ভ্রমণ

ফিরোজা দরিয়ার উপকূলে, ক্রোয়েশিয়ায় 

ভেবেছিলাম চব্বিশে জার্মানির বাইরে কোথাও হয়তো যাওয়া হবে না। পড়ালেখার নিয়মিত চাপে প্রতিটি সপ্তাহ মাথার কাছে ঘন হয়ে থাকে, আজ প্রেজেন্টেশান তো, কাল পরীক্ষা, সপ্তাহান্তে সেগুলোর প্রস্তুতি নিতে নিতেই সমস্ত শক্তি শেষ হওয়ার উপক্রম! কেবল অপেক্ষা করেছিলাম গরমের ছুটির। তখন কিছুটা বিশ্রামে যাওয়া যাবে।

এরই মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে ইরাজমুস প্লাস প্রোগামের আওতায় ক্রোয়েশিয়া যাওয়ার সংবাদ পেলাম। অনেক আগে নাম নিবন্ধন করে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। এরকম প্রোগামে যাওয়ার সুবিধে হলো, ক্লাসের পাঠে উপস্থিত না হয়েও উপস্থিতি আদায় করা যায়, একই সঙ্গে বিভিন্ন সেমিনার আর পরিদর্শন নতুন দেশের শিক্ষাপদ্ধতির সঙ্গে পরিচয় ঘটার সুযোগ করে দেয়।

প্রোগ্রামের অফিসিয়াল উদ্দেশ্য পর্যটন নয়, বরং ক্রোয়েশিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচয় করানো। কিন্তু বার্লিন বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পূর্বে দলের সবার সঙ্গে পরিচয়ের প্রাক্কালে বুঝলাম, কেউই প্রোগ্রামের অফিসিয়াল উদ্দেশ্য হাসিলের বিষয়ে উৎসুক নয়; সবার চোখেই ডিনারিক পর্বতমালার কোলে বলকানের নয়নাভিরাম স্লাভিক দেশ ক্রোয়েশিয়া কেবল ভ্রমণের বিষয়বস্তু। দুজন গাইডসহ দলে ষোল জন। 

স্প্লিট শহরের রাস্তা, মূলত গলিপথ 

আমরা ফিরে আসবো জাগরেব হয়ে; বার্লিন থেকে প্রথমে যাব সুনীল অ্যাড্রিয়াটিক বা আদ্রিয়ান সাগরের তীরে ক্রোয়েশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর স্প্লিটে, থাকবো সপ্তাহ দু’য়েক। প্রতিদিন সেমিনার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের পর বিকেল, সন্ধ্যা আর সপ্তাহান্তে থাকবে নিজস্ব পর্যটনের জন্য বরাদ্দ। স্থানীয় খাবার হাতে করে ডুব দেওয়া যাবে গ্রিক থেকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রোদ লেগে থাকা ইতিহাসে। সাহিত্য অনুষ্ঠানে যোগদান, নৌকা ভ্রমণ, স্লাভিক গ্রাম দেখা, পাহাড়ের ফাঁক গলে নেমে আসা হাজার বছরের পুরনো ঝরনা কিংবা সমুদ্রের নীল জল সফেন করার ফাঁকে ফাঁকে কেটে যাবে দিনগুলো। এমনই প্রত্যাশা শুধু আমার নয়, দলের সবার।

বার্লিন থেকে ওড়ার ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই আমরা ক্রোয়েশিয়ার আকাশ সীমানায় পৌঁছে যাই। সন্ধ্যার অভিমুখে মেঘ কেটে অবতরণের পূর্ব মুহূর্তে রক্তাভ আকাশের ভেতর ভাসতে ভাসতে উড়োজাহাজের পেট থেকে প্রথম দেখি স্প্লিট শহরের বুক ঘেরা আদ্রিয়ান সাগরের উত্তাল জল। দূরে ছোট ছোট দীপপুঞ্জ, মনে হয় নীল জলের ভেতর ঢুকে শান্ত বসে আছে। সমুদ্রে ঘুরে বেড়ানো একগুচ্ছ লাল নৌকাকে উড়োজাহাজ থেকে মনে হয় গাঢ় নীল রঙের ভেতর ছিটিয়ে রাখা ফুলের কুঁড়ি। আদ্রিয়ান দরিয়ার ভেতরে ক্রোয়েশিয়ার দখলে প্রায় ৭৮টি দ্বীপ। এই জলাধার ইতালীয় উপদ্বীপকে বলকান থেকে আলাদা করেছে। ভাবতেই শিহরিত হই; লেখায় বলকানের কত কথা পড়েছি; ছবিতে, সিনেমায় বলকানের কত কিছু দেখেছি, আজ সেখানে পদার্পণ করতে যাচ্ছি।

স্প্লিট পড়েছে ক্রোয়েশিয়ার ঐতিহাসিক ডালমাচিয়া অঞ্চলে। এখান থেকেই মূল বলকান অঞ্চলের শুরু। বলকানের পশ্চিমে আদ্রিয়ান, দক্ষিণে মার্মারা এবং পূর্বে রয়েছে কৃষ্ণ সাগর। সাধারণত এই অঞ্চলের উত্তরের সীমানা নির্ধারণ করা হয় স্লোভেনিয়া থেকে সার্ভিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত সাভা নদীর মাধ্যমে। অনেকের মতে আরও কিছুটা উত্তরে দানিউবের তীর পর্যন্ত বলকান বিস্তৃত।

আদ্রিয়ান সাগরের নোনা জলের হাওয়া শরীরের ভেতর দিয়ে বয়ে যায়

স্প্লিট বিমানবন্দরে যখন অবতরণ করি তখন সবে রাত নেমেছে। মে মাসের তরুণ রাত্রি। আকাশে ছড়ানো আবিরের রঙ তখনও পুরোপুরি যায়নি। বিমানবন্দর এলাকা বেশি বড় নয়। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া গেল। যেদিকে তাকাই উঁচু-নিচু টিলায় ঘেরা। এখান থেকে মূল শহরে যেতে হবে শাটল বাসে। বিমানবন্দরের সঙ্গে কোনো ট্রেনেরই সংযুক্তি নেই। পুরো বলকানেই নাকি ট্রেনের অবস্থা নাজুক। আদ্রিয়ান সাগরের উপকূল ধরে ধরে আঁকাবাঁকা সড়কের ভেতর দিয়ে বাস এগিয়ে যায়। একপাশে নীল জল, অন্যপাশে খাড়া উঠে যাওয়া টিলা। টিলার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখি তাদের গায়ে জমাটবাঁধা ঝিঁঝিঁ-সন্ধ্যার ঝাউপত্রের মতো পাতাওয়ালা নাম না জানা বলকান উদ্ভিদ। কোথাও কোথাও দুই একটা মহীরুহ। 

অন্য সব বিমানবন্দরের মতোই স্প্লিট বিমানবন্দরের অবস্থান শহর থেকে বেশ বাইরে। উপরন্তু আমরা যাব স্প্লিটের ওল্ড টাউনে, তাই দূরত্ব আরও কিছু বেশি। আগামী দিনগুলো থাকবো স্থানীয় মালিকের একটি ছোট্ট সরাইখানায়। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হবে। 

প্রায় ৪৫ মিনিট যাত্রার পর বাসটি সমুদ্রের জলের ধারে আদি স্প্লিট পোর্টের কাছে রিভা নামক স্থানে আমাদের নামিয়ে দেয়। রবিবারের রাত ঘন হয়ে গেছে। বার্লিনে মে মাসের যে তাপমাত্রা তার থেকে এখানকার উষ্ণতা কিছুটা বেশি। জলের কতো কারসাজি! 

বাস থেকে নামার পর এই প্রথম আদ্রিয়ান সাগরের নোনা জলের হাওয়া আমাদের শরীরের ভেতর দিয়ে বয়ে যায়। বাংলাদেশের হেমন্তকালে ঝিরঝির করে বয়ে যাওয়া হাওয়ার সঙ্গে কোথায় যেন মিল পাই, তবু বাতাসের নোনা ঘ্রাণ নিজের স্বকীয়তা জানান দেয়। গুগল ম্যাপ আমাদের বলে, এখান থেকে সরাইখানার দূরত্ব হাঁটা পথে ১৭ মিনিট। হালকা-শীতল নোনা হাওয়া আর রাস্তার সোডিয়াম ম্লান আলোর ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে মিনিট পাঁচেক পর আমাদের সবার চক্ষু চড়ক গাছ! এ কেমন গলি! অন্ধকারে মনে হয় পুরো শহরটাই টিলার উপরে। প্রধান সড়ক এবং দু’একটি সড়ক বাদে শহরের ভেতরকার পথগুলো প্রকৃতপক্ষে গলিপথ, জালের মতো বিস্তৃত ঘন বাড়িঘরের দেয়ালের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে ঘুরে হুটহাট খাড়া উপরে উঠে গেছে পথগুলো, শেষ হয়েছে সমুদ্রের ধারে এসে। পথগুলো এতো সরু হলেও ঝকঝকে তকতকে, ময়লার বালাই নেই। মাঝেমধ্যে পথে কোনো আবছা আলোও নেই, অমাবস্যার শতরঞ্জি যেন চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। 

ক্রোয়েশীয় গাঙচিল

সে রাতে আকাশে জ্বলজ্বলে চন্দ্র কিংবা তার প্রভা ছিল কিনা সে বিষয়ে খোঁজ করার খেয়াল তখন কারও ছিল না, সবার চোখ পথের ভেতরে, উৎসুক ও ক্লান্ত। গলিপথগুলো এত সরু যে, অপর পাশ থেকে একটা ছোট্ট ফিয়াট গাড়ি এলে দেয়ালের সঙ্গে মিশে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় নেই। এরকম গলির দু’পাশে দুই দালানের মধ্যে একটি সংযুক্তকারি রশি প্রায়ই যুক্ত থাকতে দেখা যায়, তাতে কাপড় শুকানো থেকে শুরু করে দুই পরিবারের মধ্যে চিঠি চালাচালির ব্যবস্থা নাকি এখনো সেকেলে হয়নি। ঘরগুলো কেন এতো কাছকাছি এ বিষয়ে ক্রোয়েশিয়ার স্থানীয় লোকদের ভেতর প্রচলিত কিছু গল্প আছে। এ প্রসঙ্গে কথা উঠলেই তারা ৩০৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা ডায়োক্লেশিয়ানের প্রাসাদের কথা তোলে। প্রাসাদটি মূলত সে সময়ের রোমান সম্রাটের অবসরকালীন বাসস্থান হিসেবে নির্মিত হয়। নির্মাণের সময় এর প্রাচীরের ভেতর সীমিত পরিসরে অনেক ভবন, রাস্তা এবং উপাসনালয় তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর, প্রাসাদটি পরিত্যক্ত না হয়ে স্থানীয় জনগণের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে, তখন যে যেখানেই জায়গা দখল করতে পারে সেখানেই ঘর তোলে। তবে সবারই লক্ষ্য ছিল যত পারা যায় প্রাসাদটির কাছকাছি বসবাস করা। ফলে ধীরে ধীরে শহরের কেন্দ্রে ঘনত্ব বাড়তে থাকে। 

মধ্যযুগে স্প্লিট শহর ছিল বহিরাগত আক্রমণ এবং জলদস্যুদের হুমকির মুখে। বলা হয়, সে সময়ে এই সরু গলিগুলো শহর প্রতিরক্ষায় বেশ কাজে দিয়েছিল। আজও স্থানীয় মানুষ না হয়ে ইন্টারনেট ছাড়া শহরের গলিগুলো নখদর্পণে রাখা প্রায় অসাধ্য।

আমাদের সবার চক্ষু চড়ক গাছ! এ কেমন গলি!

এই আঁকাবাঁকা খাড়া উপরে উঠে যাওয়া গলিগুলোর আরও একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তার পাথর বাঁধানো পথ। অধিকাংশ স্থানেই পিচঢালা নেই। পাথরগুলো সম্ভবত মধ্যযুগের কিংবা তারও আগের। চলাচলে পাথরগুলো এতো মসৃণ ও পিচ্ছিল হয়ে গেছে যে, শুকনো দিনেও সাবধানতা অবলম্বন না করলে পিছলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। স্প্লিটে সাধারণত তুষারপাত হয় না। নিয়মিত তুষারপাত হলে কত লোক যে আহত হতো কে জানে! (চলবে)

পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব : ফিরোজা দরিয়ার উপকূলে, ক্রোয়েশিয়ায়