নিচে নেমেই দেখলাম ফুটপাতে নানা রকম পশরা ও খাবারের দোকান। সৌম্য গরুর মাংসের চাপ খেলো। এরপর আমরা অটো নিয়ে গেলাম লুটাস ট্যাম্পেল দেখতে, বিশাল জায়গাজুড়ে সুন্দর আর্কিটেক্ট ডিজাইনে ট্যাম্পেলটি। সবুজ ঘাস-গাছ-ফুলশোভিত প্রাঙ্গণটি দৃষ্টিনন্দিত। (চলবে)
পড়ুন প্রথম পর্ব : নয়াদিল্লি: কিছুটা কাছের হলো