ভ্রমণ

ফিরোজা দরিয়ার উপকূলে, ক্রোয়েশিয়ায় 

প্রকৃত ক্রোয়েশীয় মানুষের চলা-ফেরা ভেজালহীনভাবে কীভাবে অবলোকন করা যায় সে বিষয়ে কারমেলা আমাকে একটি মজার টিপস দিয়েছিল। সুপারমার্কেট থেকে সবসময় কেনাকাটা না করে স্থানীয় বাজারে একটু ঘুরে এসো। এখানেও নাকি বাংলাদেশের মতো বিভিন্ন স্থানে হাট বসে। কোথায় কোথায় গেলে খাঁটি স্থানীয় বাজারের দেখা পাওয়া যাবে সেসব কারমেলার কাছ থেকেই জেনেছিলাম।

স্প্লিটের পুরাতন শহর সাধারণত পর্যটকের ভারে নুয়ে থাকে। পুরাতন শহরের বাইরে বেশ কিছু স্থানীয় বাজারের দেখা পেলাম। সেখানে গিয়ে তো চোখ ছানাবড়া! বাংলাদেশের মতো দোকানিরা দোকানের সামনে রাস্তার কিছুটা দখল করে টেবিলের ওপর দ্রব্যাদি সাজিয়ে রেখেছেন। কোনো কোনো স্থানে তাজা শাকসবজি নিয়ে লাইন ধরে গ্রামের কৃষক বসে আছেন। লিখে রাখা নির্দিষ্ট জিনিসের দামের সঙ্গেও দরদাম চলছে। সবজির ভেতর পলাণ্ডু, জুকিনি, টমেটো, মিঠে-আলু, পালংশাক, ছোটো আকারের বরবটি, বেগুন, পাপরিকা, ফুলকপি, ওলকপি ও বিটকপির দেখা পেলাম সবথেকে বেশি। কোথাও বিক্রি হচ্ছে অনেক রকমের সামুদ্রিক মাছ। সবকিছু পেরিয়ে স্থানীয় ক্রোয়েশীয় হাটে দুটি জিনিসে আমার চোখ আটকে গেল। এক, মধু এবং দুই, জলপাই তেল। প্রায় প্রতিটি মুদি দোকানের বাইরে ছাউনির নিচে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন আকারের চকচকে বয়ামে হরেক রকমের মধু আর অলিভ বা জলপাই তেল।

ক্রোয়েশিয়ার জলপাই তেল তার খাঁটি মান, সমৃদ্ধ স্বাদের জন্য সারা বিশ্বে প্রশংসিত। এদেশে জলপাই তেলের উৎপাদন ও বাজারজাত প্রক্রিয়া হাজার বছরের পুরোনো। ক্রোয়েশিয়ার ভেতরে ইস্ত্রিয়া এবং ডালমাচিয়া অঞ্চলের জলপাই তেলের সুনাম আরও বেশি। আগেও বলেছি, স্প্লিট ঐতিহাসিক ডালমাচিয়া অঞ্চলের অন্তর্গত। ফলে এসব কথা মনে আসতেই, আমি দোকান ঘুরে ঘুরে জলপাই তেল আর মধুর বয়ামে আটকে যেতে থাকলাম। যে কোনো দোকানের সামনে গেলেই দোকানদারের বড়ো চোখের ভেতর মধুর হাসির আভা, ভাঙা ইংরেজিতে দু’কথা বলার প্রচেষ্টা। কয়েকটি দোকানে পাওয়া গেলো ল্যাভেন্ডারের খাঁটি মধু। 

মারজানে হাইকিং করার ফাঁকে তোলা

জার্মানিতে ল্যাভেন্ডার আমার প্রিয় ফুলের একটি। জার্মানরা ল্যাভেন্ডারকে বলে ‘লাভেন্ডেল’। তবে জার্মান ল্যাভেন্ডার থেকে ক্রোয়েশীয় ল্যাভেন্ডারের ঘ্রাণ তুলনামূলক বেশি। এই ফুল মূলত ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বেশি পাওয়া যায়। ১ থেকে ৩ ফুট লম্বা গাছগুলো সাধারণত ঝোপালো হয়। পাতাগুলি সরু, লেন্স-আকৃতির, রঙ ধূসর-সবুজ। ল্যাভেন্ডারের ফুল সাধারণত নীলাভাব বেগুনি রঙের, লম্বা দণ্ডের চারপাশে গুচ্ছাকারে ফোটে। অনেকে বাঙলায় বলে ‘নীলদোলা ফুল’। জার্মানিতে আমার বাসার বাগানে একটি ল্যাভেন্ডারের ঝোঁপ আছে, বহুবার তার পাতা বুক পকেটে রেখেছি, ফুল তো পরের কথা, পাতাদের অনন্য সুগন্ধিতেই চোখ নিরীহ হয়ে আসে। মুদি দোকানের সামনে রাখা স্থানীয়ভাবে প্রক্রিয়া করা সেই মিষ্টি ঘ্রাণের ল্যাভেন্ডার ফুলের খাঁটি মধুর বয়াম চোখের সামনে দেখে লোভ সামলাতে না পেরে কিনেই ফেললাম। সঙ্গে কিনলাম একটি ছিপছিপে গঠনের ৭’শ মিলিলিটারের বোতলে জলপাই তেল। সৌন্দর্যস্বরূপ তেলের মধ্যে রোজমেরি পত্রের একটি শাখা ডোবানো। দোকানী জানালেন, ঘানি থেকে নিজেরাই প্রক্রিয়াকরণ করেছেন বিধায় বোতলের মুখ আধুনিক বাজারী নিয়মে বন্ধ করা নয়। অবশ্য কেনার আগে সব দোকানীই এক টুকরো পাউরুটির সঙ্গে অলিভ তেল খেয়ে পরখ করার সুযোগ দেন। 

রুটির কথা মনে হতেই খাবার-দাবারের কথা মনে এলো। ক্রোয়েশীয় স্থানীয় দোকান কিংবা সুপারমার্কেটে মন খারাপ করে দেবে রুটিগুলো। জার্মান রুটির কাছে তারা নস্যি। কেবল এক-দুই রকমের বাংলাদেশি পাউরুটির মতো রুটি পাওয়া যায়। আমি মূলত জার্মান দেশের বাইরে কোথাও গেলে টোস্ট কিংবা রুটির সঙ্গে সতেজ পনির যোগ করে খেয়ে ফেলি। অথবা টমেটোর সঙ্গে নরম ছোট্ট মোজারেলার সালাত বানাতে পারলে চিন্তা থাকে না। ক্রোয়েশীয় খাবারের দুনিয়ায় ঢুকতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলাম। সে দেশের পনির ডিম এবং টকদই দিয়ে বানানো কিছুটা ধাবড়ার মতো দেখতে বিখ্যাত স্ত্রুকলি পেটস্ত করলে, খেলাম কিনা এমন প্রশ্নে নিজেকেই জর্জরিত করতে হয়। সব খাবারেই মাংস এবং সামুদ্রিক মাছের আধিক্য বেশি, কিন্তু তাতে মশলা বলতে ঐ এক, গোলমরিচ। আরও বেশিদিন থাকলে হয়তো কোনো কিছুতে অভ্যস্ততা খুঁজে পাওয়া যেত। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর সুপারমার্কেটে চাল-ডাল-নুন-মশলা যেমন সহজলভ্য ক্রোয়েশীয়ায় তেমন নয়। ফলে বিভিন্ন বিদেশি রেস্টুরেন্টে মাঝে মধ্যেই যেতে হলো। 

ব্রাচ দ্বীপে লেখক

স্থানীয় বাজারে গিয়ে আরও একটি ব্যাপার বেশ লক্ষ করেছিলাম। নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাইই পোষাকে ফিটফাট ও সারাক্ষণ বাবু হয়ে থাকার চেষ্টা করে। কারমেলা ও তার বন্ধুদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর ভেবেছিলাম শিক্ষিত শ্রেণিই কেবল ফিটফাট থাকে; কারমেলার রুচি আর সৌন্দর্যের তুলনা মেলা ভার। কিন্তু না, মনে হলো ইউরোপের অন্য দেশের তুলনায় ক্রোয়েশীয় মানুষের পোশাকের রুচি কিছুটা আলাদা ও অনেকক্ষেত্রে উন্নত। নারী বা পুরুষের পোশাক-আশাক দেখলে মনে হবে না যে, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে দেহ প্রদর্শন করতে চায়। কারমেলা বলেছিল, এসব তাদের ঐতিহ্যের অংশ। শরীর দেখানো তাদের দেশে খুব ভালো চোখে দেখা হয় না, একইসঙ্গে অন্য দিকে নিপাট থাকায় তারা বেশ সচেতন এবং করিৎকর্মা। এ কারণেই গড়ে ক্রোয়েশীয় মানুষের সৌন্দর্যের সুনাম পৃথিবীখ্যাত। নিপাট পোশাকের সঙ্গে তাদের মেদহীন বিশালদেহী শরীর সুষম সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটায়। পথে চলতে চলতে যত ক্রোয়েশীয় নারী দেখেছি তাদের অধিকংশই উচ্চতায় ছয় ফিটের কাছাকাছি। অথচ রূপে কেউ যেন কারও থেকে কম নয়। এতো সুন্দর নারী-পুরুষ একসঙ্গে কোনো শহরে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। প্যারিসের স্থানীয় নারীদের পোশাকের বাহার, আর চলা-ফেরার ভেতরকার আভিজাত্য চোখ রাঙিয়ে দেয় ঠিকই কিন্তু ক্রোয়েশীয় নারীদের সৌন্দর্য যেন মুদিত চোখের ভেতরে দীর্ঘ রেশ রেখে যায়। কারমেলা আমার থেকেও উঁচু বলে আমাদের দলের অনেককে ঠাট্টা করতে শুনেছি।

ক্রোয়েশিয়া প্রজেক্টে একদিন আমাদের আমন্ত্রণ ছিলো স্প্লিটের অদূরে ব্রাচ নামক দ্বীপের একটি বিদ্যালয়ে। যেতে হবে ফেরিতে। মূল ভূমি থেকে ক্রোয়েশিয়া সাধারণত ফেরি ও লঞ্চের মাধ্যমেই সংযুক্তি রক্ষা করে থাকে। সমুদ্রের ভেতরে তারা কখনো সেতু নির্মাণ করবে কিনা সে বিষয়ে স্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা কারো কাছ থেকে পাইনি। নির্ধারিত সময়ে ফেরিঘাটে আমরা সবাই উপস্থিত। তখন সবে সূর্য উঠছে। এখান থেকে লঞ্চে করে এক রাত্রের যাত্রায় ইতালি যাওয়া যায়। ফেরিঘাটে দোকানপাটের ভিড় নেই, ভ্রাম্যমাণ কেউ কিছু বিক্রি করছে না। চারদিক দারুণ পরিচ্ছন্ন! সবাই লাইন ধরে টিকিট কেটে ছাউনির নিচে অপেক্ষা করছে। বাইরে যত রোদ বাড়ে, সমুদ্রের নোনা জলে তার ঝলকানি ততই বাড়তে থাকে। অপেক্ষা করতে করতে আমাদের যাত্রা বিষয়ক ঘোষণা শুনতে পেয়ে নির্দিষ্ট ঘাটের দিকে হাঁটি।

ফেরির চারপাশে উড়ছে গাঙচিল। ব্রাচ দ্বীপে ফেরি থেকে নামার পরে জলের কাছে যেতেই আমাদের মুখ থেকে আর শব্দ সরে না। স্প্লিটের উপকূলে আদ্রিয়ান সাগরের জল সবুজের দিকে ধাবমান নীল এবং স্বচ্ছ। মাছদের চলাচল থেকে শুরু করে ইঞ্জিননৌকার পাখা পর্যন্ত দেখা যায়। কিন্তু ব্রাচ দ্বিপের কাছে আদ্রিয়ানের জল তার থেকেও অভিরাম; গাঢ় ফিরোজা এবং অসম্ভব স্বচ্ছ। ঢেউ না থাকলে মনে হয় নৌকাগুলো ফিরোজা হাওয়ায় ভেসে আছে। ঐ মুহূর্তে মনে হতে থাকে দেখার জন্য ক্রোয়েশীয় উপকূলের ফিরোজা সামুদ্রিক জল আর পানের জন্য আইসল্যান্ডের গ্লেসিয়ারের অস্ফুরিত-শান্ত-নির্মল জল দুনিয়ার সেরা। এই দুই জলে আমোদিত হওয়ার আনন্দ কোনো লেখায়, কোনো বর্ণনায় দেওয়া সম্ভব নয়।

আদ্রিয়ান সমুদ্রের জল

ক্রোয়েশীয়ায় কাটানো দিনের অবসরে একা একা প্রায়ই স্প্লিট শহরের অদূরে ভূমধ্যসাগরীর পাইন গাছে ভরা মারজান পাহাড়ে হাইকিং করতে যেতাম। পাহাড়ের একদম চূড়ায় পতপত করে উড়তে দেখতাম ক্রোয়েশিয়ার পতাকা। ঠিক পতাকাটির কাছেই যে স্থানে ১৮১০ সালের দিকে নেপোলিয়নের সেনারা সেমাফোর টেলিগ্রাফের খুঁটি গেড়েছিল, সেখানটাই বসে উপর থেকে স্প্লিট শহর আর ফিরোজা নীল আদ্রিয়ান সাগর দেখে সময় পার করতাম। মাঝে মাঝে স্থানীয় মাঠে গিয়ে কিশোরদের সঙ্গে ফুটবল খেলতাম। তখন মনে হতো ক্রোয়েশিয়ার প্রতিটি লোকই যেন ভালো ফুটবল খেলা জানে। কখনো বন্ধুদের সঙ্গে সাগরের জলে ঝাপাঝাপি করতে যেতাম। কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেতো কেবল ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে, তবুও জল দেখার সাধ মিটতো না। কখনো গহিন রাত্রির হাওয়া খুলে দীর্ঘ সময় সাগরের তীরে বসে থাকতাম। কখনো শহরের বইয়ের দোকান আর লাইব্রেরিতে ঢুঁ মারা চলতো। ক্রোয়েশীয় সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদ পেতে খুব বেগ হতো দেখে এক সময় রাগ করে বইয়ের দোকানে ঘুরতে যাওয়া প্রায় বাদ দিয়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু ঐ আদ্রিয়ান দরিয়ার ফিরোজা রঙের জল, কখনোই হতাশ করেনি। (শেষ)

পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব : ফিরোজা দরিয়ার উপকূলে, ক্রোয়েশিয়ায়