ভ্রমণ

উপন্যাস পড়ে ইতিহাসের সন্ধানে ত্রিপুরায়

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাজর্ষি’ উপন্যাস পড়েছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে। তখন থেকেই ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দমাণিক্যের নামের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। রাজা গোবিন্দমাণিক্যের উপর ভিত্তি করে আর গোমতী নদীপাড়ের ভুবনেশ্বরী মন্দিরকে প্রেক্ষাপট করেই ‘রাজর্ষি’ রচিত হয়েছিল। এই উপন্যাসে দেখা যায়, রাজা গোবিন্দমাণিক্য একদা সকালে এ নদীতে স্নান করতে গিয়ে হাসি ও তাতা নামে দুই ভাইবোনের দেখা পান।  তার সঙ্গে এই দুই ভাইবোনের ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একদিন মহিষ বলির পরদিন রাজা নদীতে স্নান  করতে যখন আসেন তখন হাসি ও তাতা নদীর ঘাটে খেলছিল। সে সময় নদীর ঘাটে রক্তের দাগ দেখে হাসি জিজ্ঞেস করে, ও রক্তের দাগ কিসের? রাজা উত্তর দিতে না পারায় হাসি আঁচল দিয়ে নদীর ঘাট মুছতে থাকে। এরপর হাসি জ্বরে মারা যায়। জ্বরের বিকারে সে বলতে থাকে ‘ও রক্তের দাগ কিসের?’ 

এরপরই রাজা ঘোষণা দেন- রাজ্যে বলি দেওয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু বাদ সাধে রঘুপতি পুরোহিত এবং রাজার বড় ভাই। তারা বলতে থাকেন, রাজার বলিদান প্রথা বিলোপের জন্য রাজ্যের অবনতি অবশ্যাম্ভাবী। শেষ পর্যন্ত রাজ্য ছাড়া হন রাজা, তার নতুন পুরোহিত বিল্বন। রাজ্যে নতুন রাজা হন রাজার বড় ভাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভুল বুঝতে পারেন রঘুপতি। ছুঁড়ে ফেলে দেন কালীর মূর্তি। বুঝতে পারেন নরবলি ও বলিদান ভিত্তিহীন। শেষ পর্যন্ত জয় হয় মানবতার। সবাইকে হার মানতে হয় রাজা গোবিন্দমাণিক্য ও বিল্বনের কাছে। রবীন্দ্রনাথ জয় ঘটান মানবতার।

‘রাজর্ষি’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঐতিহাসিক উপন্যাস। উপন্যাসটি মানবতার পক্ষে ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কথা বলে। পরবর্তীতে এ উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে রচিত হয় তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘বিসর্জন’। এই উপন্যাসের গল্প সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘কলিকাতায় ফিরিবার সময় রাত্রের গাড়িতে ভিড় ছিল। ভালো করিয়া ঘুম হৈতেছিল না। ঠিক চোখের উপরে আলো জ্বলিতেছিল। মনে করিলাম ঘুম যখন হইবে না তখন এই সুযোগে বালকের জন্য একটা গল্প ভাবিয়া রাখি। গল্প ভাবিবার ব্যর্থ চেষ্টার টানে গল্প আসিল না, ঘুম আসিয়া পড়িল । স্বপ্ন দেখিলাম, কোন এক মন্দিরের সিঁড়ির রক্তচিহ্ন দেখিয়া একটি বালিকা অত্যন্ত করুণ ব্যাকুলতায় তাহার বাপকে জিজ্ঞাসা করিতেছে- বাবা, একি! এ যে রক্ত! বালিকার এই কাতরতায় বাপ অত্যন্ত ব্যথিত হইল অথচ বাহিরে রাগের ভান করিয়া কোনমতে তার প্রশ্নটাকে চাপা দিতে চেষ্টা করিতেছে। জাগিয়া উঠিয়ায় মনে হইল এটি আমার স্বপ্নলব্ধ গল্প। এই স্বপ্নটির সঙ্গে ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দমাণিক্যর পুরাবৃত্ত মিশায়ে রাজর্ষি গল্প মাসে মাসে লিখিতে লিখিতে বালকে বাহির করিতে লাগিলাম।’

মন্দিরের সামনে লেখক

ভারতের ছোট্ট একটি রাজ্য ত্রিপুরা। ঢাকা থেকে সবচেয়ে কাছের রাজ্য। এই রাজ্যের প্রায় তিন দিকেই বাংলাদেশ। রাজ্যের রাজধানী আগরতলা। আখাউড়া সীমান্ত গেইটের সাথেই ছোট্ট ছিমছাম শহর। আমি আগরতলায় প্রথম এসেছিলাম মঞ্চনাটকের শো করতে। সেটাও প্রায় একযুগ আগের কথা। এরপর আরো একাধিকবার এসেছি। আগরতলা শহরে আছি তিন দিন হলো। প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও বের হওয়ার সুযোগ পাচ্ছি না। যদিও কোথাও ঘুরতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এবার আসি নাই। ইচ্ছে হলো আগরতলা গিয়ে কয়টা দিন কাটিয়ে আসি উদ্দেশ্যহীন, তাই আসা। বন্ধু দেবুর বাড়িতে আছি। দেবু আগরতলার বেশ পরিচিত ভরতনাট্যমের নৃত্যশিল্পী। তার নিজের একটি নাচের স্কুল আছে এখানে। আগরতলায় এলে আমার থাকার ব্যবস্থা দেবুর বাড়িতেই হয়। 

রাতে কথা হচ্ছিল ত্রিপুরা দর্পণ পত্রিকার সাংবাদিক বিপ্লব সাহা, বৈদ্যদার সঙ্গে। তিনি থাকেন উদয়পুর। আগেও বেশ কয়েকবার উদয়পুরে যেতে বলেছেন কিন্তু যাব যাব করে আর যাওয়া হয়নি। তিনি বললেন, শাকিল সকালে চলে এসো। আমার বাইকে করে তোমাকে উদয়পুর ঘুরে দেখাবো। আমিও চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই রাজি হয়ে গেলাম। শুধু তাকে একটা আবদার করে বললাম, দাদা আমাকে কিন্তু সেই মন্দিরটা দেখাতে হবে, যে মন্দির নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজর্ষি উপন্যাস লিখেছেন। বিপ্লবদা বললেন, অবশ্যই দেখাবো। তুমি উদয়পুর এসে ব্রহ্মাবাড়ি নামবে বাস থেকে। 

সকালেও বৃষ্টি হচ্ছে। দশটার দিকে বৃষ্টি কিছুটা কমেছে। দেরি না করে রওনা হয়ে গেলাম। দেবুর বাড়ি থেকে হেঁটে নাগেরজলা বাস স্ট্যান্ডে চলে এলাম। এখান থেকে উদয়পুরের বাসে উঠে বসলাম। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই শহরের ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এলো সবুজ গ্রামীণ রাস্তা। রাস্তার দুই পাশে সবুজ গাছপালা, কৃষিজমি, গ্রাম পেছনের দিকে ছুটছে। রাস্তার ডানপাশেই চোখে পড়লো ত্রিপুরা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস। এই পথে আগেও একাধিকবার যাওয়া হয়েছে বলে অনেকটাই পরিচিত। ছোট ছোট পাহাড়েরর ভিতর দিয়ে বাস এগিয়ে চলছে। চোখ জুড়ানো সবুজ চা বাগান বাস জার্নির ক্লান্তি মুহূর্তেই মুছে দিচ্ছে। 

বহে নিরবধি গোমতী নদী

ব্রহ্মাবাড়ি বাস থেকে নেমে বিপ্লবদাকে ফোনে কল দিয়ে জানালাম। তিনি অপেক্ষা করতে বললেন। তার আসতে দশ মিনিটের মতো সময় লাগবে। এদিকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। আমি একটি চা স্টলে বসে এই সুযোগে চা পান করে নিলাম। বিপ্লবদাও চলে এলেন। তার স্কুটারে করে আমাকে নিয়ে উদয়পুর ঘুরে দেখাতে রওনা হলেন।

ভৈরব মন্দির বাঁয়ে রেখে কিছু দূর এগুতেই তিনটি প্রাচীন মন্দিরের কম্পাউন্ড। বৃষ্টিভেজা দুপুরে কোনো দর্শনার্থী নেই মন্দির চত্বরে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। এক পাশে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সতর্কবাণীর সাইনবোর্ড। ‘গুণাবতী মন্দির গুচ্ছ’ নামেই পরিচিতি এই তিন নিঃসঙ্গ মন্দিরের। সবুজ ঘাসের চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা লালরঙা মন্দির তিনটির প্রতিষ্ঠাকাল ও প্রতিষ্ঠাতার পরিচয় এখনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। কেবল একটি মন্দিরের প্রস্তরলিপি ইতিহাসের ওপরে আলোর ছটা ছড়িয়েছে মাত্র। তাতে বলা হয়েছে, মহারাজা গোবিন্দমাণিক্যের স্ত্রী মহারানী গুণাবতী ১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

অপর দুই মন্দিরেও সমসাময়িক স্থাপত্যশৈলীর ছাপ রয়েছে। তবে প্রকৃত ইতিহাস এখনো ধুলোর নিচেই চাপা। প্রতিটি মন্দিরেই জোড়া কক্ষ। সামনেরটি অপেক্ষাকৃত ছোট, ছাদের আকৃতি চৌচালা। পেছনের মূল কক্ষের ছাদজোড়া চৌচালার ওপরে মুকুট আকৃতির বুরুজ। সেই মুকুট আর ছাদের কার্নিশের নিচে স্তরে স্তরে নকশা কাটা। মূল কক্ষের চার কোণার প্রতিটিতে নকশা কাটা মিনার উঠেছে ছাদের নিচ পর্যন্ত। দেয়ালেও নানা নকশা। প্রতিটি মন্দিরের প্রবেশ পথের খিলানে খাঁজকাটা।  

এই মন্দির গুচ্ছ ছাড়িয়ে আর একটু এগুতেই গোমতী নদী। এর উৎপত্তি রাজ্যের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের পার্বত্য অঞ্চল ডুমুর। তীব্র স্রোতে সম্পন্ন এ নদী পার্বত্যভূমিতে দেড়শ কিলোমিটার সর্পিল পথ পাড়ি দিয়ে কুমিল্লা সদর উপজেলার কটক বাজারের কাছে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। গোমতী পেরিয়ে হাতের বাঁয়ে টিলায় ওঠার রাস্তায় পরিত্যক্ত বিষ্ণু মন্দির। দেয়াল ও ছাদে তার আগাছার রাজত্ব।

১৬৬০ থেকে ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দ এখান থেকেই রাজকার্য পরিচালনা করতেন। মহারাজা গোবিন্দমাণিক্য যখন দ্বিতীয়বার সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন ভুবনেশ্বরী মন্দির দেবী ভুবনেশ্বরীকে উৎসর্গ করে নির্মাণ করেন। তখন উদয়পুর ছিল রাজ্যের রাজধানী। এই মন্দিরটির স্থাপত্যকলা বিখ্যাত। কেননা তার সাদৃশ্য বাংলার চারচালা স্থাপত্যকলার অনুরূপ। মন্দিরটি একটি উঁচু জায়গায় নির্মিত হয়েছিল মন্দিরের ভিতরের কক্ষটি একটি চাঁদনীর সঙ্গে যুক্ত, দেবতার স্থান এবং চাঁদনী দুটোরই ছাদ গোলাকার এবং সাদৃশ্যযুক্ত স্তূপ দ্বারা ভরাট করানো। আভ্যন্তরীণ কক্ষটির ছাদ পুষ্পশোভিত নকশা দিয়ে সুসজ্জিত। মন্দিরের ভেতরের  কোণায় মোমবাতি রাখার বিশেষ স্তম্ভ আছে। 

গোমতীর দক্ষিণ তীরে টিলার ওপরে মহারাজা গোবিন্দমাণিক্যের রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। খনন করে কিছু কক্ষের আকৃতি সম্প্রতি বের করা হয়েছে মাটির নিচ থেকে। তাতে অবলুপ্ত বিশালতার অবয়ব স্পষ্ট। ওই ঘরগুলোর কোণায় কোণায় রাজকাহিনীর কতো যে অধ্যায় মিশে আছে তা আর কেইবা বলতে পারে! পাশেই দুর্গ আকৃতির একটি ভবন। 

সবুজ পাহাড়ের ভিতর দিয়ে উত্তরে গোমতী নদী, পূর্ব ও পশ্চিমে খাড়া টিলা। দক্ষিণ থেকে ঢালু পাহাড় বেয়ে এখানে ওঠা যায় কেবল। এখানে দাঁড়িয়ে তাই চারিদিকে তাকালেই অনুমান করা যায়, ভৌগলিক অবস্থানগত কৌশলে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ এই টিলার অবস্থান। শত্রুর পক্ষে কতোটা কঠিন এই প্রাসাদ দুর্গ আক্রমণ করা। গোবিন্দমাণিক্যের রণকৌশলগত দূরদর্শীতার প্রমাণও তো এই প্রাসাদের অবস্থান থেকেই বোঝা যায়।    

রাতের আলোয় আগরতলা রাজবাড়ি

প্রাসাদের পাশেই ভুবনেশ্বরী মন্দির। উঁচু প্লাটফর্মের ওপর নির্মিত মন্দিরটির আদল অনেকটা গুণাবতী মন্দিরের মতো। গোমতীর পাড়ের ভুবনেশ্বরী আর গুণাবতী মন্দির দুইটি যে সমসাময়িক তা ধরেই নেওয়া যায়। মন্দিরের পাশে বিশাল এক পাকুড় গাছ ছায়া বিছিয়ে রেখেছে। পাশেই উঁচু ওয়াচ টাওয়ার। টাওয়ারে উঠে চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকন করা যায়। নিচে দেখা যায়, পাহাড়ি ভূমিতে ঘন গাছপালার ফাঁকে গোমতীর খরস্রোতা জল বইছে। এক সময় এ মন্দিরে নরবলী হতো বলে জনশ্রুতি আছে।

মহারাজা গোবিন্দমাণিক্যের উপর ভিত্তি করে, এই ভুবনেশ্বরী মন্দিরকে প্রেক্ষাপট করে ‘রাজর্ষি’ উপন্যাস ও বিসর্জন নাটক রচনা করেন বিশ্বকবি। আর ‘বিসর্জন’ নাটকের মুখ্যচরিত্র মহারাজা গোবিন্দমাণিক্য। ওই দুই সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ রবি ঠাকুরের ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে প্রাসাদ ও মন্দিরের মধ্যবর্তী স্থানে। প্রাসাদ চত্বরে গড়া হয়েছে রাজর্ষি মুক্তমঞ্চ। এখানে প্রতি বছর রাজর্ষি মেলা হয়। বৃষ্টিভেজা দিনে কাকভেজা হয়ে স্কুটিতে করে অল্প সময়ের মধ্যে ঘুরিয়ে দেখালেন বিপ্লব দাদা। সাংবাদিকতা যেহেতু তার পেশা, সে কারণেই হয়তো এই অঞ্চল নিয়ে তার জানাশোনা একটু বেশিই। প্রত্যেকটা জায়গা সম্পর্কে তথ্যসহ গল্প শুনিয়েছেন। সময় অল্প হলেও বিপ্লবদার সঙ্গে এই ভ্রমণ আমাকে আনন্দ যেমন দিয়েছে তেমনি নিয়েছি ইতিহাসের পাঠ।