ভ্রমণ

ফিরোজা দরিয়ার উপকূলে, ক্রোয়েশিয়ায় 

উঁচু-নিচু পথ ঘুরে, পা পিছলে, ঝিরঝিরে বাতাসের ভেতর ঘেমে-নেয়ে আমরা যখন সরাইখানার প্রধান দরজায় তখন চারদিক নিঝুম হয়ে এসেছে। hostel dvor, লাল টালি, সবুজ জানালা আর ঘিয়ে দেয়ালের ছোট্ট দোতালা দালান। স্বাগত জানাতে মূল দরজায় মালিক নিজেই উপস্থিত। আমাদের দলকে গাইড করার জন্য যে দু’জন শিক্ষক সঙ্গে ছিলেন, তাদের একজন জাতিতে বসনিয়ান। দু’দেশের ক্রোয়েশীয় ভাষা আমাদের এপার-ওপার বাঙলার মতো। ফলে ইংরেজি ব্যবহার করতে হলো না।

প্রথম পর্ব : ফিরোজা দরিয়ার উপকূলে, ক্রোয়েশিয়ায় 

পরদিন সকালে নাস্তার পর আমাদের গন্তব্য স্প্লিট বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদ। দিনের প্রথম কর্মসূচি, সোশ্যাল পেডাগগি বিভাগের শিক্ষার্থীদের একটি ক্লাসে আমরা জার্মানি থেকে আগত শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছানোর পর একটি সেমিনার কক্ষে প্রাথমিক পরিচয় পর্ব শেষে আমরা গেলাম ক্লাসে। ক্লাসে ঢোকার পর রীতিমত আকাশ থেকে পড়ি! ক্রোয়েশীয় শিক্ষার্থীদের একে তো সবাই শ্বেতাঙ্গ, উপরন্তু সবাইই নারী। আমাদের দলে আমরা ৭-৮ জন পুরুষ শিক্ষার্থী, তার উপরে আমার রঙ বাদামী, আমাদের দিকে ক্রোয়েশিয়ান শিক্ষার্থীদের চাহনি দেখে মনে হলো তাদের চোখে প্রথম সমুদ্র দেখার বিস্ময়! যারা সোশ্যাল পেডাগগি অধ্যায়ন করে ক্রোয়েশিয়ার তাদের চাকরির ক্ষেত্র সাধারণত প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয় কিংবা বড়জোর মাধ্যমিক। জার্মানির মতো এতো সুযোগ সুবিধা তাদের নেই। প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কেবল নারীরাই হবে, পুরুষরা সেখানে মানানসই নয়, এমন বদ্ধ ধারণা ২০২৪ সালে এসেও ক্রোয়েশিয়ায় এখনো বলবৎ। পুরুষ এবং নারীর পারিশ্রমিকের বিশাল তফাৎ এ দেশে। বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের পারিশ্রমিকের অবস্থা অন্য চাকরির তুলনায় অনেক কম। পাশাপাশি বাঙলা দেশে শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষকের যে কদর ও সম্মানের ঐতিহ্য আছে, সেটাও এদেশে প্রতিষ্ঠিত নয়। সব মিলিয়ে এই বদ্ধ ধারণা মুক্ত চিন্তার ক্রোয়েশীয়দের গলার কাঁটা। সে কারণেই হয়তো কোলিন্দা গ্রাবার কিংবা জাদরাঙ্কা কোসোকে ক্রোয়েশিয়ার ইতিহাস সৃষ্টিকারী বলা হয়ে থাকে।

ডায়োক্লেশিয়ানের প্রাসাদের মাঝখানের অংশ

ক্রোয়েশীয় অধ্যাপক অল্প কিছু অংশ ইংরেজিতে চালিয়ে ক্রোয়েশীয় ভাষাতে ফিরে গেলেন। আমাদের বসনিয়ান বংশোদ্ভূত গাইড জার্মানে অনুবাদ করে চললেন। অধ্যাপক যে ভালো ইংরেজি জানেন না, তাতে তাকে কুণ্ঠিত হতে দেখলাম না। পশ্চিমের বিভিন্ন বড়ো দেশে, যেমন স্পেনে, জার্মানিতে কিংবা ফ্রান্সে বিভিন্ন সেমিনারে অনেক সময় দেখেছি, নামী-দামি অধ্যাপক ইংরেজিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করছেন না বলে নিজের ভাষাই ব্যবহার করছেন, সেটাকে তৎক্ষণাৎ ভাষান্তর করছে কোনো স্বয়ংক্রিয় মেশিন কিংবা দোভাষী। পাশ্চাত্যের বড় বড় অধ্যাপকেরা ইংরেজি কতটুকু জানেন সেটা খোঁজা আমার উদ্দেশ্য নয়। বহু অমাতৃভাষী অধ্যাপককেও খুব ভালো ইংরেজি বলতে শুনেছি। কিন্তু যারা জানেন না, তাদের কুণ্ঠিত কিংবা অপ্রস্তুত হতে দেখিনি। আমাদের সঙ্গে পার্থক্যটা যেন ঠিক এখানেই।

আমাদের দেশের একদল লোক মনে করেন, ভালো ইংরেজি জানা মানেই ভালো শিক্ষিত হওয়া, আভিজাত্যের প্রকাশক। ইংরেজি কেবলই একটি ভাষা। ভালো ইংরেজি না জেনে উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া যায় না, এমন চিন্তা কেবলই ঔপনিবেশিকতা প্রসূত ও অমূলক। তবে হ্যাঁ, একটি নতুন ভাষা ভালো জানা থাকলে তা সাংস্কৃতিক, সামাজিকসহ বিভিন্ন পরিমণ্ডলে উপলব্ধির বিস্তার ঘটায়। একই সঙ্গে কোনো জটিল বিমূর্ত বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবতে মাতৃভাষার ভেতরকার ছোট ছোট অসম্পূর্ণতা রহিত করে। প্রতিটি শব্দের যেহেতু একটি স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনা আছে, সেহেতু দেখা যায় নতুন একটি ভাষা শেখার ফলে শব্দ ভাণ্ডারের ভেতর অনেক নতুন স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনার সমাবেশ ঘটে, ফলে কোনো জটিল কোনো বিষয় নিয়ে সফলভাবে চিন্তা করার পথ সুগম হয়। কিন্তু তাই বলে ভাষাটি ইংরেজিই যে হতে হবে, তেমন কথা নেই। সেটা হতে পারে আরবি, চীনা কিংবা জার্মান। পৃথিবীব্যাপী ইংরেজি ভাষার বিস্তার অনেক বেশি বলে, সে ভাষা ভালো জানা বেশ কাজের, তবে না জানলে লজ্জিত হওয়াটা হাস্যকর।

ব্রাচ দ্বীপের সমুদ্র সৈকত। দূরে অন্য দ্বীপের পাহাড়েরা

আমাদের সরাইখানাটি ছিল স্থানীয়দের আবাসিক এলাকায়, যে কারণে স্থানীয় স্লাভিক শব্দহাওয়ার স্বাদ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। স্প্লিটে বরফ না পড়লেও অধিকাংশ স্থানীয় বাড়ির ছাদ দোচালা, তাতে বিশেষত লাল রঙের টালি, দালানে দেয়ালের রঙের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জানালার দুই পাশের প্রাকারের সঙ্গে উজ্জ্বল রঙ করা কাঠের জানালার কপাট আটকানো। এই জানালা সবসময়ই একই স্থানে স্থির থাকে। দূর থেকে মনে হবে খোলা জানালা। ইউরোপের প্রায় অধিকাংশ দেশেই জানালার এই ধরন দেখেছি। দালানের শোভাবর্ধনে তার জুড়ি নেই। আর যদি জানালার সঙ্গে ফুলের টব জুড়ে দেওয়ার সুযোগ থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। দেখা যাবে, জানালা থেকে ঝুলে পড়েছে রকমারি ফুলের বাহার। একই কক্ষে তিনটি আলাদা বিছানায় আমরা তিন সহপাঠী ঘুমাতাম। প্রায় প্রতিটি সকালেই আমাদের ঘুম ভাঙত গাঙচিলের ডাকে। বাল্টিক, আটলান্টিক কিংবা আদ্রিয়ান সাগরের গাঙচিলের কাকলীর স্বর প্রায় কাছাকাছি হলেও চেহারা আর গঠনে তারা বেশ আলাদা। প্রায় সকালেই জানালা খুলে দেখতাম প্রতিবেশী দালানের দোচালার শীর্ষ বিন্দুতে দাঁড়িয়ে যে গাঙচিলটি ডাকছে তার গলার দিক কিছুটা দীর্ঘ। বাল্টিকের গাঙচিলের মতো অতো ছোটো নয়। জার্মানির দক্ষিণে বাভারিয়ার বিভিন্ন হ্রদে কিংবা রাইন নদীর বুকে উড়ে বেড়ানো কালো মাথার, বাদামি ধূসর ডানাওয়ালা শুভ্র ছোটো জাতের গাঙচিল সেগুলো নয়।

আদ্রিয়ানের সমুদ্র-গাঙচিল আয়তনে বেশ বড়সড়, ঈষৎ অগ্রভাগ বাঁকানো কমলা-হলুদ চঞ্চুর শেষ প্রান্ত থেকে পিঠের শুরু পর্যন্ত একেবারে তুষারের মতো শুভ্র পালক। পুরো পিঠের যে রঙ তা অকল্পনীয়- না ধূসর, না নীল। পাখার শেষভাগ কিছুটা কৃষ্ণকায়। পুরো বুক শুভ্র, পায়ের রঙ হলুদের দিকে ধাবমান। সাদা পালকের ভেতর তার আঁখি যেন জলের মতো টলটলে। ক্ষুদ্র ডিম্বাকার চোখের বাইরের পরিধি হলুদ, তারপর একটি কমলা রঙের পরিধি, এরপর গোল কুচকুচে কালো চোখের মণি। প্রায়ই প্রত্যুষে এমন একটি বিহগের ডাকে সহসা চোখ খুলে, জানালা গলে শরীরের ভেতর সমুদ্রের নোনা বাতাস ঢুকে পড়ার মুহূর্তে সূর্য উদয়ের ভেতর যখন তাকে অবলোকন করতাম, তখন মনে হতো পৃথিবী অন্য কোথাও ঘুরে গেছে। ক্রোয়েশিয়ার আকাশে যেদিন মেঘ থাকে না সেদিন আকাশে যে নীল রঙ হয়, তার বর্ণনা আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। ভোরের নীল আকাশের নিচে মনোরম গাঙচিলদের ডাকাডাকি আর তাদের পালকে রোদের স্ফুরিত মোলায়েম আবেশ প্রায়ই আমাকে কোনো এক ধ্রুপদী আনমনায় আবিষ্ট করে ফেলত। অধিকাংশ সময় সম্বিৎ ফিরতো নিচের তলায় কাউকে ‘দোবরা য়ুত্রা’ বলতে শুনলে। অর্থ শুভ সকাল। স্প্লিট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কারমেলার কাছ থেকে শেখা বেশ কয়েকটি ক্রোয়েশিয়ান শব্দে খুব দ্রুত অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। যেমন, দোবার দান: শুভ দিন, মলিম: প্লিজ, কাকোসতে: কেমন আছো, ভিদিমো সে: দেখা হবে, ইত্যাদি। 

উপর থেকে দেখা স্প্লিট শহর। পাইনগাছে ভরা মারজান পাহাড়ের শীর্ষবিন্দু দৃশ্যমান

ক্রোয়েশিয়ার প্রথম দিনেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচয় ঘটে কারমেলার সঙ্গে। প্রথম দিন ক্লাসে ঢোকার পর কোথায় বসবো এটা নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতেই কারমেলাই প্রথম তার পাশে বসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আলাপের ফাঁকে ফাঁকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে সে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, আর দশটি অর্থোডক্স ক্রোয়েশীয় নারীর মতো সে নয়। তার জন্ম স্প্লিটে নয়, এখানে পড়তে এসেছে ক্রোয়েশিয়ার একটি দ্বীপ থেকে। যাদের জন্ম দ্বীপে ক্রোয়েশিয়ায় মূল ভূমির মানুষেরা তাদের সবসময়ই প্রশ্নের চোখে দ্যাখা হয়, এমন কথা কারমেলাই আমাকে বলেছিল। ক্রোয়েশিয়ায় গিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন, প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমরা পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। ক্রোয়েশিয়ার শিক্ষাব্যবস্থাকে ভালো করে বুঝতে কোথাও কোথাও এক-দুই দিনের ইন্টার্নশীপও করেছি। কিন্তু ইন্টার্নশীপ করতে গিয়ে একটি বিষয়ই আমাকে সবথেকে অবাক করেছে: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মিশ্র বর্ণের শিক্ষার্থীর পরিমাণ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় খুবই কম। একদিন বিকেলে সাগরের পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে কারমেলাকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, সে কোনো যুতসই উত্তর দিতে পারেনি। 

প্রকৃত ক্রোয়েশীয় মানুষের চলা-ফেরা ভেজালহীনভাবে কীভাবে অবলোকন করা যায় সে বিষয়ে কারমেলা আমাকে একটি মজার টিপস দিয়েছিল। সুপারমার্কেট থেকে সবসময়ই কেনাকাটা না করে স্থানীয় বাজারে একটু ঘুরে এসো। এখানেও নাকি বাঙলা দেশের মতো বিভিন্ন স্থানে হাট বসে। কোথায় কোথায় গেলে খাঁটি স্থানীয় বাজারের দেখা পাওয়া যাবে সেসব কারমেলার কাছ থেকেই জেনেছিলাম। (চলবে)

ছবি: লেখক